শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


কারেংঘর।

আমরা ইতিহাসের চিহ্ন যখন আধুনিক সমাজে দেখতে পাই, তখন তার প্রতি আগ্রহ আমাদের বেড়েই যায়। আমরা সেই অতীতের পদচিহ্ন খুঁজে দেখতে বার বার যাই। অসমের বিভিন্ন জায়গায় অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সেই স্থানকে কেন্দ্র করে অনেক গল্পও। শিবসাগর জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে, ফেলে আসা দিনের অনেক চিহ্ন। এমনই এক ঐতিহাসিক জায়গার নাম গড়গাঁও। জায়গাটি শিবসাগর শহর থেকে প্রায় ১০ থেকে ১২ কিলমিটার দূরে অবস্থিত। দীর্ঘদিন অহোম রাজাদের রাজধানী ছিল এই গড়গাঁও। এখানে রাজা শুক্লেনমুং রাজধানী স্থাপিত করেন এবং কারেংঘর নামের একটি রাজভবন নির্মাণ করেন। কারেংঘর ছিল রাজার আমোদ প্রমোদের প্রাসাদের ঘর। সেখানে মূলত নৃত্যগীতচর্চা হত। কারেং একটি আহোম শব্দ যার অর্থ হল নর্তকীর ঘর।
এই ভবনটি শুধুই একটি প্রাসাদ ছিল না। এর ভিতরে রাজকার্য পরিচালনা করার জন্য একাধিক ব্যবস্থা ছিল। মাটির নিচেও বেশ নির্মাণ কার্য রয়েছে, যা আজও সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করে। মূল প্রাসাদটি সাত তলার ছিল, যার মধ্যে তিনটি তলা ছিল মাটির নিচেই। এই প্রাসাদে বহুমূল্যবান রত্ন দিয়ে অপূর্ব কারুকার্য করা সিংহাসন ছিল। স্বর্গদেও জয় সিংহ (১৬৪৮- ১৬৬৩ সাল) রাজত্বকালে মোঘল সেনাপতি মির্জুমলাই অসম আক্রমণ করে গড়গাঁও দখল করেছিল। লড়া রাজা স্বর্গদেও রত্নধ্বজ সিংহের রাজত্বকালে গড়গাঁও এ আহোম রাজাদের রাজধানী ছিল।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৩২: পাখিদের আত্মহত্যার ঠিকানা জাতিঙ্গা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬২: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— সুখদর্শন ও হুড়ো

স্বর্গদেও গদাধর সিংহ গড়গাঁও থেকে রাজধানী বরকলা নগরে স্থানান্তরিত করেন। পরে তাঁর পুত্র স্বর্গদেও রুদ্রসিংহ আবার রংপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। বর্তমানে যে কারেংঘরটি রয়েছে তা স্বর্গদেও রাজেশ্বর সিংহের আমলে নির্মিত। তখন রাজধানী ছিল বর্তমান জয়সাগরের নিকট অবস্থিত রংপুরে। তবে প্রসাশনিক অনেক কাজ এই গড়গাঁও থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হত।

কারেংঘরটি মোট সাত তলার ছিল বলে জানা যায়। তার তিনটি তলা মাটির নিচে এবং চারটি তলার মহল মাটির উপরে রয়েছে। ইংরেজরা এই কারেংঘরের অনেকটা ক্ষতি করে দিয়েছে। শোনা যায়, এই কারেংঘরে মাটির নিচে একটি সুড়ঙ্গ ছিল, যা দিখৌ নদীতে পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সুড়ঙ্গ এখন আর আছে বলে মনে হয় না। ইতিহাসের এক অনবদ্য নজির এই কারেংঘর, যা আহোম রাজা সৌর্যের গল্প শোনায়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৫: পতন আসন্ন হলেই সবার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়

দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা

কারেংঘরের কথা বলতে গেলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই আরও একটি জায়গার নাম মনে পড়ে যায়। সেটা হল রংপুরের তলাতল ঘর। এক সময় আহোমদের রাজধানী এখানেও ছিল। রাজা রুদ্র সিংহ কোচবিহার থেকে একজন কারিগর আনিয়ে এক মনোহর নগর নির্মাণ করেন। তিনি তার নাম দেন রংপুর। শিবসাগর জেলার রংপুরেই প্রথম ইট-পাথর দিয়ে প্রাসাদ নির্মাণ শুরু হয়। এই রংপুরের এক অন্যতম নিদর্শন হল তালাতল ঘর। স্বর্গদেও রাজেশ্বর সিংহ নির্মিত এই তলাতল ঘর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও।

