মেজি দহন ও বিহু নৃত্য।
সবুজে ঘেরা অসমের মানুষও প্রকৃতির মতোই সুন্দর মনের অধিকারী। তাই তো অসমের জাতীয় উৎসব বিহু যথেষ্ট প্রাণোচ্ছল এক উৎসব। যে উৎসব মানুষের প্রাণের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। নাচ ও গানের মধ্য দিয়েই সম্পূর্ণতা পায় এই বিহু উৎসব। অসমে বিভিন্ন জাতি-উপজাতির সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ দেখা যায়।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই উৎসবের সংখ্যাও বেশি। প্রত্যেক জাতি-উপজাতির নিজস্ব উৎসব রয়েছে। একে অন্যের উৎসবে যোগদান করে সেই উৎসবকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলেন। বিহু এমন একটি উৎসব যা জীবনী শক্তিতে ভরপুর। নাচ গান, খাওয়া-দাওয়া সব কিছু মিলে বিহুর পূর্ণতা।
এই বিহু শব্দটি নিয়ে নানা মুনীর নানা মত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন সংস্কৃত ‘বিষুবত’ শব্দ (যার অর্থ হচ্ছে যখন দিন রাত্রি সমান হয়) থেকে উৎপন্ন। বিষ্ণু প্রসাদ রাভার মতে, বিহু শব্দটি ডিমাসাদের মধ্যে প্রচলিত শব্দ। তারা তাদের দেবতা ব্রাই শিবরাইকে নিজেদের উৎপাদিত শস্য উৎসর্গ করে আশীর্বাদ কামনা করেন। ‘বি’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে প্রার্থনা করা, ‘শু’ শব্দটির অর্থ শান্তি এবং সমৃদ্ধি। এই বিশু শব্দ থেকে বিহু শব্দ এসেছে। বিহু শব্দটির প্রকৃত উৎস সম্পর্কে বলা শক্ত। আহোম রাজাদের সময় থেকেই এই বিহু উৎসব পালিত হয়ে এসেছে। বিহু মূলত কৃষি কেন্দ্রিক উৎসব।
এই বিহু শব্দটি নিয়ে নানা মুনীর নানা মত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন সংস্কৃত ‘বিষুবত’ শব্দ (যার অর্থ হচ্ছে যখন দিন রাত্রি সমান হয়) থেকে উৎপন্ন। বিষ্ণু প্রসাদ রাভার মতে, বিহু শব্দটি ডিমাসাদের মধ্যে প্রচলিত শব্দ। তারা তাদের দেবতা ব্রাই শিবরাইকে নিজেদের উৎপাদিত শস্য উৎসর্গ করে আশীর্বাদ কামনা করেন। ‘বি’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে প্রার্থনা করা, ‘শু’ শব্দটির অর্থ শান্তি এবং সমৃদ্ধি। এই বিশু শব্দ থেকে বিহু শব্দ এসেছে। বিহু শব্দটির প্রকৃত উৎস সম্পর্কে বলা শক্ত। আহোম রাজাদের সময় থেকেই এই বিহু উৎসব পালিত হয়ে এসেছে। বিহু মূলত কৃষি কেন্দ্রিক উৎসব।
আরও পড়ুন:
অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৩৬: অসমের শিল্পকলা
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— রামবাণ ও পানি তাঙ্কি
বহাগ বিহু বা রঙ্গালী বিহু আনন্দের উৎসব। তবে একথা সত্য, সব উৎসবই আনন্দের উৎসব, কিন্তু রঙ্গালী বিহু শব্দটি সোনা মাত্রই মন যেন নেচে উঠে। এ যেন গানের তালে তালে যৌবনের জয় গান গাওয়ার পার্বণ। সাত দিন ধরে পালন করা হয় এই বিহু। চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু করে বৈশাখের ৬ তারিক পর্যন্ত পালিত হয় এই উৎসব। কৃষকরা তখন ধান উৎপাদনের জন্য জমিকে চাষের উপযোগী করেন। মহিলারা চাল দিয়ে পিঠা, নাড়ু এবং বিভিন্ন ধরনের খাবার প্রস্তুত করেন। বিন্নী ধান এবং নারকেল সহযোগে পাটিসাপটার মতো এক ধরনের শুকনো পিঠা তৈরি করা হয়। সংক্রান্তির দিন গরুকে পুজো করা হয়। গরুকে অনেক কিছু খেতে দেওয়া হয়। তার পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের দিন পুজো করে নতুন কাপড় পরিধান করে যুবক যুবতীরা নাচ গানের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার
দ্বিতীয় বিহু হচ্ছে কাতি বিহু বা কঙ্গালী বিহু, যা পালন করা হয় কার্তিক সংক্রান্তির দিনে। এর নাম থেকেই এই উৎসব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করে নেওয়া যায়। আসলে এই সময় কৃষিকাজ খুব একটা ভালো হয় না। ক্ষেতের চাষ উপযোগী তেমন কিছুই থাকে না, আঊশ ধানের চাষও শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই এই সময় নতুনের আহ্বান করা হয়। বাড়ির তুলসী থান, শস্য ভাণ্ডার, ক্ষেত সব জায়গায় মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করা হয়। লম্বা বাঁশের ডগায় প্রদীপ জ্বালিয়ে আকাশের দিকে দিয়ে পূর্বপুরুষের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৪৯: হোটেলের বাথটাবে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করেন অভিনেত্রী কৌশিকী
তৃতীয় বিহু হচ্ছে মাঘ বিহু বা ভোগালী বিহু। মাঘ বিহু শব্দটি থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এই বিহু মাঘ মাসে পালন করা হয়। আর ভোগালি শব্দটির সাথে ভোগ শব্দের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সুতরাং বুঝতে অসুবুধে হয় না যে, এই বিহু মাঘ মাসে পালিত হয় আর এই বিহুতে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হয়। ভোগালি বিহু তিন দিন ধরে পালন করা হয়।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
শেষ পৌষের সুন্দর রোদ গায়ে লাগিয়ে সংক্রাতির দিন ছেলেরা ক্ষেতের খড় দিয়ে বাঁশ দিয়ে এক ধরনের ছোট্ট ঘরের মতো তৈরি করে। রাতে সেখানে সবাই জড় হয়ে আগুন জ্বালিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে এবং বিহু গান করেন। অনেক সময় অল্প বয়সী ছেলেরা এখানেই দল বেঁধে রাত্রি যাপন করেন। পরের দিন সকালে স্নান করে পুজো করে সেই খড় নির্মিত ‘ভেলাঘর’টি জ্বলিয়ে দেওয়া হয়। একে বলা হয় মেজি দাহন। এই আগুন পিঠে, সুপুরি ইত্যাদি ছুড়ে ফেলা হয়। তার পর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সেই আগুনের কাছে উন্নত মানের ফসলের জন্য প্রার্থনা করেন।
ভোগালি বিহুর পিঠে।
বিহু উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হচ্ছে বিহু নাচ আর বিহু গান ।অসমিয়া লোক নৃত্য হচ্ছে বিহু নাচ। স্বর্গদেউ রুদ্র সিংহের পৃষ্ঠ পোষকতায় এই নাচের বিশেষ প্রদর্শন হয়েছিল। ছেলমেয়েরা মিলেই এই নৃত্য পরিবেশন করেন। এই বিহু গানে বাদ্য যন্ত্রের মধ্যে ঢোলে ব্যবহার লক্ষণীয়। তাছাড়া মোষের শিং দিয়ে তৈরি পেপা এবং বাঁশের তৈরি টোকা বাদ্য যন্ত্রের ব্যবহার হয়। মাটির তৈরি সুতুলি, ভায়োলিনের মতো দেখতে বিন। আরও অনেক রকম বাজনা বাজানো হয়। মুগার মেখলা চাদর পরিহিত মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে খুব সুন্দর করে নৃত্য পরিবেশন করে। বিহু নাচ যেমন ভারতের লোকনৃত্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, তেমনি বিহুগীত এবং সংগীত প্রেমীদের হৃদয় স্পর্শ করে।—চলবে।
*ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।