বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


ঝিলের উপর তারে বসে বাঁশপাতি। ছবি: লেখক।

চোদ্দো-পনেরো বছর আগেকার কথা। সময়টা জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ হবে। পড়ন্ত বিকেল। শিরশিরানো উত্তুরে হাওয়া। আমি স্কুলে আমার ল্যাবরেটরিতে টুকটাক কাজ করছিলাম। আমাদের এই ল্যাবরেটরিটা পুবদিকের ভবন অর্থাৎ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ভবনের দোতলায়। জানালার পাশেই ছাদ সমান উঁচু নারকেল গাছ, আর তার কয়েক হাত দূরেই একটা পুরনো গেঁওয়া গাছ। নিচেই স্কুলের বড় ঝিল। অতীতে এটা ছিল একটি খাল যা অধুনা লুপ্তপ্রায় ঘিয়াবতী নদীর সাথে যুক্ত ছিল। ষাট-সত্তর বছর আগে জোয়ার-ভাটা খেলত, এমনকি নৌকোও চলত। এখন এটি একটি বদ্ধ জলাশয়।
যেহেতু এটি সুন্দরবন এলাকার মধ্যে এবং একসময় নোনা জলের জোয়ার-ভাটা খেলত তাই এখন মিষ্টি জলের জলাশয়ে রূপান্তরিত হলেও অতীতের গেঁওয়া ও হরগোজা গাছ প্রচুর জন্মে রয়েছে এই ঝিলের ধারে। এই ঝিলের মালিকানা এখন আমাদের স্কুলের হাতে। স্বচ্ছ জল। মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো কচুরিপানার দল। জলে নানা ধরনের যথেষ্ট মাছ আছে। মাঝে মাঝে বেশ লাফায়। পানকৌড়িকে দল বেঁধে ডুব দিতে দেখি। গেঁওয়া গাছ থেকে তীরবেগে জলে ঝাঁপ দিয়ে মাছরাঙাকে মাছ ধরতেও দেখি। ঝিলের দুই ধারে কোঁচ বকদের যথেষ্ট আনাগোনা। কচুরিপানার উপর ও ঝিলের পাড়ে ডাহুক পাখি আর জলপিপিদের আনাগোনাও নজরে পড়ে। কিন্তু সেদিন হঠাৎই নজরে এল তিনটে সবুজ রঙা ছোট পাখি ঝিলের ওপর দিয়ে টাঙানো টেলিফোনের তারের উপর বসে আছে। ২৫/৩০ সেকেন্ড পর পরই ওদের মধ্যে এক একটা পাখি সামান্য একটু উড়ে গিয়ে এক পাক খেয়ে ফের তারের উপর বসছিল। ভারী অদ্ভুত লাগছিল ওদের ভঙ্গিটা। এই পাখিগুলোকে আগেও দেখেছি।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮২: সুন্দরবনের পাখি—টিয়া

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী

ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির সামনে খালের পাড়ে শুয়ে পড়া বাবলা গাছের ডালে আর বড় পুকুরপাড়ে ঝুঁকে পড়া বাঁশ গাছে এই পাখিগুলোকে মাঝে মাঝেই বসে থাকতে দেখেছি। বাস রাস্তার ধারে টেলিগ্রাফ তারের উপরও বসে থাকতে দেখেছি। কিন্তু পরবর্তীকালে আর নজরে পড়েনি। ফলে এদের স্মৃতিও হারিয়ে গিয়েছিল আমার মন থেকে। বহুদিন পর আবার এদের দেখতে পেয়ে শৈশব-স্মৃতি মনে ভেসে উঠল। ঠিক এইভাবেই ওই পাখিগুলোকে ছোটবেলায় ওড়াউড়ি করতে দেখেছি। যা বলছিলাম, কয়েক মিনিট পর দেখি কোথা থেকে আরও একটা এসে ওদের দলে যোগ দিল। তারপর আবার সে কিছুটা উড়ে গিয়ে গোঁত্তা খেয়ে ফের ফিরে এল নিজের জায়গায়। ওড়ার কায়দা সত্যিই অনন্য।

শিকার মুখে বাঁশপাতি। ছবি: সংগৃহীত।

কী করছে ওরা? সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়ায় বিল্ডিং ও গাছের লম্বা ছায়া পড়েছে ঝিলের ওপর। পাখিগুলোকে তাই খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে পারছিলাম না। ওরা ভয় পেল, নাকি বসে বসে কোনও মতলব আঁটল বুঝলাম না। হঠাৎ চারটে পাখি ‘ট্রি ট্রি ট্রি ট্রি’ শব্দ করে ফুরুত করে একসাথে উড়ে পালাল। কোথায় কে জানে! বাড়ি ফিরে মনে মনে ভাবলাম পরের দিন একটু আগেভাগে স্কুলে যাব। সকালে ঝিলে রোদ এসে পড়ে। যদি পাখিগুলো আসে তো স্পষ্ট দেখা যাবে। বাইনোকুলার আর ক্যামেরাটাও ব্যাগে গুছিয়ে রাখলাম পাছে ভুলে যাই।