তলাতল ঘর।

তবে অতীতের সেই নিদর্শন আজ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস প্রেমী মানুষের জন্য এক আকর্ষণীয় বিষয়ও বটে। এই তলাতল ঘরও মোট সাত তলার। মাটির উপরিভাগে রয়েছে চারটি এবং মাটির নিচে রয়েছে তিনটি। এর ভিতরকার রাস্তা খুব একটা সহজ নয়। এক বার ভিতরে প্রবেশ করলে বাইরে বেরিয়ে আসার সময় রাস্তা গুলিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ সেখানে প্রবেশ করলে এর ভিতরেই ঘুরপাক খেতে থাকবেন। তিন তলা থেকে একটি সুড়ঙ্গ নদীর তীর পর্যন্ত গিয়েছে। মূলত শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পওয়ার জন্যই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৯: শ্রীমায়ের ভক্তের গ্রামে তীর্থদর্শন

বর্তমানে এই আশ্চর্য নিদর্শনটি প্রাচীনকালের এক ভগ্ন প্রাসাদে পরিণত হয়েছে। এই তলাতল ঘরে রাজাদের পরিবার পরিজনেরা যেমন থাকত তেমনি মাটির নীচের একটি তলায় ছিল ঘোড়াশাল, গুদাম ঘর এবং আরও অনেক কিছু। প্রতিটি কাজের জন্য ছিল নির্দিষ্ট দুয়ার। যেমন: বড় দুয়ার, মাটি ঘর দুয়ার, গোঁসাই ঘরের দুয়ার, নাচনী দুয়ার ইত্যাদি। শিবসাগর জেলায় ইতিহাসের অনেক চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। শিবসাগর শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলমিটার দূরে একটি শিলা নির্মিত সেতু রয়েছে। প্রজাদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য এই অদ্ভুত সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এই সেতুর গায়ে রয়েছে খুব সুন্দর ভাস্কর্যের নিদর্শনও। এই সেতু আজও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। ‘নামডাং’ নামে বিখ্যাত এই সেতুটি রাজা রুদ্র সিংহের সময় নির্মিত হয়। আহোম রাজত্বকালে এই ধরনের নির্মাণকার্যের জন্য নাগা পাহাড় থেকে শিলা নিয়ে আসা হত।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

শিবসাগর শহর থেকে একটু দূরেই রয়েছে জয়সাগরের জয়দল। সতী জয়মতীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই বিশাল জলাশয়টি তাঁর বড়ছেলে রুদ্র সিংহ নির্মাণ করান। জয়মতি গদাপানী কোয়ারের স্ত্রী ছিলেন। অত্যাচারী লরা রাজার হাত থেকে আহোম রাজত্বকে রক্ষা করার জন্য তিনি লরা রাজা জয়মতীকে জেরেডাং পাথার নামক স্থানে নিয়ে গিয়ে অকথ্য অত্যাচার করেন। জয়মতী সব সহ্য করেও নিজের ছেলে এবং স্বামীর ঠিকানা গুপ্ত রাখেন। জয়মতী সেই নির্যাতনে প্রাণ ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর লরা রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে সিংহাসন ফিরিয়ে নেন তাঁর স্বামী। গদাপানীর মৃত্যুর পর তাঁদের বড় ছেলে রুদ্রসিংহ রাজা হন। বলা হয়, রুদ্র সিংহ আহোম রাজাদের মধ্যে প্রজাবৎসল রাজা হিসেবে অন্যতম।

শিলা দিয়ে নির্মিত নামডাং সেতু।

অসমের স্থাপত্য-ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে আহোম রাজারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে গিয়েছেন। এই সব স্থাপত্যের অনেকটাই যেমন সময়ের সঙ্গে নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তেমনি অনেক ঐতিহাসিক স্থাপত্য এখনও ঠিকঠাক আছে। হয়তো অতীতের গল্প বয়ে নিয়ে চলেছে এই প্রাসাদ, অট্টালিকা কিংবা সেতু, যেগুলি কিছুটা যত্নের স্পর্শ চায়। একটু সংরক্ষণশীল মানসিকতা নিয়ে স্থাপত্য-ভাস্কর্যগুলিকে রক্ষা করলে হয়তো ভবিষ্যতের জন্যও সংরক্ষিত হয়ে থাকবে অতীতের গৌরব গাঁথা এই ইতিহাস। —চলবে।
*ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content