
(বাঁদিকে) বাসায় ফিঙের ডিম। (ডান দিকে) ফিঙের রৌদ্রস্না। ছবি: সংগৃহীত।
“কোথায় ডাকে দোয়েল-শ্যামা, ফিঙে গাছে গাছে নাচে…”
আমাদের বঙ্গভূমিতে এ দৃশ্য শুধু কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নন, মনে হয় প্রত্যেক বাঙালিই প্রত্যক্ষ করেছেন। কাক, শালিক, ফিঙে—এই তিনটে পাখি বাঙালিকে অন্তত চেনানোর প্রয়োজন নেই। বাসে বা ট্রেনে যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেই রাস্তার পাশে ইলেকট্রিক বা টেলিগ্রাফের তার ও খুঁটি, মাটিতে পোঁতা বাঁশ, গাছ থেকে প্রসারিত কম পাতাওয়ালা কোনও ডাল ইত্যদির ওপর একাকী বা জোড়ায় দ্বিখন্ডিত লেজ ঝুলিয়ে কুচকুচে কালো ফিঙে পাখিকে বসে থাকতে দেখেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ভারতীয় উপমহাদেশের অতি পরিচিত পাখি হল ফিঙে।
সুন্দরবনের বসতি এলাকায় ফিঙে আমাদের পরিচিত পাখি হলে কি হবে, এর অনেক স্বভাব আমাদের অপরিচিত। এর মতো সাহসী ও বুদ্ধিমান পাখি পাখিজগতে সত্যিই বিরল। এদের বাসার কাছাকাছি বাজ, চিল বা কাক একবার এলে হয়! প্রচণ্ড বেগে তাড়া করে ওদের পাড়াছাড়া করে। তখন ফিঙের ওড়া ও আক্রমণের ধরণ দেখলে বাজ বলে ভ্রম হতে পারে। ফিঙের সবচেয়ে অপছন্দের পাখি হল কাক। কোনও কাক বেশি সাহস দেখিয়ে ফিঙের বাসার কাছাকাছি এলে কিংবা ভুল করে চলে এলে আর রেহাই নেই। ঠুকরে-খুবলে-পালক ছিঁড়ে একেবারে রক্তাক্ত করে ছাড়ে। মনে হয় এ জন্যই ইংরেজিতে ফিঙে পাখিকে ‘King Crow’ আর হিন্দিতে ‘কোতবাল’ অর্থৎ কোতোয়াল বলে। ফিঙেরা নিজের আকারের থেকে অনেক বড়ো আকারের পাখিকে আক্রমণ করতে ভয় পায় না। সত্যিই এদের সাহস তুলনাহীন।
আমাদের বঙ্গভূমিতে এ দৃশ্য শুধু কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নন, মনে হয় প্রত্যেক বাঙালিই প্রত্যক্ষ করেছেন। কাক, শালিক, ফিঙে—এই তিনটে পাখি বাঙালিকে অন্তত চেনানোর প্রয়োজন নেই। বাসে বা ট্রেনে যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেই রাস্তার পাশে ইলেকট্রিক বা টেলিগ্রাফের তার ও খুঁটি, মাটিতে পোঁতা বাঁশ, গাছ থেকে প্রসারিত কম পাতাওয়ালা কোনও ডাল ইত্যদির ওপর একাকী বা জোড়ায় দ্বিখন্ডিত লেজ ঝুলিয়ে কুচকুচে কালো ফিঙে পাখিকে বসে থাকতে দেখেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ভারতীয় উপমহাদেশের অতি পরিচিত পাখি হল ফিঙে।
