বৃহস্পতিবার ১৭ এপ্রিল, ২০২৫


ভূপেন হাজারিকা ও কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য।

অসমের সবুজ মাটিতে অনেক সংগীত শিল্পী জন্মেছেন। তাঁদের গান শ্রোতাদের মনে সব সময় দাগ কেটেছে। অসমের অনবদ্য প্রকৃতি জন্যই হয়তো তাঁদের কণ্ঠে অপরূপ ভাবে সুর খেলা করে। উদার প্রকৃতির মতো কণ্ঠও হয় উদাত্ব। কেউ লিখে গিয়েছেন অমর সঙ্গীত। তাঁদের সৃষ্টি অসম তথা গোটা ভারতের মানুষ মনে রাখবে চিরদিন।

বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব। একাধারে কবি, সাহিত্যিক নাট্যকার, সঙ্গীতশিল্পী এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীও বটে। ১৯০৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন এই বহুমুখী প্রতিবার অধিকারী। সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ বিষ্ণুপ্রসাদ রাভাকে কলাগুরু উপাধি দিয়েছিলেন। তাঁর রচিত গান বিষ্ণুপ্রসাদ সঙ্গীত নামে পরিচিত। অসমের প্রথম অসমীয়া চলচ্চিত্র জয়মতিতে নৃত্য পরিচালনা করেছিলেন। কয়েকটি অসমীয়া চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা মৃত্যুবরণ করেন।
লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে হেমাঙ্গ বিশ্বাস এক অবিস্মরণীয় এক নাম। বাংলা এবং অসমীয়া ভাষা সাহিত্যে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। সাংস্কৃতিক মহল থেকে শুরু সঙ্গীপ্রেমী মানুষের মনে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছেন আজও। তাঁর জন্ম ১৮৮০ সালে, বর্তমান বাংলা দেশের হবিগঞ্জে। তখন হবিগঞ্জ অসমের অন্তর্গত ছিল। ডিব্রুগড়ের জর্জ ইন্সটিটিউশনে পড়ার সময় তাঁর প্রধান শিক্ষক ছিলেন নীলমণি ফুকন। তখনই তিনি অসমীয়া সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন তাঁর অবাদ বিচরণ ছিল তেমনি ছিল সঙ্গীত জগতে। তাঁর ‘গণ সঙ্গীত‘ সাধারণ মানুষের মনে ঘর বেঁধে রয়েছে। শিল্পীর গানের মধ্যে সব সময় মানুষকে নিজের নায্য অধিকারের জন্য লড়াই করতে বলেছেন। ‘আমরা করব জয়‘ , ‘আজাদি হয়নি তোর’ , ‘শঙ্খ্যচিল‘ এই সব গান আজও বাংলার ঘরে ঘরে বাজে। বেমাঙ্গ বিশ্বাস অনেক বিদেশি গানের অনুবাদ করেছেন। ১৯৮৮ সালে এই সংগীত শিল্পী ইহলোক ত্যাগ করেন।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৪৭: অসমে সংবাদপত্র প্রকাশের গল্প জানা?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯২: শ্রীমার সঙ্গে এক মেমসাহেবের কথোপকথন

অসমের সঙ্গীত জগতের মধ্য আকাশে যিনি সূর্যের মতো বিরজমান আছেন তিনি ভূপেন হাজারিকা। ১৯২৬ সালে অসমের সদিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন ভূপেন হাজরিকা। মাত্র দশ বছর বয়সথেকেই গানে সুর দিতে শুরু করেন তিনি। ১২ বছর বয়সে প্রথম অসমীয়া সিনেমার জন্য গান গাইলেন, আর সেই থেকেই শুরু হল তাঁর সঙ্গীতময় যাত্রা। তাঁর দরাজ গলার তুলনা হয় না। তাঁর জনপ্রিয়তা আজও আকাশচুম্বী। অসমীয়া চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বাংলা এবং হিন্দি ভাষার সিনেমাতেও সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি।

২০০৬ সালে তাঁর ‘মানুষ মানুষেরই জন্যে’ গানটিকে বিবিসি বাংলা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট কুড়িটি বাংলা গানের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। তাঁর গানের এক অদ্ভুত রকমের আমেজ রয়েছে যা সব শ্রেণির শ্রোতাকেই আকর্ষণ করে। ১৯৭৭ সালে পদ্মশ্রী ১৯৯২ সালে দাদাসাহেব ফালকে, ২০০১ সালে পদ্মভূষণ, ২০০৯ সালে অসম রত্ন পুরস্কার লাভ করেন তার পর মুক্তি যুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা লাভ করেন ২০১১ সালে। পদ্মবিভূষণ এবং ভারতরত্ন মরণোত্তর পুরস্কারে তাঁকে ভূষিত করা হয়। তাঁর রচিত গানে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল। ‘আজ জীবন, খুঁজে পাবি’, ‘গঙ্গা আমার মা’, তাঁর জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।তাঁর ‘দিল হুম হুম করে’ গানটি হিন্দি সিনেমাকে অন্য মাত্রা প্রদান করেছিল। ভূপেন জাহারিকার বিভিন্ন ভাষায় জনপ্রিয় গানের সংখ্যা প্রচুর। এই গানগুলি বর্তমান সময়েও সমান ভাবে সমাদৃত।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-২৩: তিত্তিরজাতক: পাপ ও আত্মজিজ্ঞাসা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৪: মৌটুসি

