(বাঁদিকে) সাদা গলা মাছরাঙা। ছবি: সংগৃহীত। (ডান দিকে) পুকুরে শিকারের অপেক্ষায় সাদা গলা মাছরাঙা। ছবি: লেখক।
তারপর বারবার ফিরে এসে দৃশ্যে উজ্জ্বল।”—জীবনানন্দ দাশ (অন্য প্রেমিককে)
আমাদের গ্রামের বাড়িতে ছিল দুটো পুকুর। বড় পুকুরটা ছিল পশ্চিমে বাড়ি লাগোয়া। ওই পুকুরের পশ্চিম পাড়ে ছিল মস্ত বাঁশ বাগান। বাকি তিন পাড়ে ছিল অনেক নারকেল গাছ। উত্তর পাড়ে নারকেল গাছের সাথে ছিল একটা সবেদা ও দুটো পেয়ারা গাছ। পুকুরের পুবে ছিল আমাদের কাঠের ঘাট। ঘাটের বাঁপাশে ছিল একটা কুল, একটা জবা আর একটা আম গাছ। ঘাটের ডানদিকে ছিল একটা মস্ত সজনে গাছ। কুল গাছের একটা বড় ডাল আর প্রায় পুরো সজনে গাছটাই পুকুরের দিকে হেলে ছিল। ছুটির দিনে দুপুরবেলা আমার নেশা ছিল ঘাটে বসে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা। তবে মাঝে মাঝে ফাৎনার ওপর থেকে নজর সরে গিয়ে চোখ চলে যেত পেয়ারা, সবেদা, কুল বা সজনে গাছে দিকে। পুকুরের ওপর ঝুলে পড়া ডালে নিবিষ্টচিত্তে বসে থাকত মাছরাঙা।
মাছ ধরায় আমার একাগ্রতার ঘাটতি থাকায় ওদের একাগ্রতা ভালোভাবে লক্ষ্য করতে পারতাম। চুপচাপ বসে আছে ডালে, যেন কিচ্ছুটি জানে না। হঠাৎ বিদ্যুতের ক্ষিপ্রতায় জলে ঝাঁপ। পরক্ষণেই দু’ঠোঁটের ফাঁকে মাছ ধরে নিজের জায়গায় ফিরে আসা। তারপর মাথাটাকে একটু ঝাঁকিয়ে মাছটাকে উদরস্থ করা। তারপর একটু গা ঝাড়া দিয়ে পালকে লেগে থাকা জল ঝেড়ে ফেলা। তারপর আবার শিকারে মনোযোগ। পেট ভরে গেলে ফুরুৎ। কখনও কখনও ডালে বসে তিন-চার সেকেন্ড ধরে চে-চে-চে-চে-চিউ চে-চে-চে-চে-চিউ ডাক। তারপর ফুরুৎ। আহা, কী রঙের ছটা মাছরাঙার! চোখ জুড়ানো, মন মাতানো বাহারি রং। আমি আমাদের পুকুরপাড়ে দু’রকমের মাছরাঙা দেখতাম। বেশি দেখতাম সাদা গলা মাছরাঙা। এর সাইজ কিছুটা বড়, প্রায় শালিক পাখির মতো। ছোট সাইজের আর একটা মাছরাঙা দেখতাম, তবে বেশ কম। বাবার কাছে নাম জেনেছিলাম এর – পাতি মাছরাঙা। এদের পিঠ তুঁতেরঙা। পেটের রঙ কমলা।
সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৯০ প্রজাতির মাছরাঙা পাওয়া গেলেও এদের মধ্যে ১২টি প্রজাতির দেখা মেলে ভারতে। আর পশ্চিমবঙ্গে চারটি প্রজাতি দেখা যায় — (১) সাদা গলা মাছরাঙা (White Throated Kingfisher) — Halcyon smyrnensis, (২) পাতি বা ফটকা মাছরাঙা (Pied Kingfisher) — Ceryle rudis, (৩) ছোটন মাছরাঙা (Common Kingfisher) – Alcedo atthis এবং (৪) মাছ ঘোরেল — (Stork-billed Kingfisher) — Halcyon capensis.