সুন্দরবনের বসতি এলাকায় ফিঙে আমাদের পরিচিত পাখি হলে কি হবে, এর অনেক স্বভাব আমাদের অপরিচিত। এর মতো সাহসী ও বুদ্ধিমান পাখি পাখিজগতে সত্যিই বিরল। এদের বাসার কাছাকাছি বাজ, চিল বা কাক একবার এলে হয়! প্রচণ্ড বেগে তাড়া করে ওদের পাড়াছাড়া করে। তখন ফিঙের ওড়া ও আক্রমণের ধরণ দেখলে বাজ বলে ভ্রম হতে পারে। ফিঙের সবচেয়ে অপছন্দের পাখি হল কাক। কোনও কাক বেশি সাহস দেখিয়ে ফিঙের বাসার কাছাকাছি এলে কিংবা ভুল করে চলে এলে আর রেহাই নেই। ঠুকরে-খুবলে-পালক ছিঁড়ে একেবারে রক্তাক্ত করে ছাড়ে। মনে হয় এ জন্যই ইংরেজিতে ফিঙে পাখিকে ‘King Crow’ আর হিন্দিতে ‘কোতবাল’ অর্থৎ কোতোয়াল বলে। ফিঙেরা নিজের আকারের থেকে অনেক বড়ো আকারের পাখিকে আক্রমণ করতে ভয় পায় না। সত্যিই এদের সাহস তুলনাহীন।
ফিঙেরা উঁচু জায়গায় বসে থেকে চারদিকে লক্ষ্য-নজর রাখে। ফলে কোথাও কোনও পাতার আড়ালে শিকার ধরার অপেক্ষায় শিকরে বাজ বা চিল চুপচাপ বসে থাকলে কিংবা আকাশে উড়তে দেখলে ফিঙের নজর এড়ায় না। আর তৎক্ষনাৎ সে অবিকল শিকরে বাজের মতো ‘কিক-কি কিক-কি’ করে ডাকতে শুরু করে। আসলে এটা অন্য পাখিদের সতর্কীকরণের ডাক। ডাক শুনে অন্য পাখিরা মনে করে কাছাকাছি কোথাও বাজপাখি ডাকছে। ফলে তারা সতর্ক হয়ে যায় ও নিরাপদ আস্তানায় সরে পড়ে। এই সময় সাধারন পাখিদের স্বাভাবিক কলকাকলি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায়। বেচারা বাজপাখি বা চিল হতাশ হয়ে একটু পরে এলাকা ছাড়লে আবার পাখিরা যে যার স্বাভাবিক কাজে ফেরে। এ ভাবে ফিঙে ছোটো পাখিদের শিকারি পাখির শিকার হবার হাত থেকে বাঁচায়। এ জন্য অন্য পাখিরা ফিঙের উপর খুব ভরসা করে। যে গাছে ফিঙে বাসা বানায় সেই গাছের নীচের ডালে বা পাশের গাছে শালিক, ঘুঘু, বেনেবৌ, বুলবুল ইত্যাদি পাখি বাসা বানায়। ফলে তাদের ডিম ও ছানারা এবং নিজেরাও সুরক্ষিত থাকে। এজন্য ফিঙেকে পাখিজগতের পুলিশ কমিশনার বললে মনে হয় অত্যুক্তি হবে না।
তবে ফিঙে মাঝে মাঝে গুন্ডাগিরিও করে। কোনও পাখি হয়তো মাটিতে পোকা ধরেছে বা কোনও ডালে পোকা ধরে এনে বসেছে—ফিঙে হঠাৎ এমন তাড়া করে যে সে বেচারা পোকা ফেলে উড়ে পালাতে বাধ্য হয়। আর তখন ফিঙে তার ফেলে যাওয়া পোকাকে আত্মসাৎ করে। এই প্রসঙ্গে আফ্রিকার চামচ-পুচ্ছ ফিঙের একটা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের কথা জানা গেছে। কালাহারি মরুভূমিতে এই ফিঙেরা যখন খাদ্যাভাব দেখা দেয় অন্য পাখিদের মিথ্যে বিপদ-সংকেত দিয়ে বিভ্রান্ত করে। ওরা জানে অন্য পাখিরা, এমনকি কিছু ছোট প্রাণীও তার পাঠানো বিপদ সংকেতের ওপর কতটা নির্ভরশীল। ওরা সেই সুযোগটাই নেয়। মিথ্যে বিপদ-সংকেতসূচক ডাক দিলে অন্য পাখি ও ছোটো প্রাণীরা তাদের সংগ্রহ করা খাবার ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে পালায়। আর তখন সে ওই খাবার আত্মসাৎ করে। এজন্য যদি চামচ-পুচ্ছধারী ফিঙেদের ‘প্রতারক’ বলা হয় খুব একটা ভুল বলা হবে না!