পরদিন প্রায় আধঘন্টা আগে পৌঁছে গেলাম স্কুলে। তড়িঘড়ি ল্যাবে ঢুকে জানালা খুলে দেখি সেই সবুজরঙা পাখিগুলো একটাও নেই। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। তাহলে কি ওরা সকালে আসে না? দেখাই যাক না কখন আসে বা আদৌ আসে কিনা। খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। তবে ৭/৮ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হল না। কোথা থেকে দুটো সেই সবুজ-সুন্দরী পাখি উড়ে এসে তারের ওপর বসল। তারপর সেই একই ভঙ্গিতে বাতাসে ঝাঁপ দিয়ে গোঁত্তা খেয়ে ফিরে আসা। চোখে চটপট বাইনোকুলার লাগালাম। ছোটবেলায় অনেক দূর থেকে দেখেছি। তাই ভালো করে এই পাখির রূপ, সৌন্দর্য বুঝতে পারিনি। বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে এখন স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আহা! যা দেখলাম তা জন্ম জন্মান্তরেও ভুলব না।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৮: রামানুজ ভরত ও লক্ষ্মণ, আনুগত্যের প্রকাশে দু’জনেই অনন্য

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১২: দর্দরজাতক

পাখিগুলোর মাথাটা সোনালি-বাদামি রঙ হলেও সারা পিঠ, ডানা, বুক, পেট ও লেজ কচি দুর্বা ঘাসের মতো সবুজ। গলার নিচের দিকে টিয়া পাখির গলার মতো একটা কালো দাগ, যেন হার পরে আছে। গলা, গাল আর ঠোঁটের নিচে হালকা নীল রঙের ছোঁয়া। ডানার বড় পালকগুলো যেন গাঢ় সবুজ, আর তার শেষ প্রান্তে কালো ফুটকি। ঘাড়ের পালকের রঙ হলদেটে সবুজ, আর পায়ুর কাছে ফ্যাকাশে সবুজ। তবে ওদের আকর্ষণীয় করে তুলেছে চোখ। ঠোঁটের দু’পাশ থেকে মোটা কালো রেখা গাঢ় লাল-রঙা চোখের উপর দিয়ে প্রায় গলা পর্যন্ত বিস্তৃত। ঠিক যেন কাজল টানা চোখ। আর ওদের লেজটাও ভারি অদ্ভুত। লেজের মাঝ বরাবর দুটো পালক সরু ও লম্বা হয়ে বেড়ে যায়। দেখলে মনে হয় যেন লেজে দুটো কাঠি গুঁজে রেখেছে। ওদের কালো ঠোঁট নিচের দিকে সামান্য বাঁকা। সরু লিকলিকে পা দুটোর রং গাঢ় ধূসর। দেহ লম্বায় প্রায় ৬-৭ ইঞ্চি বা ১৫-১৭ সেমি, আর লেজের কাঠি ধরলে আরও ২ ইঞ্চি বা ৫-৬ সেমি বেশি লম্বা।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৭: ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে মহর্ষি পেলেন চরম দুঃসংবাদ

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৬: ‘রাজর্ষি’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘বিসর্জন’ নাটক

খচাখচ কয়েকটা ছবি তুললাম। ওরা বুঝতেই পারল না। ছোটবেলায় এদের অনেক দেখেছি কিন্তু নামটা কিছুতেই মনে পড়ল না। স্মৃতি হাতড়াতে লাগলাম বেশ কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎই নামটা মনে পড়ল – বাঁশপাতি। গ্রামের বাড়িতে সেই যে পুকুরের ওপর নুয়ে পড়া বাঁশ গাছে বসে থাকতে দেখতাম তাই কি নাম বাঁশপাতি? মনে হয় বাঁশ পাতার মতো সরু ও সবুজ বলে এমন নাম হয়েছে। যাই হোক বাড়ি ফিরে বাঁশপাতিদের সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য জানার জন্য বইপত্র খুলে বসলাম।

বাঁশপাতি পাখির ইংরেজি নাম Green bee eater। বিজ্ঞানসম্মত নাম Merops orientalis। পৃথিবীর নানা দেশে এদের ২৬টি প্রজাতি ছড়িয়ে আছে। ভারতে পাওয়া যায় ছ’টি প্রজাতি। ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাতেও পাওয়া যায়। মূলত সমতলবাসী পাখি হলেও ১০০০ মিটার উঁচু অঞ্চলেও দেখা যায়। এদের মধ্যে পরিযায়ী স্বভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে। বর্ষার সময় যেমন এরা শুষ্কতর অঞ্চলে সরে যায় শীতের সময়ও উষ্ণতর অঞ্চলে চলে আসে। বুঝলাম কেন শীতকালে সুন্দরবন অঞ্চলে বাঁশপাতিদের আনাগোনা বেড়ে যায়।

