(বাঁদিকে) ড্রেনে খাবারের সন্ধানে কুবো। ছবি: লেখক। (ডান দিকে) অপরিণত কুবো। ছবি: সংগৃহীত।
মথুরায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর সুদামা ছোটবেলায় ছিল পরষ্পরের অন্তরঙ্গ বন্ধু। যদিও কৃষ্ণ ধনীর দুলাল, আর সুদামা দরিদ্র বাড়ির সন্তান কিন্তু তাতে কৃষ্ণ ও সুদামার শৈশবকালীন বন্ধুত্বে কোনও ব্যবধান তৈরি হয়নি। পরিণত বয়সে কৃষ্ণ রাজা হয়ে যখন দ্বারকায় চলে গেল তখন সুদামার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এ দিকে মথুরায় সুদামা বিয়ে করে সংসারী হল। তাদের ছেলেপুলে হল। কিন্তু সুদামার দারিদ্র্য দিন দিন বেড়েই চলল। এমন অবস্থা হল যে সংসার আর কোনওমতেই চালানো যায় না।
স্ত্রী বসুন্ধরা একদিন সুদামাকে পরামর্শ দিল, বন্ধু কৃষ্ণের কাছে একবার গিয়ে দেখো, নিশ্চয়ই আমাদের দারিদ্র্যমোচনের একটা ব্যবস্থা করে দেবে। স্ত্রীর কথামতো সুদামা একদিন বেরিয়ে পড়ল দ্বারকাযাত্রায়। সঙ্গে নিল পড়শির বাড়ি থেকে চেয়ে আনা কয়েক মুঠো চিড়ে। ছোটবেলায় কৃষ্ণ সুদামার কাছ থেকে চিড়ে খেতে খুব ভালোবাসত। বাড়ি থেকে বেরিয়েই সুদামার নজরে পড়ল একটা কুবো পাখি। সুদামা ভাবল, যাত্রার শুরুতে যখন কুবো পাখি দেখেছি, আশাপূরণ নিশ্চয়ই হবে। সুদামা কৃষ্ণের মুখোমুখি হতে কৃষ্ণ দারুণ খুশি হল। সুদামার আনা চিড়ে খেয়ে শৈশবের স্মৃতিচারণায় ডুবে গেল। কৃষ্ণ আর তার স্ত্রী রুক্মিনী দু’জনে মিলে সুদামার দারুণ আতিথেয়তা করল।
স্ত্রী বসুন্ধরা একদিন সুদামাকে পরামর্শ দিল, বন্ধু কৃষ্ণের কাছে একবার গিয়ে দেখো, নিশ্চয়ই আমাদের দারিদ্র্যমোচনের একটা ব্যবস্থা করে দেবে। স্ত্রীর কথামতো সুদামা একদিন বেরিয়ে পড়ল দ্বারকাযাত্রায়। সঙ্গে নিল পড়শির বাড়ি থেকে চেয়ে আনা কয়েক মুঠো চিড়ে। ছোটবেলায় কৃষ্ণ সুদামার কাছ থেকে চিড়ে খেতে খুব ভালোবাসত। বাড়ি থেকে বেরিয়েই সুদামার নজরে পড়ল একটা কুবো পাখি। সুদামা ভাবল, যাত্রার শুরুতে যখন কুবো পাখি দেখেছি, আশাপূরণ নিশ্চয়ই হবে। সুদামা কৃষ্ণের মুখোমুখি হতে কৃষ্ণ দারুণ খুশি হল। সুদামার আনা চিড়ে খেয়ে শৈশবের স্মৃতিচারণায় ডুবে গেল। কৃষ্ণ আর তার স্ত্রী রুক্মিনী দু’জনে মিলে সুদামার দারুণ আতিথেয়তা করল।
এদিকে সুদামা কৃষ্ণের সাথে গল্পে মশগুল হয়ে বলতে ভুলেই গেল সে কী উদ্দেশ্যে কৃষ্ণের কাছে এসেছে। মথুরায় ফেরার সময় তার মনে পড়ল, যা আসল কথাই তো বলা হয়নি! বসুন্ধরার কাছে কী জবাব দেবে সুদামা? ভাবতে ভাবতে নিজের বাড়ির সামনে এসেই সুদামা অবাক হয়ে গেল! কোথায় তাদের ভাঙা কুটির? এ তো এক প্রাসাদ? কৃষ্ণ সুদামার মনোবাঞ্ছা বুঝতে পেরেছিল। আর তাই সুদামা না বললেও তার দারিদ্র্য দূর করে দিয়েছিল। সুদামা বসুন্ধরার কাছে সব কথা গল্প করল। তারা স্থির সিদ্ধান্তে এল, বাড়ি থেকে বেরনোর সময় দেখা কুবো পাখিই তাদের জীবনে সৌভাগ্য এনে দিয়েছে। এজন্য দক্ষিণ ভারতে হিন্দুরা কুবো পাখিকে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করে।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৫: সুন্দরবনের পাখি — মাছরাঙা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৯: কী ছিল চিঠিতে, উত্তর লিখতে গিয়ে উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের হাত কেঁপেছিল