২০১১ সালে অসমের এই গানের রাজা দেহত্যাগ করেন বলতে হয় সুদক্ষিণা শর্মার কথা। তিনি অনেক অল্প বয়স থেকেই সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। জ্যোতি সঙ্গীত, গয়ালপাড়িয়া সঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে সাধারণ শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন সুদক্ষিণা শর্মা। আদতে তাঁর নাম ছিল নিরুপমা হাজরিকা, বিয়ের পর নাম পরিবর্তন করে হন সুদক্ষিণা শর্মা। তিনি সম্পর্কে ভূপেন হাজারিকার ছোট বোন ছিলেন। প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে বেশ কয়েকটি অসমীয়া সিনেমাতে গান গেয়েছন। তিনি এবং তাঁর স্বামী সংগীতজ্ঞ দিলীপের সঙ্গে প্রচুর সংগীত কর্ম শালা করেছেন। ভূপেন হাজারিকার পরিবারের অনেকেই সংগীত জগতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর আরেক ছোট ভাই জয়ন্ত হাজরিকাও অসমীয়া সংগীত জগতের আরেক নক্ষত্র। তিনি বেশ কয়েকটি গান রচনা করেন এবং সুরও দেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১০: অন্ধকারে, চুপিসারে

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৪: রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’ ত্রিপুরার ইতিহাসাশ্রিত গল্প

জয়ন্ত হাজারিকা ইংরেজি গানের সঙ্গে তথা পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে অসমীয়া লোক সঙ্গীতের মেলা বন্ধন করিয়েছিলেন। অসমীয়া গানে পাশ্চাত্য বাদ্য যন্ত্র তাঁর হাত ধরেই এসেছিল। তিনি তাঁর বাবা নীলকান্ত হাজারিকা এবং মা শান্তিপ্রিয়া হাজারিকার নবম সন্তান ছিলেন। তাঁরা মোট দশ জন ভাই-বোন ছিলেন ।তাঁদের পরিবারে রীতিমত সংগীতের চর্চা হত। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি অসমীয়া সিনেমাটি গান গেয়েছেন এবং সঙ্গীত পরিচালনাও করেছেন।

অসমের সঙ্গীত শিল্পীদের কথা বলতে গেলে প্রতিমা পাণ্ডে বড়ুয়ার কথা বলতেই হয়। ১৯৩৫ সালে অসমের ধুবড়ি জেলার গৌরীপুরের রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। গোয়ালপাড়িয়ে গানে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিমা পাণ্ডে বড়ুয়ার ‘মোর মাহুত বন্ধু’ গানটি তাঁর গাওয়া গানগুলির মধ্যে অন্যতম। তাঁর গাওয়া ‘কমলা সুন্দরী নাচে’ গানটিও একই ভাবে আজও জনপ্রিয়। তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কার লাভ করেন।

খগেন মোহন্ত অসমের সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে এক জন অন্যতম শিল্পী। তিনি তাঁর বিহু গানের জন্য অসমের মানুষের কাছে বিশেষ ভাবে সমাদৃত। তাঁকে কিং অফ বিহু বা বিহু সম্রাটও বলা হয়। তিনি অসমের লোক সঙ্গীতকে এক অন্য মাত্রা প্রদান করেছেন। ১৯৪২ সালে তাঁর জন্ম হয়। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল আর পরবর্তী সময়ে অসমের এক বিশেষ্ট সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে পরিচিত হলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৮: গার্হস্থ্যজীবনে জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রের ভাবমূর্তি, তাঁর দেববিগ্রহে উত্তরণের একটি অন্যতম কারণ?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

অসমের সঙ্গীত শিল্পীদের কথা বলতে গেলে বলতে হয় লোক গায়ক এবং গবেষক কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের কথা। ১৯৭০ সালে অসমের শিলচর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পূর্ব বাংলার লোক সঙ্গীতকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ১৯৯৯ সালে একটি ব্যান্ড বা গানের দল দোহার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর কাকু পিসি এবং বাড়ির অনেকেই গান বাজনার চর্চা করতেন। বাড়িতে ছিল এক সাংস্কৃতিক মহল। অতি অল্প শুরু হয় তাঁরও সংগীত সাধনা। তবে গানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অকৃতিম। তিনি বেশ কয়েকটি বাংলা সিনেমাতে গান গেয়েছেন। ১৯৯৮ সালে ‘ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস’ থেকে লোকসংগীতের উপর গবেষণা শুরু করেন। লোকসংগীতের লোক বাদ্যযন্ত্রের প্রতি ছিল তাঁর আকর্ষণ। পূর্ব বাংলার লোক সঙ্গীতের অক্ষুত চেহারাকে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছনই ছিল তাঁর উদ্দেশ্যে। ২০১৭ সালে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে এক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। দেশ বিদেশে আজও রয়েছেন তাঁর গুণ মুগ্ধ শ্রোতারা।

অসমের মায়ের কোলে জন্ম নিয়েছেন অনেক গুণী জনেরা অনেক সঙ্গীত শিল্পীরা। তাঁরা তাঁদের সৃষ্টির জগতে অমর হয়ে রয়েছেন। গায়ক গায়িকার অসমে বর্তমানে জুবিন গার্গ, খগেন মহন্তের ছেলে বাপন, জয় বড়ুয়া, সাগরিকা এবং আরও অনেক সংগীতশিল্পী রয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই সঙ্গীতের জগতে বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছেন এবং শ্রোতাদের হৃদয়ে জুড়ে আছেন।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content