প্রথম দু’টি প্রজাতি আমার খুব পরিচিত। ছোট মাছরাঙা আমার নজরে আগে বেশি পড়লেও ইদানিং তেমন চোখে পড়েনি। তবে মাছ ঘোরেল প্রায়ই আমাদের এলাকায় দেখতে পাই। আর দেখতে না পেলেও এর তারস্বরে ডাক প্রতিদিনই শুনতে পাই। এর অর্থ সুন্দরবনের বসতি এলাকায় তিনটি জাতের মাছরাঙা এখনও বেশ দেখা যায়।
প্রথমে সাদা-গলা মাছরাঙার কথা বলি। আমি ছোট থেকে এখন পর্যন্ত এই মাছরাঙাটিকে প্রায়শই দেখতে পাই। এর গণ (Genus) Halcyon নামের পেছনে এক আকর্ষণীয় কাহিনি আছে। কাহিনিটা বলি। গ্রিক পুরাণমতে হ্যালসিওন হল মাছরাঙারূপী এক দেবী। তাঁর বাবা ইওলাস হলেন বাতাসের শাসক। তাঁর কাজ হল তাঁর উর্ধ্বতন দেবতাদের নির্দেশ মতো গুহার মধ্যে বন্দি করে রাখা বাতাসকে মুক্ত করা। হ্যালসিওন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল মৃত্যুর দেবতা সিয়েক্সকে। হ্যালসিওন ও সিয়েক্স পরষ্পরকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন।
প্রথম দু’টি প্রজাতি আমার খুব পরিচিত। ছোট মাছরাঙা আমার নজরে আগে বেশি পড়লেও ইদানিং তেমন চোখে পড়েনি। তবে মাছ ঘোরেল প্রায়ই আমাদের এলাকায় দেখতে পাই। আর দেখতে না পেলেও এর তারস্বরে ডাক প্রতিদিনই শুনতে পাই। এর অর্থ সুন্দরবনের বসতি এলাকায় তিনটি জাতের মাছরাঙা এখনও বেশ দেখা যায়।
প্রথমে সাদা-গলা মাছরাঙার কথা বলি। আমি ছোট থেকে এখন পর্যন্ত এই মাছরাঙাটিকে প্রায়শই দেখতে পাই। এর গণ (Genus) Halcyon নামের পেছনে এক আকর্ষণীয় কাহিনি আছে। কাহিনিটা বলি। গ্রিক পুরাণমতে হ্যালসিওন হল মাছরাঙারূপী এক দেবী। তাঁর বাবা ইওলাস হলেন বাতাসের শাসক। তাঁর কাজ হল তাঁর উর্ধ্বতন দেবতাদের নির্দেশ মতো গুহার মধ্যে বন্দি করে রাখা বাতাসকে মুক্ত করা। হ্যালসিওন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল মৃত্যুর দেবতা সিয়েক্সকে। হ্যালসিওন ও সিয়েক্স পরষ্পরকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৪: সুন্দরবনের পাখি—বাঁশপাতি
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী
একদিন সিয়েক্স নৌকোয় করে সমুদ্রে বেড়াবেন বলে স্থির করলেন। হ্যালসিওন সমুদ্রকে খুব ভয় পেতেন। তিনি সিয়েক্সকে বারবার বারণ করলেন সমুদ্রে যেতে। কিন্তু সিয়েক্স কথা শুনলেন না। হ্যালসিওন যা ভয় পেয়েছিলেন ঠিক তাই হল। প্রচণ্ড ঝড়ে সিয়েক্সের নৌকা ডুবে গেল। সিয়েক্সের মৃত্যু হল। এদিকে হ্যালসিওন তাঁর স্বামীর নৌযাত্রা যাতে নিরাপদ হয় সেজন্য বিবাহের দেবী হেরা-কে অনুরোধ করলেন। হেরা ইতোমধ্যে জেনে গিয়েছিলেন যে সিয়েক্সের মৃত্যু হয়েছে। তাই তিনি স্বপ্নের দেবতা মরফিউসকে অনুরোধ করলেন যাতে নৌকাডুবিতে সিয়েক্সের মৃত্যুর পুরো ঘটনা হ্যালসিওনের স্বপ্নে ধরা দেয়। হ্যালসিওন স্বপ্নে সব জানতে পেরে সমুদ্রতীরে দৌড়োলেন। সমুদ্রতীরে তাঁর স্বামীর দেহ জলে ভাসতে দেখে তিনি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না, সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন। দেবতারা গভীর প্রেমের এই দৃশ্য দেখে খুব বিচলিত হলেন এবং হ্যালসিওনকে বাঁচিয়ে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সেইমতো তাঁরা হ্যালসিওনকে মাছরাঙা পাখিতে রূপান্তরিত করে বাঁচিয়ে রাখলেন।