কুবো পাখি দেখা যায় সারা ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, দক্ষিণ চিন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশে। গ্রাম ও আধা-শহর এলাকায় এদের প্রায়শই দেখা যায়। কুবো হল সুন্দরবন এলাকার বসতি অঞ্চলের স্থায়ী পাখি। ছোটোবেলা থেকে আমিও এদের নিয়মিত দেখেছি পুকুরপাড়ে। আমাদের পুকুরে প্রচুর গুগলি শামুক জন্মাত। পুকুরের পাড়ে যত্রতত্র সবসময় দেখতাম প্রচুর গুগলির খোলক পড়ে আছে। এ সবই যে কুবোপাখির কাজ তা জানতাম। ওরা জলের কাছাকাছি ঘুরে বেড়াত। গুগলি দেখতে পেলেই তা তুলে নিত ঠোঁট দিয়ে। তারপর পা দিয়ে চেপে ধরে বাঁকা ঠোঁটের সাহায্যে নিপুনভাবে ভেতর থেকে মাংসল অংশ বার করে নিতে দেখতাম। পুকুরে প্রায়শই খেপলা জাল ফেলে মাছ ধরার সময় জালে প্রচুর গুগলি উঠত। পুকুরপাড়ে জাল ঝেড়ে মাছ বার করার সময় গুগলিগুলোকেও বার করে দেওয়া হত। পরে দেখেছি, সেইসব গুগলির মাংস কুবোদের উদরস্থ হয়েছে। অবশ্য আমাদের এলাকায় কুবোপাখি না বলে সবাই বনকাক বলেই এদের চেনে। একটানা কুপ্-কুপ্ করে ডাকে বলেই মনে হয় এদের নাম হয়েছে কুবো।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৩: রাগ অনুরাগের বন্ধন, ডিএইচ লরেন্স ও ফ্রিডা
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০১: সরষের মধ্যে ভূত
কুবো পাখিকে বনকাক বলা হলেও এরা আদৌ কাকের জাতভাই নয়। বরং এরা কোকিলের নিকটাত্মীয়। বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Centropus sinensis’, ইংরেজিতে ‘Greater Coucal’ বা ‘Crow Pheasant’। কোকিলের মতো এদের চোখের রঙ টকটকে লাল। তবে কোকিলের মতো এরা অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে না। এরা নিজেরাই বাসা বানায় এবং সন্তানকে প্রতিপালন করে। সাধারণত বর্ষার আগে এরা প্রজননে লিপ্ত হয়। এই সময় পুরুষ কুবো যেভাবে স্ত্রী কুবোর মন জয় করার চেষ্টা করে তা সত্যি মজাদার। আমি বেশ কয়েকবার আমাদের বাঁশবাগানে কুবোদের এই কীর্তিকলাপ দেখেছি।
পুকুরপাড়ে খাবারের খোঁজে কুবো। ছবি: সংগৃহীত।
