রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


মন্দির।

বরাক উপত্যকায় চারি দিকে যেমন রয়েছে সবুজের মেলা তেমনি রয়েছে বেশ কিছু আকর্ষণীয় স্থান। আর সেই সব স্থানের গল্পও বেশ মজাদার। এই জায়গাগুলিকে একটু যত্ন নিলে হয়ে উঠতে পারে ইতিহাস প্রেমী পর্যটকদের আকর্ষণ কেন্দ্র।

ভুবন পাহাড় বরাকবাসীর কাছে এক বিশ্বাসের নাম। কত মানুষের ভিড় হয় শিবরাত্রির সময়, বরুণী মেলার সময় সেই পাহাড়ে। অসমের তীর্থক্ষেত্রগুলির প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভুবন পাহাড়ের নাম মনে পরে যায়। বরাক উপত্যকার অন্যতম এক তীর্থস্থান এই ভুবন পাহাড়ের উপর অবস্থিত শিব আর ভুবনেশ্বরী দেবীর এই মন্দিরটি। মতিনগর নামক সমতল অঞ্চল পর্যন্ত গাড়িতে করে যাওয়া যায় কিন্তু তার পর থেকে পায়ের হেটেই পাহাড়ে উঠতে হয়। চার পাশে সবুজ ঘেরা অকৃপণ প্রকৃতি রয়েছে।
একসময় সেখানে নাকী পাথরের শিব মন্দির ছিল, কিন্তু বর্তমানে মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হয়েছে। অনেকে মনে করেন এই মন্দিরটি কাছাড়ি রাজার আমলে নির্মিত হয়েছিল। বলা হয়, কাছাড়ি রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র তাঁর সচিব জয়সিংহকে শিব মন্দির স্থাপন করার জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে দেখতে বলেন। তিনি মোট তিনটি স্থানের সন্ধান দেন, একটি জয়পুরের পাশে বর্তমান শিবস্থান বলে পরিচিত অঞ্চিলটিতে, একটি সোনাইয়ের পাশে চন্দ্রগিরিতে এবং অন্যটি ভূপন পাহাড়ে। রাজা ভুবন পাহাড়ে মন্দির নির্মাণের স্বপ্নাদেশ পান।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৩৯: বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা

অভিজ্ঞান-শকুন্তলের নাট্যকার কালিদাস/১

তবে জয়সিংহ অন্য দুটি অঞ্চলেও শিব মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। শিবমন্দির নির্মাণের জন্যই জয়পুরের পাশের অঞ্চলটির নাম হয় শিবস্থান। ভুবন পাহাড়ের মন্দির ছাড়াও একটি গুহা রয়েছে। মন্দিরে ভুবেনশ্বর শিবের উচ্চতা খুব একটা বেশি নয়। দেবালয়ের গায়ে গরুড় এবং আরও এক দুটি মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন পাহাড়ের উপর থেকে বড় বড় শিলা মন্দিরের উপর পড়ায় মন্দিরের অনেক ভাস্কর্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। একটি প্রাচীন কালের যজ্ঞকুন্ডু এখনও মন্দিরে রয়েছে। শিব রাত্রির সময় এই মন্দিরে ভক্তদের ভিড় খুব বেশি হয়। মন্দিরের ওঠার আগে একটি কুণ্ডতে স্নান করে সবাই পুজো করতে মন্দিরে যান।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৯: ভ্রমণে বেরিয়ে মহর্ষি পেয়েছিলেন পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম

বরাক উপত্যকার আরও একটি বিখ্যাত মন্দির হচ্ছে কাঁচা কান্তি মায়ের মন্দির। শিলচর শহর থেকে প্রায় ১২ কিমি দূরে উদারবন্দে এই মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরটি ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত তা সঠিক কেউ বলতে পারেন না। কথিত আছে কাছাড়ের ডিমছা রাজার শাসন কালে এই মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। আবার এও শোনা যায়, কোঁচ রাজা এই মন্দিরের জন্য জমি দান করেন। অনেকের মতে, কাছাড়ি রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র স্বপ্নাদেশ পেয়ে কাঁচাকান্তি মন্দির প্রতিষ্ঠাত করেন। কিন্তু সেই মূর্তিটি নাকি এক জয়ন্তীয়া রাজা হরণ করে নিয়েছিলেন। অনেক দিন একটি খড়্গকে বেদীতে রেখে পুজো করা হত। তার পর বর্তমান মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ডিমাসা শব্দ ‘কাচাউড়ি মাডাই’ থেকে কাঁচাকান্দি হয়েছে। প্রাচীন কালে মন্দিরে নরবলি দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল, সম্ভবত ১৮ শো শতাব্দির শুরুর দিকে এই নরবলি বন্ধ হয়েছিল।