তবে ফিঙে মাঝে মাঝে গুন্ডাগিরিও করে। কোনও পাখি হয়তো মাটিতে পোকা ধরেছে বা কোনও ডালে পোকা ধরে এনে বসেছে—ফিঙে হঠাৎ এমন তাড়া করে যে সে বেচারা পোকা ফেলে উড়ে পালাতে বাধ্য হয়। আর তখন ফিঙে তার ফেলে যাওয়া পোকাকে আত্মসাৎ করে। এই প্রসঙ্গে আফ্রিকার চামচ-পুচ্ছ ফিঙের একটা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের কথা জানা গেছে। কালাহারি মরুভূমিতে এই ফিঙেরা যখন খাদ্যাভাব দেখা দেয় অন্য পাখিদের মিথ্যে বিপদ-সংকেত দিয়ে বিভ্রান্ত করে। ওরা জানে অন্য পাখিরা, এমনকি কিছু ছোট প্রাণীও তার পাঠানো বিপদ সংকেতের ওপর কতটা নির্ভরশীল। ওরা সেই সুযোগটাই নেয়। মিথ্যে বিপদ-সংকেতসূচক ডাক দিলে অন্য পাখি ও ছোটো প্রাণীরা তাদের সংগ্রহ করা খাবার ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে পালায়। আর তখন সে ওই খাবার আত্মসাৎ করে। এজন্য যদি চামচ-পুচ্ছধারী ফিঙেদের ‘প্রতারক’ বলা হয় খুব একটা ভুল বলা হবে না!
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০১: সরষের মধ্যে ভূত

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৯: আপনামাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়
আমাদের পরিচিত ফিঙের বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Dicrurus macrocercus’, ইংরেজিতে বলে ‘Black Drongo’। কিছু দিন আগে পর্যন্ত এদের আফ্রিকার ‘Fork Tailed Drongo’ (Dicrurus adsimilis)-এর একটি উপপ্রজাতি হিসেবে ধরা হত। কিন্তু বর্তমানে একে পৃথক প্রজাতির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফিঙে লম্বায় হয় প্রায় ১১ ইঞ্চি। তবে এর মধ্যে লেজটাই হয় প্রায় ৬ ইঞ্চি। দ্বিখণ্ডিত লম্বা লেজটা নিয়ে যেন এদের বড়ো ঝামেলা। মাটিতে বসলে লেজ মাটিতে ঠেকে যাবেই। তাই ওরা খুঁটি, গাছের পাতাহীন লম্বা ডাল এবং ইলেকট্রিক বা টেলিগ্রাফের তারকে বসার জন্য বেছে নেয়। তাছাড়া এসব জায়গায় বসে চারপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে এলাকার মধ্যে উড়ন্ত পোকামাকড় দেখা যায় বা শিকারী পাখিদের আনাগোনার উপর নজরদারি করা যায়। স্ত্রী ও পুরুষ ফিঙে উভয়ের রং চকচকে কালো। বহিরাকৃতিগতভাবেও একরকম দেখতে। ওজন হয় ৪০ থেকে ৮০ গ্রাম। চঞ্চু কালো, আর চঞ্চুর গোড়ায় উভয় দিকে একটা সাদা দাগ থাকে। চোখের রং গাঢ় বাদামি। অপরিণত ফিঙের পেটে সাদা ছিট থাকে। দূর থেকে দেখে আঁশের মতো মনে হয়। বেশ জোরে ডাকতে পারে ফিঙে। এদের ডাকে বৈচিত্র্য থাকলেও আমার বাড়ির ছাদে থাকা বাঁশের খুঁটিতে বসে বেশিরভাগ সময় ‘চ্যাঁ-চি-চিউ চ্যাঁ-চি-চিউ’ এবং ‘চ্যাঁ-চুচুচু চ্যাঁ-চুচুচু’ করেই ডাকে। মাঝে মাঝে টানা ‘চ্যাঁ-চি-চিউ’ ডাকের শেষে ‘চ্যাঁ-চিউউউ’ বলে টান দেয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১০: মানুষের পাশে, মানুষের কাছে

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৪: ‘…জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’, লরেন্স ও ফ্রিডা/২