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৯: আলোকলতা তিলোত্তমারা যুগে যুগে পুরুষের উজ্জীবনী শক্তির আধার
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৬: হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে
সাদা-গলা মাছরাঙার পিঠ, ডানা ঙ্গেবং লেজের রং উজ্জ্বল নীল। মাথা, ঘাড় এবং পেটের পেছেনদিকের রং খয়েরি। গলা আর পেটের সামনের অংশের রং সাদা। লম্বা চঞ্চু আর পায়ের রং লাল। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, তুরস্ক, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশে এদের প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে এদের যে উপপ্রজাতি পাওয়া যায় সেটি হল ‘fusca’। সুন্দরবন অঞ্চলে মাছরাঙাদের মধ্যে এদেরই দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। এরা লম্বায় প্রায় ২৮ সেমি। এদের প্রধান খাবার মাছ হলেও প্রয়োজনে কাঁকড়া, চিংড়ি, সাপ, ব্যাঙ, কেঁচো, পোকামাকড় ইত্যাদিও শিকার করে। প্রাকবর্ষা হল এদের প্রজনন ঋতু। এইসময় স্ত্রী ও পুরুষ পাখি জোড় বেঁধে বাসা তৈরির কাজে মন দেয়। জলাশয়ের পাড়ে দুজনে মিলে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। যে সব পুকুরের পাড় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো সেখানে ওদের বাসা তৈরি করা সম্ভব হয় না। বাসা প্রায় ৫০ সেমি লম্বা হয়, আর গর্তের শেষ প্রান্তটা অনেকটা প্রসারিত হয়। এখানেই স্ত্রী মাছরাঙা একসাথে ৩-৭টি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। এদের বাসার ভেতরটা ভীষণ নোংরা। মল, খাবারের অবশিষ্টাংশ, মাছের কাঁটা ইত্যাদি ছড়ানো থাকে। মা ও বাবা মাছরাঙা উভয়ে পালা করে ডিমে তা দেয়। ২০-২২ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয়। বাচ্চাদের খাওয়ানোর দায়িত্বও উভয়ে ভাগ করে নেয়। সাধারণত ১৯ দিনের মধ্যে বাচ্চারা উড়তে সক্ষম হয়। সাদা-গলা মাছরাঙা সাধারণত ৫ বছর বাঁচে।
(বাঁদিকে) মাছ ঘোরেল। (ডান দিকে) ছোট মাছরাঙা। ছবি: সংগৃহীত।
ছোট মাছরাঙারা আকারে সত্যিই বেশ ছোটো, অনেকটা চড়াই পাখির সাইজ। এরা প্রায় ১৬ সেমি লম্বা। তবে চেহারা গোলগাল। এদের মাথাও অন্য জাতের মাছরাঙাদের মতো শরীরের তুলনায় বড়ো। কিন্তু লেজটা বেশ ছোট। মাথা, পিঠ, ডানা ও লেজের ওপরের রঙ তুঁতে-নীল। তার ওপর মাথা ও ডানার প্রান্তে গাঢ় নীল ফুটকি। চঞ্চুর নীচ, চোখের পেছেন, পুরো বুক ও পেট এবং লেজের তলার রং উজ্জ্বল কমলা। গলা ও ঘাড় সাদা। এদের চঞ্চুর