রবিবার ১৮ মে, ২০২৫


আমার বাগানে নীল কটকটিয়া। ছবি: লেখক।

বছর পনেরো আগের কথা। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। শীত যাই-যাই করছে। ক’দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেদিন সকালে দাঁত মেজে চা খাওয়ার জন্য রান্নাঘরের সামনের ছোট্টো একফালি বারান্দায় বেঞ্চের উপর বসেছিলাম। সামনেই পুকুর। আর আমার থেকে আট-দশ ফুট দূরে পুকুর পাড়ে একটা মাঝারি সাইজের আমগাছ। দু’চারটে আমও ঝুলছিল সেই গাছ থেকে। সবে চায়ের কাপ হাতে নিয়েছি, হঠাৎই সেই আমগাছের দিক থেকে ভেসে এল একটা মৃদু শিসধ্বনি— ‘উই উই উই উই উই উই উই উই উইইইইইই’! চায়ের কাপ আর ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছোল না। শব্দটা কানে আটকে গেল। পাখির এমন ডাক তো আগে শুনিনি।
কোন পাখি? কাপটা বেঞ্চে রেখে আমগাছের দিকে তাকানোর আগেই আবার একই ডাক। খুঁজতে সময় লাগল না। দেখি আমগাছটার একটা সরু ডালে বসে আছে পাঁচ-ছ’ ইঞ্চি লম্বা গোলগাল একটা পাখি। কী অপূর্ব রং! রূপ যেন ফেটে পড়ছে! মাথা, গলা, বুক, পিঠ ও লেজের রঙ নীল। এ নীল রং আকাশের নীল নয়, যেন সাগর থেকে তুলে আনা নীল রং। বুকের পিছন থেকে নীল রং ফ্যাকাশে হতে হতে পেটের কাছে গিয়ে হয়ে গিয়েছে সাদা। ডানা ও লেজের তলাটা যেন কালচে নীল। ছোট্টো দুটো পায়ের রং কালচে নীল। চঞ্চুটাও কালচে নীল, আর তার গোড়ায় যেন গোঁফের মতো কালো রঙের একগোছা রোম। কুচকুচে কালো চোখ দুটো দেখে মনে হল যেন মাথার দু’পাশে ছোট্টো কালো দুটো টিপ কেউ আটকে দিয়েছে। ঘাড়ে ও গলায় বেড় দিয়ে থাকা কালো দাগটা দেখে মনে হল যেন কেউ কালো রঙের একটা মালা ওকে পরিয়ে দিয়েছে। আর সবচেয়ে আকর্ষনীয় হল ওর মাথার চাঁদির ওপরে কালো রঙের একটা ছোট্টো গোলাকার ঝুঁটি। ঝুঁটিটার উচ্চতা কম, কিন্তু দেখে মনে হল করাতের দাঁতের মতো খাঁজকাটা। পাখিটার গায়ে হাত না দিয়েও মনে হল পালকগুলো যেন মখমলের মতো মোলায়েম। নীল, কালো ও সাদার এক অপূর্ব কম্বিনেশন পাখিটাকে করে তুলেছে অনিন্দ্যসুন্দর। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে হয়। এমন পাখি আগে কোনওদিন আমার নজরে পড়েনি।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৯: বসন্ত-বৌরি

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৭: একাকিত্বের অন্ধকূপ/২: অন্ধকারের উৎস হতে

দৌড়ে গেলাম আমার সস্তার ডিজিটাল ক্যামেরা আনতে। ততক্ষণ থাকবে তো? ক্যামেরা এনে দেখি পাখিটা ওই গাছেই আছে, তবে পাশের ডালে সরে গিয়েছে। ক্যামেরা তাক করে শাটার টেপার আগেই আবার সে ডাক দিল ‘উই উই উই উই উই উই উই উই উইইইইইই’! পর পর দু তিনটে ছবি তুললাম। মনে হল আমার উপস্থিতি বা ছবি তোলায় তার কোনও উৎসাহ নেই। আট-দশ ফুট দূরে একজন মানুষের উপস্থিতি ও তার নড়াচড়ায় পাখিটা যে ভয় পায়নি তা বুঝলাম। তাহলে ওরা স্বভাবে ভীতু নয়। একটু পরে দেখি সে আপন মনে আমগাছের ডালে কিছু খুঁটে খাচ্ছে। মনে হয় পিঁপড়ে। কয়েকটা খেয়েই আবার মাথা তুলে ডাকল ‘উই উই উই উই উই উই উই উই উইইইইইই’! ওরেব্বাস! আমাকে রীতিমত অবাক করে দিয়ে কোথা থেকে ফুরুৎ করে উড়ে এল আর একটা পাখি।