এদের প্রধান খাবার হল উড়ন্ত পোকামাকড়। পোকাদের মধ্যে প্রিয় হল ঘাস ফড়িং, ঝিঁঝিঁ পোকা, বোলতা, মৌমাছি, মথ, শুয়োপোকা, উইপোকা, গুবরে পোকা, পিঁপড়ে ও রাক্ষুসে ফড়িং (Dragon fly)। উঁচু জায়গায় বসে লম্বা লেজ দোলাতে দোলাতে লক্ষ্য রাখে মাটিতে কোথাও পোকা দেখা যাচ্ছে কিনা বা বাতাসে উড়ছে কিনা। দেখতে পেলেই সাঁ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে পোকাটাকে ধরে ফের স্বস্থানে এসে বসে। তারপর গিলে বা ছিঁড়ে ছিঁড়ে সেই পোকাকে উদরস্থ করে। কখনও কখনও মাটিতে নেমে পোকা ধরে মাটিতে বসেই ভোজনপর্ব সারে। ক্ষেতে যখন লাঙল করা হয় তখন আশেপাশে ফিঙেদের হাজিরা বেড়ে যায়। এই সময় মাটির ভেতরে থাকা নানা ফড়িং ও পোকাদের লার্ভা বেরিয়ে আসে। সেইসব খাওয়ার জন্য ফিঙেরা মুখিয়ে থাকে। এদের এতটাই সাহস যে এই সময় লাঙলরত মানুষের খুব কাছে এসে পোকা ধরে খায়। কখনও কখনও দেখা যায় মাঠে গোরু বা মোষ চরছে আর তার শিঙে বা পিঠের উপর বসে আছে ফিঙে। আসলে গোরু-মোষের ক্ষুরের আঘাতে মাটি থেকে বেরিয়ে আসা পোকাদের ধরে খাওয়ার জন্যই ওরা গোরু-মোষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায়। আর জমিতে ঘাসের উপর এদের দুপুর রোদে ডানা মেলে রৌদ্রস্নান করতে অনেকবার দেখেছি। এ দৃশ্যও নয়নাভিরাম।

(বাঁদিকে) অপরিণত ফিঙে। (ডান দিকে) ফিঙের মাতৃস্নেহ। ছবি: সংগৃহীত।
কয়েকদিন আগে একটা আজব দৃশ্য নজরে এল। তখন দুপুর প্রায় একটা। দেখি আমার ড্রয়িং রুমের জানালার সামনে বিদ্যুৎবাহী তারের উপর একটা পূর্ণবয়স্ক ফিঙে বসে পাশেই কচুরিপানা ভরা জলা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে আছে আর মাঝে মাঝে লেজ দোলাচ্ছে। আমি চটপট মোবাইল ক্যামেরাটা খুলে তাক করলাম। দু’তিনটে স্ন্যাপ নেওয়ার পর দেখি সে ঝপ করে নীচের দিকে নেমে গেল। ভাবলাম, কোনও পোকা ধরে অচিরেই ফিরে আসবে। ও মা! সে ফিরে এল না। আমি মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করলাম, এদিক-ওদিক তার ও খুঁটি দেখলাম। না, সে নেই! কোথাও তো উড়ে যেতেও দেখিনি। ফিঙেটা যে-অভিমুখে নেমেছিল সেদিকে রাস্তা। কিন্তু জানালা থেকে বাড়ির সামনে রাস্তাটা পুরো দেখা যাচ্ছিল না কারণ আমার বাড়ির পাঁচিল রাস্তা আড়াল করছিল। ও কি রাস্তায় নেমে বসে আছে? কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে সোজা গেলাম ছাদে, কারণ ওখান থেকে রাস্তার পুরোটাই দৃশ্যমান। গিয়ে দেখি দারুন এক দৃশ্য! একটা ছাগল পাঁচিলের গা ঘেঁসে রাস্তার ওপরে মেহগনি গাছের ছায়ায় শুয়ে জাবর কাটছে, আর ফিঙেটা দিব্যি বসে আছে তার মাথায়! কোনও হেলদোল নেই ছাগলটার। এই অসম বন্ধুত্বের রহস্যটা আমায় জানতেই হবে! বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। দেখি ফিঙেটা ছাগলের কান থেকে এঁটুলি খুঁটে খাচ্ছে। আর তাই ছাগলটা মাথায় ফিঙেটাকে নিয়ে আরামে জাবর কাটছে। আমার আবারও একটা শিক্ষা হল—বন্ধুত্বে ও সহযোগিতায় জাত বা ধর্মের কোনও সীমারেখা নেই।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৬: সুন্দরবনের পাখি — কুবো

যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১
ফেব্রুয়ারি থেকে অগাস্ট হল এদের প্রজনন ঋতু। এই সময় স্ত্রী ও পুরুষ ফিঙে সকালবেলা দুজনে মিলে ডাকাডাকি শুরু করে। আর উড়ন্ত অবস্থায় স্ত্রী ফিঙেকে পুরুষ ফিঙে তাড়া করতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে মাটিতে জড়াজড়ি করে লুটোপুটি খেতেও দেখা যায়। প্রায় পুরো প্রজনন ঋতুতে ওরা একসাথে থাকে। ডিম পাড়ার এক সপ্তাহ আগে থেকে স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ে মিলে বাসা বানানো শুরু করে। মাটি থেকে ১২-৩০ ফুট উচ্চতার মধ্যে ঘন পাতাওয়ালা গাছের এমন একটা লম্বা ডাল বেছে নেয় বাসা বানানোর জন্য যেখানে ডালটি দুটো শাখা বেরোনোর জন্য ইংরেজি ‘V’ আকার নিয়েছে। ওখানেই শুকনো ঘাস, সরু কাঠি, সরু শেকড় বা গাছের তন্তু দিয়ে বাটির মতো একটা বাসা বানায়। বাসা বানানোর জন্য কাঁঠাল গাছ ওদের খুব পছন্দ। কখনও কখনও ইলেকট্রিকের বা টেলিফোনের পোস্টের ওপরও বাসা বানায়। বাসা তৈরি হলে তার উপর স্ত্রী ও পুরুষ ফিঙে ঘুরে ঘুরে চাপ দিয়ে বাসাটাকে গভীর করে। তারপর স্ত্রী ফিঙে ৩-৪টি ডিম্বাকার ডিম পাড়ে। ডিমের রঙ সাদা বা ক্রিম-রঙা বা লালচে হয় এবং তার উপর কালচে বা বেগুনি ছিট থাকে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০১: অর্জুন প্রমাণ করলেন, রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের কোনও স্থান নেই

হ্যালো বাবু!, পর্ব-৬৭: গুগলি/২
স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ে মিলে তা দেয়। ১৪-১৫ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চারা বেরিয়ে আসে। কোনও কারণে প্রথমবার ডিম নষ্ট হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার ডিম পেড়ে তা দিয়ে বাচ্চার জন্ম দেয়। ১৬-১৭ দিন বয়স হলে বাচ্চারা উড়তে শেখে। তিন সপ্তাহ বয়স না হলে কিন্তু বাচ্চাদের লেজ দ্বিখণ্ডিত হয় না। বাচ্চাদের একটা মজার খেলা খেলতে দেখা যায় শঙ্খচিলের বাচ্চাদের মতো। বাচ্চারা চঞ্চু দিয়ে গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে উড়ে গিয়ে সেই পাতা ধরে। এভাবে ওরা উড়ন্ত পোকা ধরে খাওয়ার কৌশল অনুশীলন করে। বাচ্চাদের এক মাস বয়স পর্যন্ত বাবা-মা তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়। তারপর বাচ্চাদের নিজের বাঁচার রাস্তা নিজেকেই দেখে নিতে হয়। যদি কোনও বাচ্চা এক মাস বয়সের পরও মা বা বাবার কাছে খাবার খাওয়ার জন্য বায়না করে তবে তাদের তাড়া খেয়ে পালাবার পথ পায় না। সাধারণতঃ দু’বছর বয়স হলে তবেই ওরা প্রজননে সক্ষম হয়।
