মঙ্গলবার ৭ জানুয়ারি, ২০২৫


মানস ন্যাশনাল পার্ক।

অসম সবুজের দেশ। পশু-পাখিও রয়েছে অসংখ্য। কোথাও ঘন জঙ্গল তো কোথাও আবার ঘন জন বসতি, সব মিলিয়েই আমাদের অসমের পূর্ণতা। মানুষের আধুনিক জীবনের থেকে অনেক দূরে প্রকৃতির কোলে রয়েছে এই বন্য পশু-পাখিরা। অসমে মোট পাঁচটি জাতীয় উদ্যান রয়েছে। প্রায় ১৫টিরও বেশি অভয়ারণ্য রয়েছে এই রাজ্যে। নানান বনজ উদ্ভিদের সমারোহ অসমের জঙ্গলে।
কাজিরাঙার কথা প্রায় সবারই জানা। এক একশৃঙ্গ গন্ডারের জন্য অসমের কাজিরাঙা বিশ্ব বিখ্যাত। মানস ন্যাশনাল পার্ক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীব জন্তুতে পরিপূর্ণ। এখানে অসমের বহু ধরনের জীব জন্তুদেরকে দেখতে পাওয়া যায়। জনশ্রুতি, এই মানসে পৃথিবীর সূচনা লগ্নের সময়ের গাছপাল রয়েছে। মূলত বাঘ এবং হাতির সংরক্ষণ প্রকল্প রয়েছে এই মানস জাতীয় উদ্যানে। ১৯২৮ সালে বন্য পশুদের সংরক্ষণের জন্য এই জঙ্গলকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তার আগে এই অঞ্চলটি কোচবিহার রাজ পরিবারের অধীনে ছিল। শোনা যায়, গৌরীপুরের মহারাজা শিকারের জন্য এই জঙ্গলে যেতেন। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এই অভয়ারণ্যকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ বলে ঘোষণা করে।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৪১: দেশ বিদেশের পর্যটকরা বছরভর ভিড় জমান কাজিরাঙা রাষ্ট্রীয় উদ্যানে

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি

১৯৯০ সালে জাতীয় উদ্যানে উত্তীর্ণ করা হয় এই মানস বনাঞ্চলকে। এই সব হাতি, একশৃঙ্গ গন্ডার, লাল পান্ডা, চিতা বাঘ, হরিণ, ভল্লুক-সহ অনেক জীবজন্তু রয়েছে। পাখিদের মধ্যে ধনেশ, বেঙ্গল ফ্লোরিকান, ঈগল, রাজ হংস, বুলবুল, পেলিকান-সহ বহু ধরেনের সুন্দর সুন্দর পাখি দেখতে পাওয়া যায়। চিরঙ্গ এবং বাক্সা জেলার কিছুটা অংশ নিয়ে রয়েছে এই অভয়ারণ্য। মানস নদীর পার্শবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত বলে একে মানসই বলা হয়। অভয়ারণ্যের পাশাপাশি মানস নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যায়। ভুটানের সীমানে ঘেঁষে থাকা এই অরণ্যের সৌন্দর্য বর্ণনাতীত।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৪: পরবর্তী পদক্ষেপ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৩: দেবেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ‘কল্পতরু’

ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর দিকে দরং এবং শোনিতপুর জেলার বেশ কিছুটা অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে ওরাং জাতীয় উদ্যান। এখানে যেতে হলে তেজপুর কিংবা গুয়াহাটি থেকেই যাওয়া যায়। তেজপুর বিমানবন্দর থেকে প্রায় ৬৪ কিমি এবং গুয়াহাটি থেকে প্রায় ১৪০ কিমি দূরত্বে অবস্থিত এই উদ্যান। অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আদর্শ সময়। বন্যার সময় এই এলাকার বেশ ক্ষতি হয়। এক একশৃঙ্গ গন্ডার পাওয়া যায় বলে একে মিনি কাজিরাঙাও বলা হয়। এক সময় এই এলাকার স্থানীয় আদিবাসীদের বসতি ছিল। কিন্তু এক মহামারীর জন্য তারা এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যান। তারপর ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার এই বনকে ‘ গেম রিজার্ভ’ অর্থাৎ শিকারের জঙ্গল হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তার পর বাঘের সংখ্যা কমতে দেখে একে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ ক্ষেত্র বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে অভয়ারণ্য হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট

১৯৯৯ সালে জাতীয় উদ্যানে উন্নীত হয় এই ওরাং। ব্রহ্মপুত্র এবং তার বেশ কয়েকটি শাখা-প্রশাখা এই ওরাং-এর ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে। এক একশৃঙ্গ গন্ডার, বাঘ, হরিণ, হাতি এই ওরাং দেখাতে পাওয়া যায়। তাছাড়া নদীর ডলফিন, পেঙ্গলিন বিভিন্ন ধরনের বানর, সজারু, সিভেট, উদবিড়াল, চিতাবাঘ, বিড়াল, বন্য বিড়াল ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণীর বাসভূমি এই ওরাং অভয়ারণ্য। পাখির মধ্যে বেঙ্গল ফ্লোরিকানের, পেলিকান, আইডজাট্যান্ট স্টর্ক, রুবি স্যালডক বা চখাচখি মতো দুর্লভ প্রজাতির পাখিও আছে এখানে। বিভিন্ন ধরনের কচ্ছপ, অজগর, কোবরার মতো সাপও রয়েছে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্র কিশোর

ডিব্রুগড় এবং তিনসুকিয়া জেলার কিছু অংশ নিয়ে অবস্থিত সিটি ডিব্রু-সাইখোয়া জাতীয় উদ্যান অসমের আরও একটি জাতীয় উদ্যান। এক সময় ডিব্রু এবং সাইখোয়া দুটি পৃথক বনাঞ্চল ছিল। ইংরেজ সরকার এই দুই জঙ্গলকেই সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে ঘোষিত করে। পরবর্তীকালে ১৯৯৫ সালে এই দুই অরণ্যের পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চল নিয়ে ডিব্রু-সাইখোয়া অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৯ সালে একে জাতীয় উদ্যানে উন্নীত করা হয়। এটিই ভারতের একমাত্র উদ্যান যেখানে ফেরেল হর্স দেখতে পাওয়া যায়। আসলে এই প্রজাতির ঘোড়া মূলত ইংলেন্ডে দেখা যায়।

ব্রহ্মপুত্রে ‘রিভার ডলফিন’।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য ভারতে আনা হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে ইংরেজরা এই ঘোড়াকে ফেরত না পাঠিয়ে এই জঙ্গলে ছেড়ে দেয়। সেই থেকে এই জঙ্গলে ফেরেল হর্স দেখতে পাওয়া যায়। এই জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রে ‘রিভার ডলফিন’ দেখা যায়। এখানকার গভীর জঙ্গলে বাঘ, ভল্লুক, উদবিড়াল, বন্য বিড়াল, শিকারি বেড়াল, বিভিন্ন প্রজাতির বাঁদর এবং আরও অনেক ধরনের জীব জন্তু দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের পাখিদের বাসস্থান এই অরণ্য। পাখির কলরব এই অরণ্যের ঘুরে বেড়ানোর মজা যেন বাড়িয়ে দেয়। ঘাড় ঘোরালেই দেখতে পাওয়া যায় কোনও না কোনও পাখি। শীতের শুরু হতে না হতেই নানা জায়গা থেকে পাখিরা আসে আতিথেয়তা গ্রহণ করতে। বড় সাদা পেলিকান, কমন কুট-সহ হরেক রকম পাখির সমাগম হয় এখানে ।

অসমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। আর তার উপর যদি সংরক্ষিত বনাঞ্চল নিয়ে কথা বলতে হয়, তা হলে তো আর কথাই নেই। প্রকৃতির হাতছানি এবং প্রকৃতির কোলে তার সন্তান—সব মিলিয়ে যেন সম্পূর্ণতা, যার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা সম্ভবপর নয়। সেই সুন্দর্যকে শুধু যেন দু’ চোখ ভরে দেখতে হয়।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।/strong>

Skip to content