
(বাঁদিকে) ডিম-সহ ছাতারের বাসা। (ডান দিকে) বাসায় ছাতারের ছানারা। ছবি: সংগৃহীত।
আমি তখন স্কুলে পড়ি। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করার পর বাবা আর মা যখন মুড়ি আর চা খেত আমাদের ভাইবোনদের জন্য বরাদ্দ ছিল এক গ্লাস করে হালকা গরম দুধ আর দুটো করে থিন অ্যারারুট বিস্কুট। রান্নাঘরের পাশে ছোট্ট বারান্দায় রাখা বেঞ্চে বসে আমরা এই চা ও দুধপান পর্ব সারতাম। আর সেই সময় প্রতিদিন হাজির হত একদল শালিক আর ছাতারে। কান ঝালাপালা হয়ে যেত ছাতারেদের চিৎকারে। তখন বাবা ও মা মুড়ি খেতে খেতে কিছু মুড়ি ছুঁড়ে দিত সামনে। লাফাতে লাফাতে এসে মহানন্দে ওরা মুড়ি খেত। তবে শালিক আর ছাতারেদের দুটো ভিন্ন দিকে খেতে দিতে হত। পাছে পাখিদের মধ্যে ঝামেলা বেধে যায়। তবে দেখেছি ছাতারেগুলো পরস্পরের মধ্যে চেঁচামেচি করলেও শালিকদের সঙ্গে ঝামেলায় যেত না। বেশ একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গিয়েছিল দুই প্রজাতির পাখিদের মধ্যে। বেশ চলছিল।
একদিন হঠাৎই নজরে এল, ছাতারেদের দলে একটা পাখি এক পায়ে লাফাচ্ছে। বাম পা মাটি থেকে উপরে। আকারেও যেন একটু ছোট। এমন ছাতারে তো আগে আসেনি মনে হয়। ছাতারেদের কোনও বাচ্চাই হবে। একটু বড় হয়ে দলে হয়তো সদ্য যোগ দিয়েছে। ছাতারের দলের এই নতুন অতিথি একটু দূরে দূরে বেড়াচ্ছিল। সামনে আসছিল না। ফলে অন্যান্য ছাতারেগুলো মুড়ি পেলেও ও পাচ্ছিল না। আমি ও ভাই কয়েকটা বিস্কুটের টুকরো ভেঙে দূরে ওর দিকে ছুঁড়ে দিলাম। কিন্তু ও বিস্কুটের কাছে পৌঁছানোর আগেই অন্য ছাতারেগুলো লাফিয়ে গিয়ে সাবাড় করে দিল। খাওয়া শেষে অন্যরা যখন উড়ে গেল তাদের সাথে পিছু পিছু বেচারা নতুন অতিথিও খালি পেটে উড়ে গেল। এরপর থেকে দেখলাম প্রতিদিন ওই প্রতিবন্ধী ছাতারে দলের সাথে আসে। পরে অবশ্য দলের ভেতরে মিশে গিয়ে সামান্য খাবার সেও পেত। কিন্তু ওই এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যা করার সে করত। বাম পা বাঁকা হয়ে ওপরের দিকে উঠেছিল। মনে হয় কোনও কারণে ভেঙে গিয়েছিল। কিছুদিন পরে দেখতাম এক পায়ের দিব্যি লাফাচ্ছে আর রীতিমতো দু’পাওয়ালা ছাতারেদের সাথে সমানতালে খাবার খাচ্ছে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যে মানসিক জোর থাকলে জয় করা সম্ভব তা ওই প্রতিবন্ধী ছাতারেটিও আমাদের শিখিয়ে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৯: বুলবুলি

শিবরাত্রি: তোমার নৃত্য অমিতবিত্ত ভরুক চিত্ত মম