রং ধূসর এবং পা এবং পায়ের পাতার রঙ লাল। রঙের এইরকম সমাহার ও বিন্যাস ছোট মাছরাঙাকে অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। পুকুরপাড়ে গাছের ডালে বসে এরা মাথাটাকে বারেবারে এদিক-ওদিক ঘোরায়। এরা বেশ দ্রুতবেগে উড়তে পারে। সাদা-গলা মাছরাঙাদের মতোই এদের খাদ্যাভ্যাস ও বাসা। শরৎকাল এদের প্রজনন ঋতু। স্ত্রী ছোট মাছরাঙা একসাথে ৫-৭টি ডিম পাড়ে। মা ও বাবা মাছরাঙা দিনের বেলায় পালা করে ডিমে তা দিলেও রাতে কেবল মা তা দেয়। ১৯-২০ দিন পর ডিম থেকে বাচ্চারা বেরোয়। তারপর আরও ২৪/২৫ দিন এরা বাসায় থাকে।
আরও পড়ুন:
বল বীর, চির উন্নত মম শির!
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৮: শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিলেন দ্বারকানাথ
মাছ ঘোরেল আমার নজরে এসেছে অনেকবার। প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনের বসতি এলাকা জুড়ে এদের যথেষ্ট দেখা যায়। আমাদের বাড়ির সামনে একটা খাল ছিল। তখন ওই খালে জোয়ার-ভাঁটা খেলত। খালটা বেশ চওড়া ও গভীর ছিল। খড় বোঝাই নৌকো চলাচল করত জোয়ারের সময়। ওই খালের দু’পাশে তখন ছিল বেশ ঘন ম্যানগ্রোভ গাছগাছালি। খালের ওপর ঝুঁকে পড়া ডালে পাতার ফাঁকে কোথায় যে ওরা বসে থাকত নজরে পড়ত না। কিন্তু ঝাঁপ দিয়ে জলে পড়লেই বোঝা যেত ওদের উপস্থিতি। পাতার ফাঁক দিয়ে ওদের অনেকবার দেখেছি। বাবার মুখেও শুনেছি, আমাদের পুকুরের পশ্চিম পাড়ে বাঁশবাগানের সঙ্গে যে কয়েৎবেলের গাছটা ছিল তার গোড়ায় একটা গর্তে মাছ ঘোরেলের বাসা ছিল। বাবা কয়েকবার ওদের ওই গর্তে ঢুকতে ও গর্ত থেকে বেরোতে দেখেছে।
বর্তমানে ওদের প্রায়শই বড় গাছে পাতার আড়ালে বসে থাকতে বা উড়ে যেতে দেখি। মাছ ঘোরেল বেশ বড়ো চেহারার মাছরাঙা, লম্বায় প্রায় ১৩/১৪ ইঞ্চি। পিঠের রঙ সবজে-নীল। দুটো ডানা আর লেজের রঙ ঘন নীল। মাথাটা খয়েরি। আর ঘাড়, গলা, পেট ও লেজের তলা ইঁট-রঙা। চঞ্চু ও পা গাঢ় লাল। খাবার-দাবারের অভ্যেস অন্য মাছরাঙাদের মতোই। তবে এরা হ্রদ, নদী বা খালের তীরে মাটিতে গর্ত করে বা মৃত গাছে কোটর তৈরি করে বা পরিত্যক্ত উইয়ের ঢিবিতে বাসা বানায়। স্ত্রী মাছ ঘোরেল একসাথে ২-৫ টি চকচকে সাদা ডিম পাড়ে। ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া সহ দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় নদী বা হ্রদ সংলগ্ন ঘন জঙ্গলে এদের বেশি পাওয়া যায়। আমার সেই গ্রামের বাড়ি আজ আর যেমন নেই, তেমনই খালের দু’পাশে ম্যানগ্রোভ অরণ্য জনারন্যে উধাও। আর সেই খাল এখন মজে যাওয়া একটা সরু নালা-মাত্র। আর তাই মাছ ঘোরেল ওই এলাকার মতো আরও অনেক এলাকা থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। তবে যেখানে নদী বা খাল কাছাকাছি আছে সেখানে এদের উপস্থিতি আছে। আর সেই উপস্থিতি তার অতি জোরালো শব্দে জানান দেয়।