গর্ত বাসার সামনে বাঁশপাতি। ছবি: সংগৃহীত।

ইংরেজি নাম শুনে মনে হতে পারে বাঁশপাতিদের খাদ্য বুঝি মৌমাছি। হ্যাঁ, মৌমাছি তো খায়ই, এছাড়াও মাছি, ফড়িং, মথ, প্রজাপতি, বোলতা, পিঁপড়ে, মাকড়সা, শুয়োপোকা ইত্যাদি ধরে খায়। তবে উড়ন্ত পতঙ্গই ওদের সবচেয়ে প্রিয়। মাটি বা জলের কিছু উপরে সরু ডাল, ঝুঁকে পড়া বাঁশ গাছ, টেলিগ্রাফ বা টেলিফোন বা ইলেকট্রিক তার ইত্যাদির উপর বসে আশপাশে উড়ন্ত পতঙ্গের দিকে নজর রাখে। দেখতে পেলেই উড়ে গিয়ে শিকার ধরে নিজের জায়গায় এসে বসে। তবে ওরা জ্যান্ত পোকা গিলে খায় না। বসার জায়গায় পোকাটাকে ঠুকে ঠুকে মেরে ফেলে তবেই খায়। আর পোকার যদি হুল থাকে তবে হুলটা বেছেই খায়, পাছে গলায় বিঁধে যায়। শক্ত বহিঃকঙ্কালযুক্ত শিকার হলে খাওয়ার আগে ওরা অনেকক্ষণ ঢোকাঠুকি করে বহিঃকঙ্কালটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ওড়ার সময় নাকি সুরে ‘ট্রি ট্রি ট্রি ট্রি’ শব্দ করে ডাকে। কখনও কখনও ‘টিট টিট টিট’ করেও ডাকে। সাধারণতঃ সকাল ও বিকালের দিকে ওরা বেশি শিকার ধরে। অন্য সময় ওরা অপেক্ষাকৃত উঁচু ডালে বসে ডানা ও পালক ছড়িয়ে রোদ পোহায় বা ডানা ঝাড়া দিয়ে গা পরিষ্কার করে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮১: ইষ্টদেবীরূপে মা সারদা

ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে বাঁশপাতি পুকুর, খাল বা নদীর পাড়ে কিংবা বালির ঢিপিতে মাটির সমান্তরাল ভাবে গর্ত করে তার মধ্যে বাসা বাঁধে। স্ত্রী ও পুরুষ বাঁশপাতি উভয়ে মিলেই বাসা বানায়। কখনও কখনও অন্যরাও সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। নখর আর ঠোঁট দিয়েই চলে গর্ত তৈরির কাজ। তবে ওরা এতই সাবধানী যে যদি দেখে কোনও মানুষ ওদের বাসা বানানো লক্ষ্য করছে ওরা অন্য জায়গায় গিয়ে বাসা বানায়। গর্ত লম্বায় হয় প্রায় পাঁচ ফুট। গর্তের শেষে ডিম পাড়ার জায়গাটা একটু বড় হয়। এখানে স্ত্রী বাঁশপাতি ৪-৮ ডিম পাড়ে। ডিম গুলো হয় ধবধবে সাদা, মসৃণ ও পুরোপুরি গোল। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই ডিমে পালা করে তা দেয়। যদিও বাইরে থেকে দেখে কোনটা স্ত্রী আর কোনটা পুরুষ চেনা খুব মুশকিল। ১৮ থেকে ২২ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয়। বাবা ও মা উভয়েই বাচ্চার লালন পালনের দায়িত্ব নেয়। তিন থেকে চার সপ্তাহ বাচ্চারা বাসার মধ্যেই থাকে। এরমধ্যে ওড়ার পালক গজিয়ে ওঠে। আর তার পরই গর্ত থেকে বেরিয়ে বাতাসে মেলে দেয় ডানা।

বাগানে খাবারের খোঁজে বাঁশপাতি ছবি: লেখক।

প্রকৃতির এই অপরূপ সুন্দর সৃষ্টি যারা দেখেনি তারা শুধু পড়ে বা ছবি দেখে বাঁশপাতির সৌন্দর্য ও স্বভাব সম্যক উপলব্ধি করতে পারবে না। শহরাঞ্চলে এদের দেখা যায় না। বন্যপ্রাণ ও পরিবেশ সংস্থাদের মতে বাঁশপাতি পাখিরা আপাতত কোনও সংকটে নেই। কিন্তু সুন্দরবন অঞ্চলে যে এদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে তার প্রত্যক্ষদর্শী আমি নিজে। যেভাবে দিন দিন জলাভূমি বুজিয়ে নগরায়ন ঘটছে, গ্রাম মুছে গিয়ে আকাশে মাথা তুলছে কংক্রিটের জঙ্গল, বায়ু দূষণ আর রাসায়নিক কীটনাশক এর প্রভাবে পরিবেশ উঠছে বিষিয়ে, ধ্বংস হচ্ছে সবুজ সেখানে এই সবুজ-সুন্দরীরা বহাল তবিয়তে থাকবে কী করে? তাই এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতা খুব জরুরি। শীতের সকাল বা বিকেলের মিঠে কড়া রোদ পিঠে লাগিয়ে সবুজ সুন্দরীদের কীটতরঙ্গ শিকার করা দেখা যে কী নয়নাভিরাম দৃশ্য তা যে দেখেছে একমাত্র সেই বোঝে।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content