এর অনেক দিন পর দেখা মিলল আর এক প্রতিবন্ধী ছাতারের। তখন আমি স্কুলে শিক্ষকতা করছি। স্কুলের সামনে ঘাস ভরা মাঠের মধ্যে ছাতারের দল প্রায়শই চেঁচামেচি ও লাফালাফি করত। একদিন হঠাৎই নজরে এল একটা এক পা ওয়ালা ছাতারে। এর বাম পা অর্ধেকটাই নেই। দিব্যি অন্যদের সঙ্গে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খাবারদাবার সংগ্রহ করছে। আবার ছাত্ররা যখন ক্লাস থেকে বেরোলো দল বেঁধে অন্যদের সঙ্গে দিব্যি উড়ে চলে গেল। তখন আমার কৈশোরে সেই প্রতিবন্ধী ছাতারের কথা মনে পড়ছিল। আর মনে পড়ছিল স্কুলে পড়ার সময় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মোরগ লড়াইয়ের কথা।
এই কয়েকদিন আগেও আমার নজরে এল আরও একটা এক পা-ওয়ালা ছাতারে। শনিবার স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়িতে ঢোকার ঠিক আগেই রাস্তার উপরে তিনটে ছাতারে দেখতে পেলাম। আর তাদের মধ্যে একটি এক পা-ওয়ালা। অবাক কাণ্ড, এরও বাম পা অর্ধেকটা নেই। ছাতারেদের সমাজে পায়ের জন্য প্রতিবন্ধীরা কি সবাই বামপন্থী? আমাকে দেখেই দুটো ছাতারে লাফ দিয়ে রাস্তার পাশে পাঁচিল ডিঙিয়ে ওপারে বাগানবাড়িতে পালালো। কিন্তু প্রতিবন্ধীটি দুটো লাফ দিয়ে উঠল পাঁচিলের উপরে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ওকে দেখার জন্য। সেও ঘাড় ফিরিয়ে একবার আমাকে দেখে নিল। তারপর পাঁচিলের ওপর দিয়ে ডান পায়ে লাফাতে লাফাতে কিছুটা এগিয়ে বাগানবাড়ির ঘাস জঙ্গলে তার দলবলের সাথে যোগ দিল। আর আমিও ঢুকে গেলাম বাড়িতে। হয়তো ছোটবেলায় কোনও সাপ বা কোনও শিকারি পাখির আক্রমণে বেচারা একটা পা খুইয়েছে। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা ওদের জীবন সংগ্রামে থাবা বসাতে পারেনি। জীবনবোধের এ শিক্ষা আমরা প্রকৃতি থেকেও পাই।
এই কয়েকদিন আগেও আমার নজরে এল আরও একটা এক পা-ওয়ালা ছাতারে। শনিবার স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়িতে ঢোকার ঠিক আগেই রাস্তার উপরে তিনটে ছাতারে দেখতে পেলাম। আর তাদের মধ্যে একটি এক পা-ওয়ালা। অবাক কাণ্ড, এরও বাম পা অর্ধেকটা নেই। ছাতারেদের সমাজে পায়ের জন্য প্রতিবন্ধীরা কি সবাই বামপন্থী? আমাকে দেখেই দুটো ছাতারে লাফ দিয়ে রাস্তার পাশে পাঁচিল ডিঙিয়ে ওপারে বাগানবাড়িতে পালালো। কিন্তু প্রতিবন্ধীটি দুটো লাফ দিয়ে উঠল পাঁচিলের উপরে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ওকে দেখার জন্য। সেও ঘাড় ফিরিয়ে একবার আমাকে দেখে নিল। তারপর পাঁচিলের ওপর দিয়ে ডান পায়ে লাফাতে লাফাতে কিছুটা এগিয়ে বাগানবাড়ির ঘাস জঙ্গলে তার দলবলের সাথে যোগ দিল। আর আমিও ঢুকে গেলাম বাড়িতে। হয়তো ছোটবেলায় কোনও সাপ বা কোনও শিকারি পাখির আক্রমণে বেচারা একটা পা খুইয়েছে। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা ওদের জীবন সংগ্রামে থাবা বসাতে পারেনি। জীবনবোধের এ শিক্ষা আমরা প্রকৃতি থেকেও পাই।