এমনিতে স্ত্রী ও পুরুষ কুবো একইরকম দেখতে হলেও প্রজননের সময় আচরণ দেখে বোঝা যায় কোনটা পুরুষ, আর কোনটা স্ত্রী। পুরুষ কুবো স্ত্রী কুবোকে দেখিয়ে দেখিয়ে তার লম্বা পুচ্ছকে পিঠের কাছে তোলে আর নামায়। সেইসঙ্গে দুটো ডানাকে নীচের দিকে নামিয়ে কিছুটা ছড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে দোলাতে থাকে। এভাবেই সে স্ত্রী কুবোর পিছু নিয়ে ছোটে। কিছুক্ষণ ছোটাছুটির পর স্ত্রী কুবো তার লেজ ও ডানা নীচের দিকে নামিয়ে পুরুষ কুবোর প্রেম নিবেদন মঞ্জুর করে। সাধারণতঃ ওরা সারাজীবনে আর সঙ্গী বা সঙ্গিনী পরিবর্তন করে না। স্ত্রী ও পুরুষ কুবো দু’জনে মিলে একসঙ্গে বাসা বানায়। ঝোপের উপরে ওদের বাসা দেখেছি। ঘাস, বাঁশপাতা ও কাঠি দিয়ে বানানো বাসা। ঝোপের পাতা ও ডাল টেনে জুড়ে দিয়েছে সেই বাসায়। বাসা বেশ বড় ও গোলাকার, ফুটবলের সাইজের। বাসার একপাশে থাকে প্রবেশপথ।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৪: শিকারী ও ‘শিকার’
যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১
তবে এদের বাসা দেখে মনে হয়েছে এরা খুব একটা যত্ন নিয়ে বাসা বানাতে পারে না। বেশ অগোছালো ও পলকা বাসা। কখনও কখনও ওরা গাছের ডালেও বাসা বানায়, তবে তা কখনওই ছ’মিটারের উপরে নয়। স্ত্রী কুবো একসাথে ৩/৪টি ডিম পাড়ে। ডিমের রঙ সাদা, আর ডিমের ওপর চকের গুঁড়োর মতো একটা আস্তরণ থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ পালা করে তা দেয়। ১৫-১৬ দিনে ডিম ফুটে ছানারা বেরিয়ে আসে। আর ১৮-২২ দিন বয়স হলে ছানারা উড়তে শিখে যায়। তবে কুবোর প্রধান শত্রু হল দাঁড়কাক। এরা সুযোগ পেলে কুবোর ডিম খেয়ে নেয়। আবার কখনও কখনও কুবো-দম্পতি কোনও অজানা কারণে ডিমে তা না দিয়েই বাসা ছেড়ে চলে যায়।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০০: সন্দেহের তীরবিদ্ধ ভরতদের আজও খুঁজে পাওয়া যায়
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৮: প্রতিভা দেবী—ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী
পরিণত কুবোর আকার প্রায় দাঁড়কাকের সমান। লেজসমেত লম্বায় হয় ৪৫-৫০ সেমি। ওজন হয় ২২৫-৪০০ গ্রাম। গায়ের রং কুচকুচে কালো, কিন্তু দুটো ডানা তামাটে-বাদামি। কালো রঙের লেজটা বেশ লম্বা। মাটির ওপর যখন এরা হাঁটে তখন লেজটা ঝুলে মাটি ছুঁয়ে থাকে। চঞ্চু ও দুটো পায়ের রঙ কালচে-ধূসর। পায়ের নখর বাঁকা ও তীক্ষ্ণ। পেছনের নখরটি তুলনায় বেশি লম্বা। এরা ওড়ার থেকে মাটিতে হেঁটে বেড়াতে বেশি পছন্দ করে। খাদ্যাভ্যাসে এরা মাংসাশী। শামুক, ঝিনুক, ফড়িং, শুঁয়োপোকা, কেঁচো, ইঁদুর, গিরগিটি, ছোটো সাপ, ব্যাঙ, পাখির ডিম, পাখির ছানা—নানা মেনু রয়েছে এদের খাবারের তালিকায়। বিভিন্ন ফল ও বীজও এরা খায়। কল্কে ফুলের বিষাক্ত ফল এরা যে খেতে পছন্দ করে তা আমার নিজের চোখেই দেখা। খাবারের সন্ধানে দিনভর পুকুরের পাড়ে, ঝোপে বা গাছের নীচের দিকের এ-ডালে ও-ডালে লাফালাফি করতে দেখা যায়। আর যদি কখনও ভয় পায় তখন দৌড়ে কাছাকাছি কোনও ঝোপের ভিতরে লুকিয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে সকালবেলা কুবোদের সূর্যস্নান করতে দেখা যায়। এই সময় ওরা দুটো ডানাকে ছড়িয়ে রোদের দিকে মেলে ধরে। এরা বেশ গভীর ও সুরেলা কন্ঠে কুপ্-কুপ্-কুপ্-কুপ্ করে ডাকে। সচরাচর এক-একবারে ৬/৭ বার কুপ্-কুপ্ শব্দ করে। তবে কখনও কখনও একটানা ২০ বার পর্যন্ত ডাকতে শোনা যায়। গরমের দিনে এদের ডাক বহুদূর থেকে শোনা যায়। কখনও কখনও একটা কুবো ডেকে উঠলে কাছাকাছি থাকা আর একটা কুবো ডাকে ওঠে। তখন দ্বৈত কুবো-সঙ্গীতে মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক।