বর্তমানে ওদের প্রায়শই বড় গাছে পাতার আড়ালে বসে থাকতে বা উড়ে যেতে দেখি। মাছ ঘোরেল বেশ বড়ো চেহারার মাছরাঙা, লম্বায় প্রায় ১৩/১৪ ইঞ্চি। পিঠের রঙ সবজে-নীল। দুটো ডানা আর লেজের রঙ ঘন নীল। মাথাটা খয়েরি। আর ঘাড়, গলা, পেট ও লেজের তলা ইঁট-রঙা। চঞ্চু ও পা গাঢ় লাল। খাবার-দাবারের অভ্যেস অন্য মাছরাঙাদের মতোই। তবে এরা হ্রদ, নদী বা খালের তীরে মাটিতে গর্ত করে বা মৃত গাছে কোটর তৈরি করে বা পরিত্যক্ত উইয়ের ঢিবিতে বাসা বানায়। স্ত্রী মাছ ঘোরেল একসাথে ২-৫ টি চকচকে সাদা ডিম পাড়ে। ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া সহ দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় নদী বা হ্রদ সংলগ্ন ঘন জঙ্গলে এদের বেশি পাওয়া যায়। আমার সেই গ্রামের বাড়ি আজ আর যেমন নেই, তেমনই খালের দু’পাশে ম্যানগ্রোভ অরণ্য জনারন্যে উধাও। আর সেই খাল এখন মজে যাওয়া একটা সরু নালা-মাত্র। আর তাই মাছ ঘোরেল ওই এলাকার মতো আরও অনেক এলাকা থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। তবে যেখানে নদী বা খাল কাছাকাছি আছে সেখানে এদের উপস্থিতি আছে। আর সেই উপস্থিতি তার অতি জোরালো শব্দে জানান দেয়।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১২: ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড ও মিডলটন মারে, এক ভালোবাসাহীন বিবাহ
শেষে যে মাছরাঙার কথা বলব তা আমি সুন্দরবন এলাকায় কোনওদিন দেখিনি। তবে বন্ধুদের ক্যামেরায় তোলা ছবিতে দেখেছি। তাঁদের চোখ দিয়েই পাতি বা ফটকা মাছরাঙাকে আমার দেখা। এরা লম্বায় প্রায় ৩১ সেমি, অর্থাৎ প্রায় ঘুঘু পাখির মতো। রূপের নিরিখে বাকি তিনটে জাতের মাছরাঙার থেকে এরা অনেকটাই আলাদা। এদের মাথা, ডানা, পিঠ ও লেজের পালক সাদা ও কালো ফোঁটাযুক্ত। কোথাও কোথাও সাদা-কালো ডোরা দাগ আছে। এদের স্ত্রী ও পুরুষ চেনা যায় গলায় মালার মতো বেষ্টন করে থাকা কালো ডোরা দাগ দেখে। পুরুষের গলায় দুটো, আর স্ত্রী ফটকার গলায় একটা দাগ থাকে। তাও সেই দাগের মাঝে সামান্য ভাঙা থাকে। তবে এদের মাথায় রয়েছে একটা ঝুঁটি যা অন্য কোনও মাছরাঙার নেই। ঝুঁটির দু’পাশ এবং গলা ও পেটের রঙ সাদা। নদী, খাল, হ্রদ বা জলাশয়ের পাড়ে গাছের ডালে বসে প্রায়শই এদের লেজ ও মাথা দোলাতে দেখা যায়। উড়তে উড়তে এরা চিরাঁক-চিরাঁক করে ডাকে। এদের শিকার ধরার পদ্ধতিও বেশ অদ্ভুত। জলের ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে জলের মধ্যে শিকার দেখতে পেলে দেহটিকে খাড়া করে শূন্যে একেবারে স্থির হয়ে যায়। কেবল দুটো ডানা আর লেজ সঞ্চালিত হতে থাকে। তারপর শিকার নাগালে চলে এলে ৬-৮ মিটার উপর থেকে তীরবেগে সোজা ঝাঁপ দেয় জলে। জল থেকে উঠে এসে গা ঝাড়া দিয়ে গাছের ডালে বসে। তারপর শিকারটিকে আঘাত করে মেরে ফেলে মাথার দিক দিয়ে গিলে নেয়। এদের বাসার ধরণ, স্থান, প্রজনন ও সন্তান পালন অন্যান্য মাছরাঙাদের মতোই। প্রায় পুরো দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে এদের দেখা মেলে।