আরও পড়ুন:

ঈশ্বর কী সাড়া দেন তামিলে, সংস্কৃতে?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৪: খরগোশ ও কচ্ছপ
ছাতারে পাখি চেনে না এমন মানুষ সুন্দরবন তো বটেই সারা বাংলায় আর একজনও আছে কিনা সন্দেহ। তবে সব জায়গায় কিন্তু ছাতারে পাখি নামে এর পরিচিতি নেই। আমাদের সুন্দরবন এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ ছাতারেকে বলে ‘সাত ভাই’ পাখি। কারণটাও যথার্থ। একা একা ছাতারেদের দেখা যায় না বললেই চলে। সবসময় ৬-৭টি পাখি একসাথে থাকে। তাই হিন্দিতে এদের বলে ‘সাত বহিন’। এই পাখিকে ইংরেজিতে জাঙ্গল ব্যাবলার (Jungle Babbler) বললেও অনেক সময় বলে সেভেন সিস্টার্স (Seven sisters)। বাঙালি অবশ্য বোন না বলে ভাই সম্বোধন করেছে। তাই এই পাখিকে দেখলে বিখ্যাত “সাত ভাই চম্পা জাগো রে” গানটার কথা আমার মনে পড়ে যায়। তবে সুন্দরবনের অনেক এলাকায় একে উচ্চারণভেদে ‘ছাতরা’ পাখি নামেও ডাকে। অবশ্য নামে আসে যায় কিবা! এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Turdoides striata।
রূপের কথা ধরলে বড্ড ম্যাড়ম্যাড়ে রঙ এই পাখিদের। ধুলো রঙের পালক। তাই মাটির ওপরে যদি এরা ঘুরে বেড়ায় চেনা মুশকিল হয়। অবশ্য চুপচাপ তো এরা ঘোরে না, সারাক্ষণ ক্যাচোর ম্যাচোর করতেই থাকে।
এদিক থেকে এদের বহিন বলাই যুক্তিযুক্ত। মেয়েদের মধ্যেই তো বেশি ঝগড়াঝাঁটি চলে কিনা! আর পালকগুলো দেখলে মনে হবে যেন কষ্ট করে চামড়ার উপরে আটকে আছে, খুলে যেতে পারলেই বাঁচে! বড্ড ঢিলেঢালা পালকের বিন্যাস। এইরকম ছেতরে থাকা পালকের জন্যই ছাতারে নাম হয়েছে কিনা তা অবশ্য আমার জানা নেই। সে যাই হোক, এদের চঞ্চু আর চোখের রঙ ফ্যাকাশে হলুদ। দেখলে মনে হবে যেন তীব্র অ্যানিমিয়ায় ভুগছে! অ্যানিমিয়ায় ভোগা রোগীরা খুব দুর্বল হয় কিন্তু ছাতারেদের অফুরন্ত এনার্জি। এক মুহূর্ত চুপচাপ থাকে না, সারাক্ষণ লাফালাফি করে বেড়ায়। অবশ্য লাফ না বলে নাচানাচি বলাই ভালো। জোড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচা। মনে হয় ওদের জীবনে হাঁটা ব্যাপারটা নেই। তবে কিছুক্ষণ একা বা জোড়ায় বা কয়েকজনকে নিয়ে আমার ছাদের আলসেতে, আম ও জামরুল গাছে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছি। এরা আবার খুব বেশি উড়তেও পারে না। দূরে যেমন নয়, উঁচুতেও নয়। আসলে ডানার আকার দেহের তুলনায় বেশ ছোট। তাই এদের বিপদ আপদ হওয়ার সম্ভাবনাও যথেষ্ট বেশি। মনে হয় এই কারণেই এরা দলবদ্ধভাবে থাকার জন্য অভিযোজিত হয়েছে। এরা জানে ‘United we stand divide we fall’।
