শনিবার ১৭ মে, ২০২৫


ছবি: সংগৃহীত।

বলা হয় মানুষের মন খুশি করতে হলে তার পেট খুশি করতে হয়। এ বার পেটের রাস্তাটা যায় রসনার হাত ধরে। জঠরাগ্নি নির্বাপিত করতে খেতে হয় সে কথা সত্য হলেও রসনার পরিতৃপ্তিটাও কিন্তু বড় কথা। এক এক জায়গার খাওয়া দাওয়া এক এক রকমের হয়। সব জায়গারই কিছু বিশেষত্ব জড়িয়ে থাকে সেখানকার খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে। একটি জায়গার চাষ-বাস, সেই জায়গার আবহাওয়া এই সব কিছুই একটি অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাসে প্রভাব ফেলে। অসমের অসমীয়া জাতির পরম্পরা গত খাদ্যাভ্যাসে রয়েছে সুস্বাদু এবং স্বাস্থকর অনেক রকমের খাবার। প্রকৃতিতে যখন যা পাওয়া যায় তাই আসলে আমাদের খাদ্যাভাসে অন্তর্ভুক্ত হয়। কোনও কোনও মাসে বিশেষ ধরনের শাক সব্জি, ফলমূল এবং বিশেষ ধরনের মাছও পাওয়া যায়। এ সব কিছুই উঠে আসে খাদ্য তালিকায়।
অসমীয়াদের খাবার দাবার নিয়ে মজা করে বলা হয়, ‘খার খোয়া অসমীয়া’। এই ‘খার’ অসমীয়া রন্ধন শৈলীর এক উপকরণ। কলা গাছের একটি অংশ পুড়িয়ে ছাই তৈরি করে এই খার তৈরি করা হয়। এই খার রান্নায় ব্যবহার করা হয়। এই খার অসমীয়া রান্নায় এক বিষেশ ধরনের স্বাদ আনয়ন করে। তবে মূল উপাদান ভাত। ভাতের সঙ্গে খার মিশ্রিত বিভিন্ন রকমের রান্না থাকে। এক সময় নুনের বদলে খার রান্নায় ব্যবহার করা হত।

ভারতের মানচিত্রের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অসম এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি তাইল্যান্ড, বার্মা (মায়ানমার), চিন এই সব দেশের সীমানার কাছে রয়েছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই দেশগুলির খাওয়া-দাওয়া এবং আরও অনেক আচার আচরণের প্রভাব এ অঞ্চলের মানুষের উপর পড়েছে।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৪৮: গায়ক-গায়িকাদের অসম

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৪: ‘মহেশ্বরের অনন্ত ধৈর্য’

অসমীয়া খাবারে আরও একটি উপাদান হল টেঙ্গা অর্থাৎ টক। টেঙ্গা মাছর ছোল অর্থাৎ মাছের টক ঝোল অসমীয়া খাবারের একটি বিশেষ জনপ্রিয় পদ। ভাত অসমের প্রধান খাদ্য। এখানে অনেক ধরনের ধান উৎপাদনও হয়। এমনি এক বিশেষ ধরনের ভাত হল কুমল শাউল বা বোকা শাউল, যা আগে রান্না করে নিয়ে তার পর শুকিয়ে নিয়ে তার পর খোসা ছাড়ানো হয়। তার পর গরম জলে ভিজিয়ে নিয়ে খেতে হয়। এই ভাতটি একটি জল খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আরেক ধরণের বিশেষ ভাত হল ‘সুঙ্গা শৌল’ বা ‘শুঙ্গা ভাত’। আঠালো বা বোরা শৌল বা বিরুণ চান নামে পরিচিত একধরনের আঠালো চাল বাঁশের সুঙ্গায় অর্থাৎ বাঁশের ফাঁপায় রান্না করা হয়। এটি মূলত শীতের সময় রান্না করা হয়।

অসমীয়াতে প্রচলিত ডাকের বচনে কোন মাসে কোন ধরনের খাবার খাওয়া উচিত তার উল্লেখ করা রয়েছে।
জৈঠত দৈ ,আহারত খৈ
শাওনে মরাপাত খাব গৈ।
ভাদত ওল, অহিনত বল ।
আঘোনত খাবা চরাই
পুহত পিঠা, মাঘত করাই ।
ফাগুনত মৌ, চ’ততত ঔ
বহাগত বর, ইয়াকে খালে
পুরুষর গুচে সর্বজ্বর।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৭: পাতি সরালি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১২: অপারেশন অপহরণ