ফিঙে হল গ্রীষ্মমন্ডলের পাখি। দক্ষিণ-পশ্চিম ইরান থেকে শুরু করে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমার, দক্ষিণ চিন হয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত এদের বিস্তার। সারা পৃথিবী জুড়ে এদের নানান প্রজাতির বাস। শুধু এশিয়াতেই প্রায় ২৪টি প্রজাতি পাওয়া যায়। সুন্দরবন এলাকায় ফিঙেরা মোটামুটি স্বস্তিতেই আছে বলে খবর। ভারতীয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনে (১৯৭২) ফিঙে রয়েছে চতুর্থ শিডিউলে, অর্থাৎ বিপন্ন নয়। IUCN এদের ন্যূনতম বিপন্ন (Least Concern)হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ফিঙে হল গ্রীষ্মমন্ডলের পাখি। দক্ষিণ-পশ্চিম ইরান থেকে শুরু করে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমার, দক্ষিণ চিন হয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত এদের বিস্তার। সারা পৃথিবী জুড়ে এদের নানান প্রজাতির বাস। শুধু এশিয়াতেই প্রায় ২৪টি প্রজাতি পাওয়া যায়। সুন্দরবন এলাকায় ফিঙেরা মোটামুটি স্বস্তিতেই আছে বলে খবর। ভারতীয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনে (১৯৭২) ফিঙে রয়েছে চতুর্থ শিডিউলে, অর্থাৎ বিপন্ন নয়। IUCN এদের ন্যূনতম বিপন্ন (Least Concern)হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

(বাঁদিকে) ফিঙে। ছবি: সংগৃহীত। (ডান দিকে) খামারে পোঁতা খুঁটির ওপরে জোড়া ফিঙে। ছবি: লেখক।
শেষে বলব ফিঙের সবচেয়ে উপকারী ভূমিকার কথা। ফসলের ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফসলকে রক্ষা করতে এদের জুড়ি মেলা ভার। ধানের ভয়ানক ক্ষতিকর পোকা হল মাজরা পোকা। আর একটা ফিঙে প্রতিদিন গড়ে ২৫-২৮টি মাজরা পোকা খায়। একটা স্ত্রী মাজরা পোকা এক একবারে ২৫০-৩০০ ডিম পাড়ে এবং তা থেকে ওই পরিমান মাজরা পোকার জন্ম হয়। তাহলে একবার ভেবে দেখুন, একটা স্ত্রী মাজরা পোকা খেলে ফিঙে কৃষকের কতখানি উপকার করে। এছাড়া সবুজ ও বাদামি ঘাস ফড়িং, পামরি পোকা ইত্যদি ক্ষতিকর পোকা খেয়েও কৃষকের প্রভূত উপকার করে। প্রাচীনকাল থেকে কৃষকরা কিন্তু এদের উপকারী ভূমিকার কথা জেনে এসেছে। আর তাই ধান ক্ষেতের মাঝে মাঝে দেখা যেত (এখনও মাঝে মাঝে দেখা যায়) কৃষক বাঁশের খুঁটি পুঁতে রেখেছে আর তার ওপর বসে আছে ফিঙে।
এখনও আমাদের সুন্দরবন এলাকার চাষিরা জমির মাঝে খুঁটি পুঁতে ফসল রক্ষার জন্য ফিঙেদের আহ্বান করে। আজকাল কৃষকরা রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ করায় ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সাথে মারা পড়ছে অসংখ্য উপকারী পোকামাকড় ও প্রাণী। এর ফলে পরিবেশে ভারসাম্য যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে, পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিতও হচ্ছে। অথচ আমাদের পাশেই রয়েছে উপকারী বন্ধু ফিঙে। ওরা আমাদের উপকারী পতঙ্গদের সাধারণত খায় না, কিন্তু কৃষকের ক্ষতিকর পতঙ্গদের খায়। ফলে ফসল রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি পরিবেশও রক্ষা পায়। দুঃখের কথা, এদের এই অসাধারণ উপকারী ভূমিকার কথা সুন্দরবন অঞ্চলের নবীন প্রজন্ম প্রায় ভুলতে বসেছে।