রূপের কথা ধরলে বড্ড ম্যাড়ম্যাড়ে রঙ এই পাখিদের। ধুলো রঙের পালক। তাই মাটির ওপরে যদি এরা ঘুরে বেড়ায় চেনা মুশকিল হয়। অবশ্য চুপচাপ তো এরা ঘোরে না, সারাক্ষণ ক্যাচোর ম্যাচোর করতেই থাকে।
এদিক থেকে এদের বহিন বলাই যুক্তিযুক্ত। মেয়েদের মধ্যেই তো বেশি ঝগড়াঝাঁটি চলে কিনা! আর পালকগুলো দেখলে মনে হবে যেন কষ্ট করে চামড়ার উপরে আটকে আছে, খুলে যেতে পারলেই বাঁচে! বড্ড ঢিলেঢালা পালকের বিন্যাস। এইরকম ছেতরে থাকা পালকের জন্যই ছাতারে নাম হয়েছে কিনা তা অবশ্য আমার জানা নেই। সে যাই হোক, এদের চঞ্চু আর চোখের রঙ ফ্যাকাশে হলুদ। দেখলে মনে হবে যেন তীব্র অ্যানিমিয়ায় ভুগছে! অ্যানিমিয়ায় ভোগা রোগীরা খুব দুর্বল হয় কিন্তু ছাতারেদের অফুরন্ত এনার্জি। এক মুহূর্ত চুপচাপ থাকে না, সারাক্ষণ লাফালাফি করে বেড়ায়। অবশ্য লাফ না বলে নাচানাচি বলাই ভালো। জোড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচা। মনে হয় ওদের জীবনে হাঁটা ব্যাপারটা নেই। তবে কিছুক্ষণ একা বা জোড়ায় বা কয়েকজনকে নিয়ে আমার ছাদের আলসেতে, আম ও জামরুল গাছে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছি। এরা আবার খুব বেশি উড়তেও পারে না। দূরে যেমন নয়, উঁচুতেও নয়। আসলে ডানার আকার দেহের তুলনায় বেশ ছোট। তাই এদের বিপদ আপদ হওয়ার সম্ভাবনাও যথেষ্ট বেশি। মনে হয় এই কারণেই এরা দলবদ্ধভাবে থাকার জন্য অভিযোজিত হয়েছে। এরা জানে ‘United we stand divide we fall’।

(বাঁদিকে) ছাদের প্যারাপেটে বসে দুই ছাতারে। ছবি: লেখক। (ডান দিকে) ছাতারের অবিন্যস্ত পালক। ছবি: সংগৃহীত।
এদের কাণ্ডকারখানা আমি প্রায়শই খুঁটিয়ে দেখি। বোঝার চেষ্টা করি চেঁচামেচি করার কারণ কী? মিনিট খানেক হয়তো দেখলাম সবাই খাবারদাবার খুঁজছে ঘাসের বা শুকনো পাতার ফাঁকে, তারপর হঠাৎই শুরু হয়ে গেল চেঁচামেচি। দেখে মনে হবে যেন হঠাৎ করে সবার মেজাজ গেছে বিগড়ে! দেখেছি, ওদের দলের কাছাকাছি যদি কাক, শালিক, হাঁড়িচাচা ইত্যাদি অন্য কোনও পাখি কিংবা কুকুর, বিড়াল, বেজি ইত্যাদি এসে পড়ে তখন ওরা সমস্বরে এমন চেঁচামেচি শুরু করে যে তারা পালাতে বাধ্য হয়। কখনও কখনও দলবদ্ধভাবে শত্রুকে আক্রমণ করতেও দেখা যায়। আর পাপিয়া (Common hawk cuckoo) পাখিকে দেখলে ভীষণ ক্ষেপে যায় ছাতারেরা। সবাই মিলে পাপিয়াকে তাড়া করে। কিন্তু তাও পাপিয়া ঠিক লুকিয়ে ছাতারের বাসায় ডিম পেড়ে যায়। ছাতারে আর পাপিয়ার