বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) সন্তানসহ সবুজ বক। (মাঝখানে) খাদ্য শিকারে উদ্যত সবুজ বক। (ডান দিকে) সবুজ বকের খাদ্য শিকার। ছবি: সংগৃহীত।

কিছুদিন আগে পক্ষীপ্রেমী এক বন্ধু সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়ে অনেক পাখির ছবি তুলেছিল। সেই সব ছবি দেখতে গিয়ে যেসব ছবিগুলোতে চোখ আটকে গিয়েছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল সবুজ রঙের একটা বকের ছবি। এইরকম বক আমার নজরে কোনওদিন পড়েনি। কিন্তু ছোটবেলায় ঠাকুমার মুখে সবুজ বকের কথা শুনেছি। সুন্দরবনের পশ্চিম অংশেও একসময় তাহলে সবুজ বক ছিল। জনবসতির চাপে বহু প্রজাতির মতো সবুজ বকও মনে হয় এলাকাচ্যুত হয়েছে।
বকেদের পরিবারে (Ardeidae) সবচেয়ে ক্ষুদে বক হল এই সবুজ বক। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Butorides striata’। ইংরেজিতে এই বককে বলা হয় ‘striated heron, little heron’ বা ‘green backed heron’। ম্যানগ্রোভ অরণ্য অঞ্চলে এদের দেখা যায় বলে সবুজ বককে ইংরেজিতে ‘mangrove heron’-ও বলা হয়। বাংলাদেশে সবুজ বক‘কুঁড়ো বক’ নামে বেশি পরিচিত। পৃথিবীজুড়ে এই বকের ২১টি উপপ্রজাতি রয়েছে। তবে ভারতে তথা সুন্দরবনে javanica উপপ্রজাতির সবুজ বক দেখা যায়। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়াতেও সবুজ বকের এই উপপ্রজাতির দেখা মেলে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭০: সুন্দরবনের পাখি: লাল কাঁক

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৬: নকল বুধন মাহাতো

সবুজ বক নাম হলেও দেহের রং পুরোপুরি সবুজ নয়, বরং বলা ভালো নীলচে সবুজ। পরিণত পাখির পিঠের পালকের রং নীলচে সবুজ হয়। তবে এই পালকের প্রান্তের রঙ হয় সাদা। ফলে একটা অদ্ভুত সুন্দর সাদা ছিট ছিট দাগ তৈরি হয় পুরো ডানা জুড়ে। মাথার উপরে পালকের রং কালচে সবুজ। আর এই কালচে সবুজ পালকগুলো লম্বা হয়ে ঝুঁটির মতো পেছনে ঘাড় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ঘাড় ও গলার রঙ ধূসর। ঠোঁটের গোড়া থেকে একটা কালো রেখা, মাথার দিকে চোখের নিচে দিয়ে বিস্তৃত হয়।
এদের নাসারন্ধ্রের পেছনে এবং চোখের সামনের দিকের রং হলুদ নিচের চঞ্চুর নিচের দিকেও হলুদ রঙ দেখা যায়। আর চোখের চতুর্দিকে হলুদ রঙের গোল বর্ডার থাকে, যেন মনে হবে হলুদ রঙের আই-লাইনার কেউ পরিয়ে দিয়েছে! চোখের পাতার রং হয় সবুজ। সবুজ ঘিরে হলুদ রঙের এই উজ্জ্বল উপস্থিতি সবুজ বককে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এদের পা দুটি হয় মোটা ও ছোটখাট। পা এবং আঙ্গুলের রং হয় হলুদ বা হলদেটে সবুজ। এদের লেজ খুব ছোট। পিঠ ও ডানার প্রান্তপালক বিস্তৃত হয়ে লেজ ঢেকে রাখে। এদের চঞ্চু বেশ সূচালো ও শক্তপোক্ত। এরা লম্বায় হয় প্রায় ৩৫ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার, আর ডানা ছড়ালে ৬২ থেকে ৬৮ সেন্টিমিটার বিস্তৃত হয়। এদের গড় ওজন হয় ১৯৩ থেকে ২৩৫ গ্রাম। স্ত্রী এবং পুরুষ বক দেখতে একই রকম হয়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৫: সাফল্য কি বংশগত উত্তরাধিকার? না কি ব্যক্তিগত কৃতিত্বের প্রমাণ?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬০: নতুন পথে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত

