ঝুমুর নৃত্য।
অসম একদিকে যেমন নয়নাভিরাম সবুজের দেশ, তেমনই এখানকার মানুষও প্রকৃতির মতোই সহজ, সরল। সাধারণ মানুষের জীবনের ছবি প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাদের সংস্কৃতিতে। সবুজ পাহাড়ের কোলে থাকা মানুষ প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভেঙে নাচে-গানে মেতে ওঠে। অসমে যেহেতু অনেক বর্ণ-ধর্ম-ভাষার মানুষ বসবাস করেন, তাই সেই মাটিতে অনেক রকমের গান-বাজনারচর্চাও হয়। বলা যেতে পারে, একটা সুস্থ স্বাভাবিক মানব সমাজ পূর্ণতা পায় নাচ-গানচর্চার মধ্য দিয়েই।
হুচরি অসমের একটি জনপ্রিয় লোক উৎসব। বৈশাখ মাসের বিহু অর্থাৎ রঙ্গালি বিহুতে পালিত হয়। এই অনুষ্ঠান সংক্রান্তির দিন থেকে টানা সাতদিন ধরে চলে। এই অনুষ্ঠানে শুধু পুরুষরাই অংশ নিতে পারে। হরিনামের গুনগান দিয়েই এই উৎসবের শুরু এবং শেষ হয়। হরিনাম সংকীর্তন করে বছরের শুরুতেই সবার বাড়িতে এক আধ্যাত্মিক এবং আনন্দময় পরিবেশের সৃষ্টি করে। অসমের নৃত্যগীতের কথা উঠলে ‘ওজপলি’ শব্দটির কথা মনে পড়ে। ‘ওজপলি’ অসমের প্রাচীন নৃত্যশৈলীর মধ্যে একটি।
আরও পড়ুন:
অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৪২: অসমের জাতীয় উদ্যান বরাবরই পর্যটকদের নজর কাড়ে
শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন
এই ‘ওজপলি’তে সমাজ জীবনকে কেন্দ্র করে দৈবিক কাহিনি গীতের মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়। ব্যাসদেবের ওজপলি এবং সুকনান্নী ওজপলি এই দুই ধরনের ওজপলি গীত রয়েছে। ব্যাসদেবের ওজপলিতে রামায়ণ এবং মহাভারতের গল্প গানের মধ্য দিয়ে পরিবেশন করা হয়। এতে প্রায় ১৫ জন পালি এবং এক জন ওজা থাকেন। পালি যিনি থাকেন তিনি মূল গায়ক হোন। হাত পা নাচিয়ে গান করেন তিনি। আর বাকিরা তাঁকে ঘিরে থাকে এবং দোহার দিয়ে গানটিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। সুকনান্নী ওজাপালিতে পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল গাওয়া হয়ভি। এই গানে খুব একটা বাদ্য যন্ত্রের ব্যবহার দেখা যায় না।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৪: আশ্রমের আনন্দময় পিকনিক
অসমের কামরূপ, দরং এবং গোয়ালপাড়া জেলায় বিশেষ ভাবে জন প্রিয় নৃত্য দেওধানী নৃত্য। এই নৃত্য নিয়ে অনেক প্রচলিত গল্প রয়েছে। অনেকে বলেন মনসার আক্রোশে বিবাহের রাতেই স্বামী লখিন্দরের প্রাণ হারালে স্বামীর প্রাণ ফিরে পাবার জন্য বেহুলা দেবলোকে গিয়ে দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য যে নৃত্য পরিবেশ করেছিলেন তা হল এই দেওধনী নৃত্য। এই নৃত্যটি ঠিক কবে এবং কোনও জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথমে শুরু হয়েছিল তা বলা শক্ত। বড়ো-কাছাড়িদের মধ্যে দক্ষিণ গোয়ালপাড়ার রাভাদের মধ্যে এই নৃত্য বহু দিন আগে থেকে প্রচলিত রয়েছে। তাছাড়াও অন্য জনজাতিদের মধ্যেও এই নৃত্য প্রচলিত রয়েছে।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৫: বিরোধিতায় নয়, মৈত্রীবন্ধনেই রয়েছে পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানসূত্র
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
এই নৃত্যটির সঙ্গে ধর্মীয় ভাবনা জড়িয়ে রয়েছে। সেই সঙ্গে বলতে হয় দেবদাসী নৃত্যশৈলীর কথাও। ঢলের তালে তাল মিলিয়ে নাচ পরিবেশন করা হয়। এই নাচগুলি অসমের প্রাচীন সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। মূলত মন্দিরের দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে দেবতার সম্মুখে প্রদর্শিত এই দেওদাসী নৃত্যটি একসময় নটী নাচ নামে প্রচলিত ছিল। মেয়েরাই এই নাচে অংশগ্রহণ করতে পারত। দেবদাসীরা মন্দিরের বিগ্রহকেই নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নিয়ে চিরকুমারী হয়ে জীবন অতিবাহিত করতেন।