ডিমের রঙ ও আকার একইরকম হওয়ায় ওরা বুঝতে পারে না যে নিজের ডিমের সঙ্গে মিশে আছে পাপিয়ার ডিম। শুনেছি গোলা কোকিল বা ঝুঁটিদার পাপিয়া পাখিও (Pied crested cuckoo) ছাতারের বাসায় ডিম পাড়ে। এই পাখিগুলিও যথেষ্ট চালাক। তারা একটা বাসায় একটার বেশি ডিম পাড়ে না পাছে ছাতারে বুঝে যায়! তবে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোলে মা আর বাবা ছাতারে নিজের হোক আর পাপিয়ার হোক কোনও বাচ্চার প্রতি বৈষম্য করে না। সমান যত্ন নিয়ে তাদের বড় করে তোলে ছাতারে দম্পতি। এই সাম্যবাদী মানসিকতা মানুষের সমাজে বিরল হলেও ছাতারেদের মধ্যে প্রবলভাবে বর্তমান।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৭: মা সারদার লিঙ্গপুজো

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’
ছাতারে পাখির সাইজ অনেকটা শালিক পাখির মতো, প্রায় দশ ইঞ্চি লম্বা। পিঠের উপরের দিকের পালকের রঙ মাটির মতো আর ডানার কিছু বড় পালকের রঙ সামান্য গাঢ়। লেজ লম্বাটে আর প্রান্তের পালক সামান্য গাঢ়। বুকের ও পেটের দিকের পালকের রঙ অনেকটা ফ্যাকাশে। আগেই বলেছি চঞ্চু আর চোখের রং ফ্যাকাশে হলুদ। পায়ের রঙ হলদেটে হলেও আরও বেশি ফ্যাকাশে। ছাতারে পাখির স্ত্রী ও পুরুষের রঙ এবং আকার একই রকম হওয়ায় খোলা চোখে দেখে আলাদা করে স্ত্রী-পুরুষ চেনা অসম্ভব। গ্রাম ও শহরে যেখানে ঝোপঝাড় ও বড় বড় গাছপালা আছে সেখানেই ছাতারে পাখিদের দেখা যায়। এরা ঝগড়াঝাটি নিজেদের মধ্যে করলেও স্বভাবে কিন্তু বেশ নিরীহ। আমার বাড়ির সামনে আমগাছে বা পেছনে জামরুল গাছে বসে ওরা যখন মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেয় তখন দেখলে খুব বোকা, হাবাগোবা, গোবেচারা লাগে। এরা কিন্তু সত্যিই তাই। এর সুযোগ নেয় পাতিকাক, দাঁড়কাক, হাঁড়িচাচা ইত্যাদি চালাক পাখি। এরা সুযোগ পেলেই ছাতারের বাসা থেকে ডিম বা বাচ্চা চুরি করে খেয়ে নেয়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৩: নির্বাসিত অর্জুনের দাম্পত্যজীবনে নতুন সম্পর্কের বিচিত্র সংযোজন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ
খাবার-দাবারের ব্যাপারে ছাতারেদের খুব বেশি বাছবিচার নেই। ফড়িং, মাকড়সা, পিঁপড়েসহ নানারকম কীটপতঙ্গ, শুয়োপোকা; বিভিন্ন গাছের ছোট আকারের ফল বিশেষ করে বট, অশ্বত্থ ইত্যাদি গাছের ফল; ধান, গম ইত্যাদি শস্য; বিভিন্ন ফুলের মধু—সবই রয়েছে খাদ্য তালিকায়। তবে শিমুল আর মাদার ফুলের মধু ছাতারেদের বড় প্রিয়। এই দুই গাছে ফুলের মধু খাওয়ার সময় এরা পরাগ মিলন ঘটিয়ে দেয়। তবে সুন্দরবনের বসতি এলাকায় আজকাল