(বাঁদিকে) পুকুরপাড়ে খাবারের খোঁজে কুবো। ছবি: লেখক। (ডান দিকে) বাসা নির্মাণরত কুবো। ছবি: সংগৃহীত।
আগেই বলেছি, দক্ষিণ ভারতে কুবো পাখিকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। সকালবেলা দক্ষিণ দিক থেকে কুবোর ডাক শুনে কেউ যদি কাজে বেরোয় তার কাজে সাফল্য আসবে বলে অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে। ভাগবত পুরাণে কথিত যে কাহিনিটি এই নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করেছি সম্ভবত তা থেকেই এমন বিশ্বাসের ভিত্তি। প্রাচীনকালে কোনও কোনও এলাকায় লৌকিক চিকিৎসায় কুবোর মাংস ব্যবহৃত হত। যক্ষ্মা ও ফুসফুসের কিছু রোগে কুবোর মাংস খেলে নাকি রোগের উপশম হত। ইউরোপে কুবো পাখি পাওয়া যায় না বলে পরাধীন ভারতে ইংল্যান্ড থেকে আসা কর্মচারী ও সৈনিকরা কুবো পাখি দেখে মুরগির এক জাত বলে মনে করত। আর তাই তারা মাংসের জন্য কুবো পাখিদের গুলি করে মারত। কিন্তু এর স্বাদ খুব খারাপ হওয়ায় তারা কুবোর আর এক নাম দেয় ‘গ্রিফের মুরগি’ (Griff’s Pheasant) ।
যদিও কুবো ভারতের সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত পাখি, তবুও আমাদের দেশে কুবো পাখিদের অস্তিত্বের সংকট হয়েছে বলে খবর নেই। আই.ইউ.সি.এন. এদের ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করেছে। ভারতের সংরক্ষণ আইনে কুবোর স্থান রয়েছে চতুর্থ শিডিউলে। আমাদের সুন্দরবন এলাকাতেও যথেষ্ট পরিমাণে কুবো দেখা যায়। তবে সর্বত্র যেভাবে জলাভূমি ভরাট ও বৃক্ষচ্ছেদন চলছে তাতে কুবোদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় হয়। ওরা মানুষের সৌভাগ্য আনুক বা না-আনুক ক্ষতি নেই, ওদের ভাগ্যে যেন আঁধার না নেমে আসে সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।—চলবে।
যদিও কুবো ভারতের সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত পাখি, তবুও আমাদের দেশে কুবো পাখিদের অস্তিত্বের সংকট হয়েছে বলে খবর নেই। আই.ইউ.সি.এন. এদের ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করেছে। ভারতের সংরক্ষণ আইনে কুবোর স্থান রয়েছে চতুর্থ শিডিউলে। আমাদের সুন্দরবন এলাকাতেও যথেষ্ট পরিমাণে কুবো দেখা যায়। তবে সর্বত্র যেভাবে জলাভূমি ভরাট ও বৃক্ষচ্ছেদন চলছে তাতে কুবোদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় হয়। ওরা মানুষের সৌভাগ্য আনুক বা না-আনুক ক্ষতি নেই, ওদের ভাগ্যে যেন আঁধার না নেমে আসে সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।