এই দেবদাসী নৃত্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় প্রচলিত রয়েছে, তবে স্থান বিশেষে নৃত্য ভঙ্গিমা কিছুটা আলাদা হয়। এক সময় পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এই ঈশ্বরের জন্য নৃত্য পরিবেশিত হত। এই নাচটি তাল, লয় মেনে যথেষ্ট নিষ্ঠা ভরে উপস্থাপিত হত। দেবদাসী নৃত্য যে ধরনের গানের সঙ্গে উপস্থাপিত হয় তার সঙ্গে ওজপলি নাচের গানের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখা যায়। অসমের দেবদাসী নৃত্যের সঙ্গে ওড়িশার ওডিসি নাচের এবং দক্ষিণ ভারতের ভরতনাট্যম নৃত্যের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
এই দেবদাসী নৃত্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় প্রচলিত রয়েছে, তবে স্থান বিশেষে নৃত্য ভঙ্গিমা কিছুটা আলাদা হয়। এক সময় পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এই ঈশ্বরের জন্য নৃত্য পরিবেশিত হত। এই নাচটি তাল, লয় মেনে যথেষ্ট নিষ্ঠা ভরে উপস্থাপিত হত। দেবদাসী নৃত্য যে ধরনের গানের সঙ্গে উপস্থাপিত হয় তার সঙ্গে ওজপলি নাচের গানের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখা যায়। অসমের দেবদাসী নৃত্যের সঙ্গে ওড়িশার ওডিসি নাচের এবং দক্ষিণ ভারতের ভরতনাট্যম নৃত্যের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৮: প্রতিভা দেবী—ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৩: বীরবিক্রম ত্রিপুরায় শিক্ষা সম্প্রসারণে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন
অসমে চা এর উৎপাদন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ নিয়ে এসেছিলেন এখানে। তাদের বেশিরভাগ লোকই আর তাদের জন্মমাটিতে ফিরতে পারেননি। বহু বছর ধরে একসঙ্গে থাকতে থাকতে তাদের ভাষাগুলি মিলে মিশে এক হয়ে গিয়েছে। তাদের মনের কথা জীবনসংগ্রামের ছবি ফুটে উঠেছে চা জন জাতির মানুষের টুশু গানে, ঝুমুর গানে। ঝুমুর নাচ মূলত করম পুজোতে কিংবা কোনও আনন্দ উৎসবে করা হয়। ছেলে মেয়েরা হাত ধরা ধরি করে মাদলের তালে তালে গানের সঙ্গে নাচে। জীবনীশক্তিতে ভরপুর এই ঝুমুর গান এবং নাচই এক সময় এই চা শ্রমিকদের অতিরিক্ত সময় অতিবাহিত করার একমাত্র উপায় ছিল। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে জীবনের গান শুনায় এই ঝুমুরের গানগুলি।
ধামাইল নৃত্য।
অসমের বরাক উপত্যকার বাঙালি সমাজে ধামাইল নাচের প্রচলন আছে। এই ধামাইল নাচ মহিলারা বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠানে সমবেতভাবে পরিবেশন করেন। রাধারমণের ধামাইল গান বিশেষ ভাবে জনপ্রিয়। বিবাহ, অন্নপ্রাসন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে এই গান গাওয়া হয়। বেশিরভাগ গানে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের লীলা বর্ণনা হয়েছে। উল্লেখ্য স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং গান্ধীজিকে নিয়ও ধামাইল গান প্রচলিত আছে।
অসমের সাধারণ মানুষের জীবনের কথা অসমের জনজাতিদের গান সমূহে ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে মেনে নিতে হয় লোকসাহিত্যের অনন্য অবদানের কথাও। এই লোকসংগীত, লোকনৃত্য সমূহ আমাদের চির দিনের সম্পদ। এই প্রতিবেদন কয়েকটি মাত্র নৃত্যগীতের সাময়িক আলোচনা হল। কিন্তু বৃহত্তর লোকসাহিত্যের আঙিনায় রয়েছে আরও অনেক লোক সম্পদ।—চলবে।
অসমের সাধারণ মানুষের জীবনের কথা অসমের জনজাতিদের গান সমূহে ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে মেনে নিতে হয় লোকসাহিত্যের অনন্য অবদানের কথাও। এই লোকসংগীত, লোকনৃত্য সমূহ আমাদের চির দিনের সম্পদ। এই প্রতিবেদন কয়েকটি মাত্র নৃত্যগীতের সাময়িক আলোচনা হল। কিন্তু বৃহত্তর লোকসাহিত্যের আঙিনায় রয়েছে আরও অনেক লোক সম্পদ।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।