সবুজ বক সাধারণত এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। সুন্দরবন অঞ্চল ছাড়াও অন্যান্য দেশের উপকূলীয় এলাকায় এদের দেখা যায়। জলাভূমি, নদী, খাল এবং মোহনায় জলের ধারে এদের ঘুরেফিরে বেড়াতে দেখা যায়। কখনও কখনও ধানক্ষেতেও এদের দেখা যায়। এরা একা একাই ঘোরাফেরা করে। তবে অনেক সময় আশেপাশে আরো সবুজ বক থাকতে পারে। এদের শিকার করার সময় সাধারণত ভোর বেলা ও সন্ধ্যেবেলা। তবে গাছে ঘেরা ছায়াচ্ছন্ন জলাশয়ে বা খুব মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় দিনের বেলাতেও এদের শিকারে বেরোতে দেখা যায়। এরা জলের ধারে কোনও গাছের আড়ালে চুপচাপ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর সামনে শিকার দেখতে পেলে দ্রুত সূচালো চঞ্চু দিয়ে শিকার ধরে। এরা ছোট আকারের মাছ ছাড়াও চিংড়ি ব্যাঙ কেঁচো ও জলজ পোকামাকড় শিকার করে। শিকার ধরার জন্য অপেক্ষা করার সময় এদের ভঙ্গিমা হয় দৌড় শুরু করার সময় অ্যাথলেটদের ভঙ্গিমার মতো।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এই সময়ে মাথাটা হয় লম্বা করে সামনে প্রসারিত করে থাকে অথবা গুটিয়ে রাখে। কখনও কখনও এরা জলের খুব কাছে ঝুঁকে থাকা কোনও গাছের শাখাতে বসেও শিকারের দিকে নজর রাখে। অগভীর জলে এরা খুব ধীর পদক্ষেপে শিকার খোঁজে। এরা এতটাই ধীরে ও সাবধানে পা ফেলে যে একটা পদক্ষেপ থেকে পরের পদক্ষেপের মাঝে একটা পা জলের ওপরে ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত উঠে থাকে! দেখা গেছে এরা প্রতিদিন একই জায়গায় শিকার ধরার জন্য আসে এবং একই জায়গায় দাঁড়িয়ে শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে পছন্দ করে। এমনিতে এরা খুবই শান্ত স্বভাবের পাখি। তেমন কোনও শব্দ এরা করে না। তবে ভয় পেলে বা বিপদ বুঝলে উড়ে পালাবার সময় ‘কেইও কেইও’ বা ‘কিয়েক কিয়েক’ শব্দ করে। বাচ্চা সবুজ বক ভয় পেলে গলা লম্বা করে আকাশের দিকে তার চঞ্চুকে তুলে রাখে। এতে অবশ্য কতটা বিপদ কাটে তা জানা যায় না।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৮: লক্ষ্মীস্বরূপিনী মা সারদা

মার্চ থেকে জুলাই মাস হল সবুজ বকের প্রজনন ঋতু। এই সময়ে পুরুষ সবুজ বক ঝুঁটি খাড়া করে, ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে এবং লেজ নাড়িয়ে স্ত্রী বকের সামনে প্রেম নিবেদন করে। তারপর মন দেওয়া নেওয়ার পর্ব শেষ হলে স্ত্রী এবং পুরুষ মিলে জলাশয়ের ধারে মাটি থেকে ৩-৪ মিটার উপরে ছোট গুল্ম বা বৃক্ষ বা ঝোপের মধ্যে কাঠি কুটো দিয়ে ছোট্ট বাসা বানায়। বাসা ৪০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার ব্যাস বিশিষ্ট হয় এবং ৪ থেকে ৫ সেন্টিমিটার গভীর হয়। বাসায় সবুজ বককে মাঝে মাঝে এক ধরণের অদ্ভুত আচরণ করতে দেখা যায়। চঞ্চুর ফাঁকে একটা কাঠি ধরে তার গলাকে দ্রুত একবার সামনে একবার পেছনে নিয়ে গিয়ে আগু-পিছু করে। কিন্তু এমন আচরণের কারণ এখনও অজানা। স্ত্রী সবুজ বক একবারে ২ থেকে ৫টি ফ্যাকাসে নীল রঙের ডিম পাড়ে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ে মিলে ডিমে তা দেয়। ২১ থেকে ২২ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে। এই সময় মা ও বাবা সবুজ বক বাচ্চাদেরকে আধা হজম হওয়া খাবার উগরে দিয়ে খাওয়ায়। এদের বাচ্চারা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এক সপ্তাহ পরে এরা গাছের ডালে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দেয়, আর দু’সপ্তাহ পরে উড়তে শিখে যায়।

(বাঁদিকে) সবুজ বকের ছানারা । (মাঝখানে) শিকারের খোঁজে সবুজ বক। (ডান দিকে) সবুজ বক। ছবি: সংগৃহীত।

সুন্দরবন অঞ্চলে বিশেষ করে ভারতীয় অংশে সবুজ বকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে এদের খুব বেশি না হলেও দেখা যায়। প্রধাণত জলাভূমি ধ্বংস ও খাদ্যাভাব এই বাহারি বকের সংখ্যা হ্রাসের কারণ বলে মনে হয়। অবশ্য IUCN-এর তালিকায় এদের ‘Least Concern’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। —চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content