(বাঁদিকে) মাছরাঙার মাছ শিকার। (ডান দিকে) ফটকা মাছরাঙা। ছবি: সংগৃহীত।
মাছরাঙাদের নানা কান্ডকারখানার মধ্যে আমার মনে সবচেয়ে বিস্ময় জাগায় যে ব্যাপারটি তা হল —এরা জলের ওপর থেকে যে শিকারকে জলের মধ্যে দেখে, জলের মধ্যে গিয়ে তা দেখতে পায় কি করে? আমরা জানি বায়ু মাধ্যম ও জলের প্রতিসরাঙ্ক এক নয়। কঠিন এই সমস্যার মোকাবিলা করেছে মাছরাঙারা অতি সহজে। আমাদের চোখে লেন্সের পেছনদিকে রেটিনায় ফোভিয়া বা পীতবিন্দু নামে একটা অংশ আছে যেখানে দৃষ্টি-গ্রাহক কোশের (Photo receptor cells) ভিড় সবচেয়ে বেশি। এই ফোভিয়া কোনও বস্তুকে স্পষ্টভাবে দেখতে সাহায্য করে। মাছরাঙার চোকের রেটিনাতে কিন্তু দুটো ফোভিয়া থাকে। প্রথমটি থাকে নাকের কাছাকাছি অঞ্চলে।
এই ফোভিয়া জলের মধ্যে প্রবেশ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত শিকারকে দেখতে সাহায্য করে। জলে প্রবেশ করলেই মাছ আত্মরক্ষার জন্য তার অভিমুখ বদলায়। তখন কাজ শুরু করে দ্বিতীয় ফোভিয়া। এর সাহায্যে মাছরাঙা জলের ভেতরে সহজেই শিকারকে চিহ্নিত করতে পারে।
যে রূপসী মাছরাঙা সাধারণ মানুষ থেকে পক্ষিবিজ্ঞানীদের কাছে এতটাই আগ্রহের পাখি তাকে কিন্তু কোনও দেশই জাতীয় পাখির মর্যাদা দেয়নি। অবশ্য তাতে মাছরাঙাদের কোনও অভিমান নেই! মধ্য ও দক্ষিণ প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে (পলিনেশিয়া) বসবাসকারী অধিবাসীরা সামুদ্রিক ঢেউ ও ঝড় থেকে রক্ষা পেতে স্থানীয় এক প্রজাতির মাছরাঙাকে (Todiramphus sanctus) দেবতাজ্ঞানে পূজা করে। প্রাচীন বোর্ণিও সংস্কৃতিতে মাছরাঙাকে পয়া বা অপয়া হিসেবে বিবেচনা করা হত। গ্রিক পুরাণেও মাছরাঙাকে দেব-দেবীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাছরাঙারা কিন্তু নিশ্চিন্তে নেই।
দিন দিন জলাশয়ের পরিমাণ যত কমছে, আর কৃষিকাজে যতই রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে ততই বিপন্ন হয়ে পড়ছে মাছরাঙা। জলাশয়ের পাড় বাঁধিয়ে ফেলাও প্রভাব ফেলছে ওদের জীবনযাত্রায়। সুদৃশ্য পালকের জন্য সারা পৃথিবী জুড়ে একসময় দেদার হত্যা করা হয়েছে মাছরাঙা। কিছুদিন আগেই সুন্দরবন অঞ্চলে এক চোরাশিকারীর কাছ থেকে বনবিভাগের কর্তারা বিপুল পরিমাণ মৃত মাছরাঙা উদ্ধার করেছেন। অনেকে মাছরাঙা স্টাফ করে শো-কেসে সাজিয়েও রাখত। ইতিমধ্যে গুয়াম মাছরাঙা (Todiramphus cinnamominus) নামে একটা প্রজাতি বিলুপ্ত। আরও প্রায় ৩০টি প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে। আমাদের রাজ্যের চারটি প্রজাতি এবং এদের মধ্যে সুন্দরবনে তিনটি এখনও বিপন্ন না হলেও যেভাবে জলাশয় বুজিয়ে বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে তাতে ওদের বিপন্ন হতে আর কতক্ষন?