শেষে একটা মজাদার ঘটনার কথা বলি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে রুটা (Rota) দ্বীপে কৃষকের ফসল রক্ষা করার জন্য আফ্রিকার দেশ তাইওয়ান থেকে কিছু ফিঙে আমদানি করা হয়েছিল। রুটা হল একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর ও আর একদিকে ফিলিপিনিয় সাগর ঘেরা ৩৮ বর্গ মাইলের মার্কিন অধিকৃত একটা ছোট্টো দ্বীপ। ওই দ্বীপে এদের সংখ্যা কয়েক বছরের মধ্যে খুব বেড়ে যায়। এই দ্বীপের দক্ষিণ দিকে মার্কিন অধিকৃত অপর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় বৃহৎ দ্বীপ হল গুয়াম (Guam)। এই দ্বীপেও আগে কোনও ফিঙে ছিল না। কিন্তু এক দশকের মধ্যেই দেখা যায় সমুদ্রপথের উপর দিয়ে রুটা থেকে ফিঙেরা হাজির হয়েছে গুয়াম দ্বীপে। আর ১৯৬৭ সালে ওই দ্বীপে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সদস্যবিশিষ্ট পাখির প্রজাতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। আজও ওরা গুয়ামে পাখিদের রাজত্বে এক নম্বর আসন ধরে রেখেছে! —চলবে।
এখনও আমাদের সুন্দরবন এলাকার চাষিরা জমির মাঝে খুঁটি পুঁতে ফসল রক্ষার জন্য ফিঙেদের আহ্বান করে। আজকাল কৃষকরা রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ করায় ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সাথে মারা পড়ছে অসংখ্য উপকারী পোকামাকড় ও প্রাণী। এর ফলে পরিবেশে ভারসাম্য যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে, পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিতও হচ্ছে। অথচ আমাদের পাশেই রয়েছে উপকারী বন্ধু ফিঙে। ওরা আমাদের উপকারী পতঙ্গদের সাধারণত খায় না, কিন্তু কৃষকের ক্ষতিকর পতঙ্গদের খায়। ফলে ফসল রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি পরিবেশও রক্ষা পায়। দুঃখের কথা, এদের এই অসাধারণ উপকারী ভূমিকার কথা সুন্দরবন অঞ্চলের নবীন প্রজন্ম প্রায় ভুলতে বসেছে।
শেষে একটা মজাদার ঘটনার কথা বলি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে রুটা (Rota) দ্বীপে কৃষকের ফসল রক্ষা করার জন্য আফ্রিকার দেশ তাইওয়ান থেকে কিছু ফিঙে আমদানি করা হয়েছিল। রুটা হল একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর ও আর একদিকে ফিলিপিনিয় সাগর ঘেরা ৩৮ বর্গ মাইলের মার্কিন অধিকৃত একটা ছোট্টো দ্বীপ। ওই দ্বীপে এদের সংখ্যা কয়েক বছরের মধ্যে খুব বেড়ে যায়। এই দ্বীপের দক্ষিণ দিকে মার্কিন অধিকৃত অপর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় বৃহৎ দ্বীপ হল গুয়াম (Guam)। এই দ্বীপেও আগে কোনও ফিঙে ছিল না। কিন্তু এক দশকের মধ্যেই দেখা যায় সমুদ্রপথের উপর দিয়ে রুটা থেকে ফিঙেরা হাজির হয়েছে গুয়াম দ্বীপে। আর ১৯৬৭ সালে ওই দ্বীপে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সদস্যবিশিষ্ট পাখির প্রজাতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। আজও ওরা গুয়ামে পাখিদের রাজত্বে এক নম্বর আসন ধরে রেখেছে! —চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।