শিমুল গাছ অনেক কমে গেছে, আর মাদার গাছ তো অতি বিরল। বেচারা ছাতারেদের কথা কেউ ভাবে না! গ্রামের বাড়িতে আমাদের অনেক খেজুর গাছ ছিল। শীতকালে সেইসব গাছে রস দেওয়া হত। বুলবুলি ও পোয়াইদের সঙ্গে ছাতারেদেরও সেই খেজুর গাছে রস খেতে দেখেছি। আর বর্ষার সময় দেখেছি ওরা আমাদের নারকেল গাছের পাতার গোড়ায় অর্থাৎ ডেগোর ভেতরে ঢুকে আশ্রয় নিতে। তবে বৃষ্টি আসার উপক্রম হলেই ওরা সুপারি, নারকেল বা তাল গাছের পাতার নিচে চলে যায়। এদের শুয়োপোকা খাওয়ার পদ্ধতিটি ভারি অদ্ভুত। চঞ্চুতে ধরে মাটি বা গাছের ডালে এপাশ-ওপাশ ঠুকে শুয়ো ঝরিয়ে শুয়োপোকাকে মেরে তারপর গলাধঃকরণ করে।

(বাঁদিকে) ক্ষণিক বিশ্রামরত ছাতারে। ছবি: লেখক। (ডান দিকে) ছাতারেদের ঝগড়া চলছে। ছবি: সংগৃহীত।
ছাতারেদের প্রজনন ঋতু সাধারণত জুন-জুলাই মাসে। তবে অন্য সময়ও এদের ডিম পাড়তে দেখা গিয়েছে। তিন বছর বয়স হলে এরা প্রজননে সক্ষম হয়। তখন মাটির তিন থেকে পাঁচ ফুট উপরে দুটো ডালের ফাঁকে ঘাস, কাঠিকুটি ও শিকড় দিয়ে বাটির মতো একটা বাসা বানায়। বাসার গড়ন বা বাঁধন বেশ ঢিলেঢালা। বাসা বাঁধার কাজে স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ই অংশগ্রহণ করে। বাসা বাঁধা শেষ হলে স্ত্রী ছাতারে ঝকঝকে ও মসৃণ নীল রঙের ৩-৪ টি ডিম পাড়ে। তবে কখনও কখনও এর থেকে বেশি ডিমও দেখা যায়। সেক্ষেত্রে হয়তো পাপিয়া বা গোলা কোকিলের ডিম থাকতে পারে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোলে বাবা-মা ছাড়াও দলের একাধিক ছাতারেকে বাচ্চাদের খাবার এনে খাওয়াতে দেখা যায়। ছাতারেদের পারিবারিক ব্যবস্থা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যৌথ পরিবারের গুরুত্ব।
সুন্দরবনের বসতি এলাকায় এখন ছাতারেদের অভাব নেই। তবে জনসংখ্যা ও নগরায়নের চাপে যেভাবে সবুজ ধ্বংসলীলা চলছে তাতে সুন্দরবনের আরও অনেক পাখির মতো আগামীদিনে ওদেরও অস্তিত্বের সঙ্কট যে ঘনীভূত হবে তা বোঝার জন্য পরিবেশবিদ না হলেও চলে। ছাতারেদের দিনভর ঝগড়া আমাকে বিরক্ত করে না বরং কানের আরাম দেয়। ওরা আনন্দে আছে—একথা ভেবে মনেও আসে শান্তি। —চলবে।
সুন্দরবনের বসতি এলাকায় এখন ছাতারেদের অভাব নেই। তবে জনসংখ্যা ও নগরায়নের চাপে যেভাবে সবুজ ধ্বংসলীলা চলছে তাতে সুন্দরবনের আরও অনেক পাখির মতো আগামীদিনে ওদেরও অস্তিত্বের সঙ্কট যে ঘনীভূত হবে তা বোঝার জন্য পরিবেশবিদ না হলেও চলে। ছাতারেদের দিনভর ঝগড়া আমাকে বিরক্ত করে না বরং কানের আরাম দেয়। ওরা আনন্দে আছে—একথা ভেবে মনেও আসে শান্তি। —চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।