বাসায় তা দিচ্ছে নীল কটকটিয়া। ছবি: সংগৃহীত।

এ পাখিটার আকার আগেরটার মতো হলেও মাথার রং তত উজ্জ্বল নীল নয়। গায়ের রং নীলচে-ধূসর। আর গলায় মালা বা মাথায় ঝুঁটি নেই। তবে চঞ্চুর গোড়ায় কালো গোঁফ আছে। আমার সামান্য অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝলাম, আগের পাখিটা পুরুষ, আর পরে উড়ে আসা পাখিটা স্ত্রী। পাখিদের রাজ্যে পুরুষরা স্ত্রীদের থেকে অনেক বেশি রূপবান। যাইহোক, স্ত্রী পাখিটা এসেই বসল আগের পাখিটা থেকে প্রায় এক ফুট দূরে আর একটা ডালে। আমার তো তখন আনন্দে আত্মহারা হবার জোগাড়। চায়ের কথা ভুলেই গিয়েছি। ফের তাক করলাম ক্যামেরা। ঠিক সেই মুহূর্তে বাড়ির ভেতর থেকে কী যেন একটা জোরে শব্দ হল। ওরা দুজনেই ঘাড় কাত করে শব্দটা শুনল। তারপর দুজনে একসঙ্গে ফুরুৎ। আমার আর শাটার টেপা হল না! ওরা বাঁশবাগানের দিকেই উড়ে গেল। পিছু পিছু ধাওয়া করে আর ওদের হদিস করতে পারলাম না। কিন্তু কয়েক মিনিটের জন্য ওরা আমার মনে আনন্দের যে খোরাক দিয়ে গেল তা ফুরোবার নয়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১৫: গেমপ্ল্যান

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১৪: জীবনের নশ্বরতা ও আত্মানুসন্ধান বিষয়ে রামের উপলব্ধি যেন এক চিরন্তন সত্যের উন্মোচন

তবে মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি জাগিয়ে দিল পাখি দুটো। ওদের পরিচয় কী? প্রাথমিক ভরসা বাবা। বাবাকে ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখিয়ে পাখিটার পরিচয় জানতে চাইলাম। বাবা আগে দেখেছেন পাখিটাকে। তবে খুব একটা দেখা যায় না। বাবা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন যে সম্ভবত ওই পাখির নাম কটকটিয়া। নামটা আমার একটুও পছন্দ হল না। এত সুন্দর পাখির কিনা এমন বিচ্ছিরি নাম! কটকট করে ডাকে না, কটমট করে তাকায়ও না। তাহলে এমন নাম হবে কেন? আমার ঠিক বিশ্বাস হল না। বইপত্র ঘেঁটেও কিছু খুঁজে পেলাম না। পরিযায়ী নয় তো! কিন্তু তাহলে গ্রীষ্মকালে এখানে থাকবে কেন? মনের মধ্যে আমার অস্বস্তি বেড়েই চলল। সুতরাং ভরসা ইন্টারনেট। না, ভরসা করে ভুল করিনি। পেয়ে গেলাম পরিচয়। আর এটাও জনে গেলাম যে বাবা
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৮: মা সারদার জন্মতিথিতে তাঁর অপূর্ব অমানবীয় রূপ ফুটে উঠল

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৭: আলাস্কায় এমন অপরূপ দৃশ্যও দেখা যায়, যেখানে পাহাড়-সমুদ্র-হিমবাহ একসঙ্গে বিরাজমান

এই পাখির যে নাম বলেছিলেন তা ঠিক—লোকে কটকটিয়াই বলে। আগেই বলেছি, নামটা আমার একদম পছন্দ হয়নি। দেখলাম, চিনে এই পাখিকে যে নামে ডাকা হয় তার অর্থ ‘কালো বালিশ’! মাথায় কালো ঝুঁটির জন্যই এমন নাম। আবার এদের ‘জঙ্গলের নীল পরী’ নামেও নাকি ডাকা হয়। নামটা সুন্দর হলেও পরী স্ত্রীলিঙ্গ। সুতরাং রূপবান পুরুষকে আর যাইহোক পরী বলা যায় না! ইংরেজিতে এই পাখির নাম ‘Black-naped Monarch’ বা ‘Black-naped blue flycatcher’। গলায় কালো মালার জন্যই ‘Black-naped’। আর ‘Monarch’, অর্থাৎ রাজা বা রানি। এই নামটা আমার পছন্দ হল। যা রূপ তাতে পাখিদের রাজ্যে রাজা বা রানি বললে খুব বাড়িয়ে বলা হবে না। আমি এদের নাম দিলাম ‘নীলরাজা’ আর ‘নীলরানি’।