এই ফোভিয়া জলের মধ্যে প্রবেশ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত শিকারকে দেখতে সাহায্য করে। জলে প্রবেশ করলেই মাছ আত্মরক্ষার জন্য তার অভিমুখ বদলায়। তখন কাজ শুরু করে দ্বিতীয় ফোভিয়া। এর সাহায্যে মাছরাঙা জলের ভেতরে সহজেই শিকারকে চিহ্নিত করতে পারে।
যে রূপসী মাছরাঙা সাধারণ মানুষ থেকে পক্ষিবিজ্ঞানীদের কাছে এতটাই আগ্রহের পাখি তাকে কিন্তু কোনও দেশই জাতীয় পাখির মর্যাদা দেয়নি। অবশ্য তাতে মাছরাঙাদের কোনও অভিমান নেই! মধ্য ও দক্ষিণ প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে (পলিনেশিয়া) বসবাসকারী অধিবাসীরা সামুদ্রিক ঢেউ ও ঝড় থেকে রক্ষা পেতে স্থানীয় এক প্রজাতির মাছরাঙাকে (Todiramphus sanctus) দেবতাজ্ঞানে পূজা করে। প্রাচীন বোর্ণিও সংস্কৃতিতে মাছরাঙাকে পয়া বা অপয়া হিসেবে বিবেচনা করা হত। গ্রিক পুরাণেও মাছরাঙাকে দেব-দেবীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাছরাঙারা কিন্তু নিশ্চিন্তে নেই।
দিন দিন জলাশয়ের পরিমাণ যত কমছে, আর কৃষিকাজে যতই রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে ততই বিপন্ন হয়ে পড়ছে মাছরাঙা। জলাশয়ের পাড় বাঁধিয়ে ফেলাও প্রভাব ফেলছে ওদের জীবনযাত্রায়। সুদৃশ্য পালকের জন্য সারা পৃথিবী জুড়ে একসময় দেদার হত্যা করা হয়েছে মাছরাঙা। কিছুদিন আগেই সুন্দরবন অঞ্চলে এক চোরাশিকারীর কাছ থেকে বনবিভাগের কর্তারা বিপুল পরিমাণ মৃত মাছরাঙা উদ্ধার করেছেন। অনেকে মাছরাঙা স্টাফ করে শো-কেসে সাজিয়েও রাখত। ইতিমধ্যে গুয়াম মাছরাঙা (Todiramphus cinnamominus) নামে একটা প্রজাতি বিলুপ্ত। আরও প্রায় ৩০টি প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে। আমাদের রাজ্যের চারটি প্রজাতি এবং এদের মধ্যে সুন্দরবনে তিনটি এখনও বিপন্ন না হলেও যেভাবে জলাশয় বুজিয়ে বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে তাতে ওদের বিপন্ন হতে আর কতক্ষন?
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।