রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


অসমে ধর্মীয় এবং সমাজভাবনায় এক বিপ্লবের নাম শ্রীমন্ত শঙ্করদেব। অসমের সমাজ সংস্কৃতির উপর তাঁর প্রভাব যথেষ্ট। অসমীয়া সাহিত্য এবং ধর্মীয় ইতিহাসে শঙ্করদেব এক জোয়ার নিয়ে এসে ছিলেন। অসমীয়া সমাজে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। শুধু তাই নয়, ভক্তি গীতিতেও রয়েছে তাঁর অবদান। তিনি এক জন একাধারে ধর্ম প্রচারক, সমাজ সংগঠক এবং একজন সাহিত্য প্রেমীও ছিলেন। সুতরাং শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের জীবনী বিস্তারিতে আলোচনার দাবি রাখে। সেই সময় অসমে ধর্মের নামে চলছিল নানান ধরনের ব্যাভিচার, সমাজে যেন কোনও রকম শৃঙ্খলা ছিল না। অসমীয়া সমাজে শিষ্ঠাচার ফিরিয়ে আনলেন শ্রীমন্ত শঙ্করদেব।

১৪৪৯ সালে অসমের নওগাঁও জেলার আলিপুখুরীতে শ্রীমন্ত শঙ্করদেব কুসুম্ভর এবং সত্যসন্ধ্যা ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। খুব ছোট বেলায় তিনি বাবা-মাকে হারান। তাঁর পিতামহী খেরসুটিয়া তাঁকে লালন-পালন করেন। সেই সময়ের শিক্ষা গুরু মহেন্দ্র কোন্দলীর কাছে জ্ঞান অর্জন করার জন্য তাঁকে গুরুর টোলে পাঠিয়ে ছিলেন তাঁর ঠাকুমা। শুধু অক্ষর জ্ঞান হয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তাক্ষরের ব্যবহার ছাড়াই কবিতা লিখেছিলেন শঙ্করদেব। কবিতার বিখ্যাত পঙক্তি হচ্ছে—
“করতলর কমল কমল দল নয়ন।
ভব দব দহন গহন-বন শয়ন ।।”
পর্বরতীকালে তিনি তাঁর রচনা সম্ভার দিয়ে অসমীয়া সাহিত্যের ভাণ্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করেন। শঙ্করদেব নীতি বাক্য, সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ করেন এবং কীর্তনও রচনা করেন। উদার, মানবতাবাদী ছিলেন বলেই সাধারণ মানুষের সামাজিক সমস্যাগুলিকে অনুভব করতে পেরেছিলেন। সে সব থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছিলেন নতুন ভাবে। ভারতের প্রাচীন গ্রন্থগুলির গভীর অধ্যয়ন করে তার তত্ত্বকথা গীত, নাটক কী কিংবা উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাইলেন। ‘কীর্তন ঘোষা’, ‘রুক্মিণী হরণ’, ‘পারিজাত হরণ’, ‘কেলিগোপাল’, ‘কালিদমন’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা, যা আজও অসমীয়া সাহিত্যে সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর ‘ভক্তি রত্নাকর’ তত্ত্বমূলক গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তিনি সারা জীবন বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য রচনা করেছেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সমের আলো অন্ধকার, পর্ব ২৯: অসমের তীর্থক্ষেত্র

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৪: যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না?

গুরুর নিকট শিক্ষাগ্রহণ করে বাড়ি ফেরার পর তাঁর উপর সংসারের চাপ এসে পড়ল। অল্প বয়সেই তাঁকে ভূঁইজ্ঞা শ্রেষ্ঠ করে দিয়ে সমাজের মাথা বানিয়ে দেওয়া হয়। শঙ্করদেব যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে শাসনকার্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কাছাড়িরা ভূঁইয়া এবং ব্রাহ্মণদের উপর নির্যাতন শুরু করে। কাছাড়িদের হাত থেকে রক্ষা পেতে শঙ্করদেব তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে বারদোয়াতে বসবাস করতে স্থানান্তরিত হন। তখন সেখানে রামরাম নামক এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির পরামর্শে একটি মন্দির নির্মাণে আগ্রহী হন। মন্দির নির্মাণের খননকার্যের সময় সেখানে একটি চতুর্ভূজ বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া যায়। মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বলা যেতে পারে তার পর থেকেই তিনি ঈশ্বর অনুরাগী হতে শুরু করেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো

৩২ বছর বয়সে সতেরো জনকে সঙ্গে নিয়ে শঙ্করদেব প্রথমবার তীর্থক্ষেত্রে রওনা হন এবং ভারতের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণ তাঁর চিন্তাধারার উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তখন প্রায় সমগ্র দেশেই ধর্মের নামে এক বিশৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছিল। ভারতীয় সভ্যতা সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাসকে নতুন ভাবে গড়ে নেবার জন্য চলছিল ধর্মীয় আন্দোলন। তিনিও ধর্মের মূল কথা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। ধর্মের নামে জাতিগত ভেদাভেদকে দূরে সরিয়ে ঈশ্বরকে আরাধনা করারই এক মাত্র উদ্দ্যেশ হওয়া উচিত। ধর্ম থেকে বড় হয়ে উঠছিল ধর্মীয় জাঁকজমক। শ্রীমন্ত শঙ্করদেব তখন ভগবত গীতার বাণী মানুষকে শুনিয়ে বৈষ্ণব নামধর্মের প্রচার শুরু করেন। তাঁর মতে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড এক ঈশ্বরের অধীন, তিনি পরমেশ্বর বিষ্ণু। সমস্ত দুঃখ-যন্ত্রণার অবসান পেতে হলে বিষ্ণুর স্মরণাপন্ন হতে হবে। এই ছিল তাঁর ধর্মের মূল কথা। তাঁর প্রবর্তিত ধর্মকে নাম ধর্মও বলা হয়। নাম ধর্মে বলি, যজ্ঞ, মূর্তি উপাসনা ইত্যাদির কোনও স্থান নেই। এখানে শুধু বিষ্ণুর নাম কীর্তন করা হয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৯: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—কালি লতা ও পান লতা

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৫: বার্নার্ড শ ও শার্লটি—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/১

শঙ্করদেবের নাম উচ্চারণ করলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর শিষ্য মাধবদেবের নামও মনে পড়ে যায়। আসলে ১৫০০ সাল থেকে পরবর্তী বেশ কয়েক বছর এক ভক্তি অন্দোলন চলছিল। বলি প্রথা কিংবা ধর্মের নামে নিজস্বার্থ সিদ্ধির প্রচেষ্টা তখন উচ্চ বংশীয় হিন্দুদের মধ্যে প্রবল ভাবে ছিল। ফলে অনেকেই ধর্মান্তরিত হচ্ছিলেন। সেই কঠোরতাকে কোমলতার দিকে আনার প্রয়াসের নামই ছিল ভক্তি আন্দোলন।

মাধবদেব ছিলেন শাক্ত ধর্মবলাম্বী। পূজার্চনায় বলি প্রথাতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর পিতৃ বিয়োগের পর তাঁর মা এবং স্ত্রী কঠিন রোগগ্রস্থ হলে তিনি বলি প্রথা অবলম্বন করে দুর্গাপুজো করার মানত করেন। তিনি তাঁর এক আত্মীয় রামদাসকে বলির জন্য পাঁঠা জোগাড় করতে বলেন। কিন্তু রামদাস নাম ধর্মগ্রহণ করেছিলেন, তাই তাঁকে বলি প্রথাতে বাধা দেন। শুরু হল প্রবল তর্ক বিতর্ক। অবশেষে তাঁরা সমাধান খুঁজতে শংকর দেবের সরণাপন্ন হন।

শঙ্কর দেবের সঙ্গে মাধবদেবের তর্কযুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ নয় ঘণ্টা দু’জনে তর্ক-বিতর্ক চলার পর শ্রীমন্ত শঙ্কর দেবের যুক্তি মাধবদেব গ্রহণ করলেন। শাক্ত মাধবদেব বিষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে শঙ্কর দেবের পরম শিষ্য হয়ে উঠলেন। নাম ধর্ম প্রচার করে, বৈষ্ণব ধর্মের অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করে তিনিও হয়ে উঠলেন মহাপুরুষ শ্রীমাধবদেব।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৩: মিলাডা—বিদেশিনীর হরফ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব তাঁর জীবন সায়হ্নে পৌঁছেও নামধর্মের প্রচার চালিয়ে যান। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার মধুপুরে মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্কর দেব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দিনটি ছিল শুক্লা দ্বিতীয়া তিথি। ১৫৬৮ সালের ২১ ভাদ্র। নাম ধর্ম এবং নাম ধর্মের গীত আজও অসমে অক্ষয়। শ্রীমন্ত শংকরদেব যে প্রেমের বাণী শুনিয়ে গিয়েছেন তা অসমের আকাশে বাতাসে চির দিন শোনা যাবে।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content