পুরুষ নীল কটকটিয়া। ছবি: সংগৃহীত।

‘Black-naped Monarch’-এর বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Hypothymis azurea’। এরা দক্ষিণ এশিয়ার ক্রান্তীয় অঞ্চলের পাখি। পশ্চিমে ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে পূর্বে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিনস পর্যন্ত এদের নিবাস। ভৌগোলিক বিচ্ছিনতার জন্য বিভিন্ন দেশে এদের রঙে এবং গলার মালা ও মাথার ঝুঁটিতে কিছু ভিন্নতা দেখা যায়। ভারতে যে উপপ্রজাতি দেখা যায় তার নাম Hypothymis azurea styani । আমার দেখা নীল কটকটিয়াটি এই উপপ্রজাতিরই।

ব্ল্যাক নেপেড মনার্ক বা নীল কটকটিয়া মূলত অরণ্যবাসী পাখি হলেও ঘন গাছপালাপূর্ণ বসতি এলাকাতেও দেখা যায়। তাই সুন্দরবনের বসতি এলাকাতেও দেখেছি। সমতল থেকে পাহাড়ের ১৩০০ মিটার উচ্চতার মধ্যে এদের আনাগোনা। কখনও কখনও স্থানীয়ভাবে পরিযায়ী হতে দেখা যায়। শীতের সময় সমতলে নেমে আসে, আর গরম পড়লে উঁচু এলাকার দিকে চলে যায়। এরা খুব একটা মাটিতে নামে না। বেশিরভাগ সময় ঘন পাতার আড়ালে ঘোরাঘুরি করে। বাঁশবন এদের খুব প্রিয় জায়গা।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৮: রক্তে ভেজা মাটিতে গড়ে ওঠে সত্যিকার প্রাপ্তি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৬: শান্তিনিকেতনে কবির প্রথম জন্মোৎসব

ব্ল্যাক নেপেড মনার্ক-এর পা শরীরের তুলনায় বেশ ছোটো ও দুর্বল। এজন্য গাছের ডালে যখন বসে থাকে তখন উবু হয়ে বসে থাকে। পোকামাকড়ই এদের প্রধান খাদ্য। আম, আতা, কাঁঠাল, লেবু, পেয়ারা ইত্যাদি ফলের গাছে এদের ঘুরতে দেখা যায় পোকামাকড় খাওয়ার লোভে। এভাবে ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফলচাষীদের উপকারই করে। ব্ল্যাক নেপেড মনার্করা উড়ন্ত পোকামাকড় ধরে খেতেও খুব পটু। এজন্য ওদের আর এক নাম ব্ল্যাক নেপেড ব্লু ফ্লাই ক্যাচার।
প্রজনন ঋতু ছাড়া অন্য সময় ব্ল্যাক নেপেড মনার্করা ছোটো গোষ্ঠীতে বা অন্য পাখিদের সঙ্গে মিশে বসবাস করে। কিন্তু প্রজনন ঋতুতে স্ত্রী ও পুরুষ পাখি জোড় বাঁধে। তারপর কোনও সরু ডালের দ্বিখন্ডিত শাখার সংযোগস্থলে ছোট্টো পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়।

স্ত্রী নীল কটকটিয়া। ছবি: সংগৃহীত।

সাধারণত মাটি থেকে ৬-১০ ফুট ওপরে বাসা বাঁধে। বাসা বানায় সরু কাঠি, গাছের ছাল, মস, শুকনো পাতা ইত্যদি দিয়ে। মাকড়সার জাল দিয়ে বাসাকে ডালের সাথে শক্তপোক্ত করে বাঁধে। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই বাসা বানায়। তারপর স্ত্রী পাখি ক্রিম বা হালকা হলুদ রঙের দুটো বা তিনটে ডিম পাড়ে। ডিমের উপর লালচে-বাদামি ছিট থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি উভয়ে মিলে তা দেয়। ১০-১২ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চারা বেরিয়ে আসে। বাচ্চাদের খাওয়ানোর ভার মা-বাবার ওপর বর্তায়। মা ও বাবা বাচ্চাদের জন্য ঘাস ফড়িং বা ঝিঁঝিঁ পোকা ধরে আনে।

ব্ল্যাক নেপেড মনার্ক আমরা অন্ততঃ খুব বেশি দেখতে পাই না। আমার সেই প্রথম ও আজ পর্যন্ত শেষ দেখা। হয়তো ঘন পাতার আড়ালে ওদের ঘোরাফেরা বলেই আমার নজরে পড়েনি কিংবা সুন্দরবনের বসতি এলাকা ওদের আর পছন্দ নয়। আইইউসিএন (IUCN)-এর মতে এরা ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত (Least Concern) পাখি। প্রকৃতির এই অপূর্ব-সুন্দর দুটি উপহার যেন আমাদের জীবজগতের সংসার থেকে হারিয়ে না যায় সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকা দরকার। নীলরাজা ও নীলরানিরা যেন সুন্দরবনে প্রকৃতই প্রকৃতিতে রাজা ও রানির মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content