সিদ্ধেশ্বর শিব মন্দি্দ।

বরাক পাড়ের সিধেশ্বর মন্দির উল্লেখ যোগ্য। এই মন্দিরটিও একটি প্রাচীন মন্দির। এটি একটি শৈব মন্দির। বরাকের বদরপুর ঘাট রেলওয়ে স্টেশনের কাছে প্রকৃতির কোলে অবস্থিত এই প্রাচীন শিব মন্দিরটি। মন্দিরটির একেবারে গা ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে বরাক নদী। মন্দিরে একটি শিব লিঙ, এবং শিব পার্বতীর মূর্তিও রয়েছে। লোক মতে, কপিলমুনি এই শিব লিঙটি স্থাপিত করে ছিলেন বলে এই মন্দিরকে কপিলা আশ্রমও বলা হয়ে থাকে। আবার অনেকের মতে স্থানীয় রাজার বিশেষ ক্ষমতা প্রাপ্ত প্রতিনিধি পুরা-রাজা এই আশ্রম এবং মন্দির স্থাপিত করেন। প্রতি বছর মার্চ- এপ্রিল মাসে গঙ্গা পুজোর সময় এখানে বরুণীমেলা বসে। বহু দূর দূর থেকে লোক এখানে আসেন পুণ্যস্নান করতে। এই আশ্রমের দেখা শুনার ভার আশ্রমের সন্ন্যাসীদের উপরই থাকে।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৮: পুত্র বীরেন্দ্রর বিয়েতে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানান মহারাজ রাধাকিশোর

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

কাবুগঞ্জ বাজারের থেকে বেশ কিছুটা ভিতরে রয়েছে কাংলাই পাহাড়। ত্রিপুরা রাজমালাতে এক পবিত্র স্থান হিসেবে এর উল্লেখ রয়েছে। এই পাহাড়ের পাদ দেশে একটি ছোট্ট মনোরম ঝর্ণা থেকে জলধারা নদী হয়ে বয়ে গিয়েছে। নরসিংপুর নামক গ্রামের পাশদিয়ে বয়ে গিয়েছে এই নদী। এই নদী শাল-গঙ্গা নামে পরিচিত। সম্ভবত শৈল গঙ্গা থেকেই এই শাল গঙ্গা শব্দটি এসেছে। নরসিংপুর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত পালংঘাট গ্রাম। সেখানে রয়েছে পুরনো দুই মন্দির। সময়ের হাত ধরে মন্দির দুটো আছে ঠিকই কিন্তু জংলী গাছ পালায় ঢেকে গিয়েছে। রুক্মিণী নদীর তীরে অবস্থিত এই মন্দির দুটিতে বরুণী মেলার সময় অনেক দূর দূর থেকে লোকজন আসেন। স্থানীয় মানুষেরা বিশ্বাস করেন যে এই নদীর জল অতি পবিত্র। কুকি সম্প্রদায়ের লোকেরা বাঁশের ভেতর পরিষ্কার কোরে নিয়ে বোতলের মতো করে এই নদীর জল নিয়ে বাড়িতে রাখেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন

বরাক উপত্যকায় সুন্দর প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে অতীতের চিহ্ন। বদরপুর ফোর্ট বা বদরপুর কিল্লাও পুরনো দিনের গল্প শোনায়। অনেকে বলেন, বদর উদ্দীন শাহ নামক এক মুসলমান পীরের মোকাম ছিল। শোনা যায়, বদরপুর ফোর্টের পাশে এই মোকাম ছিল কিন্তু এখন রেল লাইন ছাড়া আর কিছুই নেই পাশেই বয়ে চলেছে বরাক নদী। এখানে নদীর গভীরতা খুবই বেশি। মাঝিরা বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পীর বাবাকে স্মরণ করেন। বলা হয়, এই পীর বাবার নামেই বদরপুরের স্থান নাম হয়েছে। এই বদরপুরের ফোর্টটির গায় লিখা রয়েছে ১২০৭ সাল এবং ক্যাপটিন।

সিদ্ধেশ্বর শিব মন্দিরের পিছনে নদী।

নদী পাহাড় ঘেরা এই বরাক উপত্যকায় প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে ইতিহাসের অনেক না জানা গল্প গাঁথা। সেই গল্প গুলি শুধুই লোমোহর্ষক। প্রকৃতি আর ইতিহাস দুই মিলে সাজিয়ে তুলেছে অসমের বরাক উপত্যকাকে। —চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content