প্রকৃতি তার সম্ভারে কত রকমের খাবার জিনিস যে সঞ্চয় করে রেখেছে তার কোনও হিসেব নেই। অসমের মানুষ তাই বিভিন্ন ধরনের সাক সব্জি যেরকম খান তেমনি তাদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মাছ, হাঁসের মাংস, পায়রার মাংস, স্কোয়াব ইত্যাদি পাখির মাংস। অসমীয়া বাড়িতে মাছের সঙ্গে শাক-সব্জি দিয়ে একটি পাতলা ঝোল রান্না করা হয়। অসমীয়া রান্নায় খুব বেশি মশলায় প্রয়োগ হয় না। মাংস এবং মাছের মতো পদে মশলা এবং তেল খুব বেশি থাকে না। আদা, কারি পাতা, খোরিসা অর্থাৎ ফারমেন্টেড বাঁশের কাণ্ড, খার, বেশ অনেকটা পরিমাণে লেবুর রস থাকে। কোনও কোনও সম্প্রদায়ের লোকেরা বিভিন্ন ধরনের মাংস খান। যেমন মুরগি, পাঠার মাংস, শুয়োরের মাংস। আবার কলিতারা মাংস খান না। বৈষ্ণব ধর্মাবলন্বী অসমীয়ারা একেবারেই মাংস খান না।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১০: বনবাসী রামের নিরাসক্ত ভাবমূর্তির অন্তরালে, ভাবি রামরাজ্যের স্রষ্টা দক্ষ প্রশাসক রাম

পর্ব-১৩: আকাশ এখনও মেঘলা

জিরে, ধনে গুঁড়ো ইত্যাদি পরিচিত মশলা ছাড়া অসমের রান্নায় এখান কার কিছু স্থানীয় মশলা ব্যবহৃত হয়। শয়েই সব মশলার তালিকায় রয়েছে মোরান আদা, মধু হুলেং, মণিমুনি, টেংগেসি, ইত্যাদি। অসমের রান্নায় তেমন মশলা দেওয়া না হলেও এখনকার ভূত ঝলকিয়া পৃথিবী বিখ্যাত। ভূত ঝলকিয়া এক ধরনের লংকা, যা কি না পৃথিবীর সব চেয়ে ঝাল লঙ্কা। একটুকরো এই ভূত ঝলকিয়া খাওয়া প্রায় কঠিন ব্যাপার। এই ভূত ঝলকিয়া দিয়ে তৈরি হয় এক ধরনের ঝাল আচার। এই আচার কেবল অসমের কিছু কিছু জায়গায়ই তৈরি হয় এবং পাওয়া যায়।

অসমে অনেক রকমের শাক-সব্জি পাওয়া যায়। তাই এই শাক-সব্জি খুব স্বাভাবিক ভাবেই এখানকার রান্নার বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছে। তাই ধর্মীয় বা লৌকিক আচার অনুষ্ঠানেও এই সব খাবার নিজের জায়গা করে নিয়েছে। রঙ্গোলি, বিহুর সময় অনেকের ১০১টি বিভিন্ন রকমের সবুজ শাক খাবার রীতি আছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৬: পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যাঁর জীবনের আকাশে কখনও শত্রুতার মেঘ জমেনি

অসমীয়া খাদ্য তালিকায় পিঠাও একটি উল্লেখ যোগ্য পদ। তবে রোজকার খাবারে পিঠা না থাকাটাই স্বাভাবিক। ভোগালি বিহুর সময় চালের পিঠে তৈরি করা হয়। তিল পিঠা, ঘিলা পিঠা, ঝুটুলি পিঠা, তেকেলি পিঠা ইত্যাদি নানান ধরনের পিঠে তৈরি হয়। কখনও ভিতরে তিল কখনও বা নারকেল দেওয়া হয়। একটি ঐতিহ্যবাহী অসমীয়া মিষ্টি হল লারুস। এই লারুস হচ্ছে এক ধরনের মিষ্টি লাড্ডু বা নাড়ু। নারকেল কিংবা তিল দিয়ে তৈরি এই নাড়ু খেতে খুবই ভালো।

ছবি: সংগৃহীত।

খাবার দাবারের কথা তো হল। তবে তার সম্পূর্ণতা আসবে কীভাবে শয়েই সব খাবার পরিবেশিত হয় তা জানলে। প্রথা অনুযায়ী, কাঁসার থালা, গ্লাসে খাবার বেড়ে দেওয়া হয়। পাতে অবশ্যই থাকে খার, কাগজি লেবু একটুকরো এবং পান দানিতে পান তাম্বুল অর্থাৎ পান সুপুরি। পান-সুপারি ছাড়া অসমীয়া খাবার থালি অসম্পূর্ণ। চুন, তামাক-সহ যোগে পান অসমের মানুষ সেই প্রাচীনকাল থেকেই সেবন করে আসছেন। অসমীয়া লোক সংস্কৃতিতে তাম্বুল এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। গোয়ালপাড়িয়া লোক সঙ্গীতে সেই পানের উল্লেখ পাই আমরা—
“আনহে গুয়া-পান ,কাটহে খাই
হাঁসি মনে আমরা চলিয়া যায়।”

—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content