বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


মানুষের মন সব সময় কৌতুহলী। তাই আমরা অস্বাভাবিক কিছু দেখলে বা শুনলে তাকে আরও বেশি করে জানতে চাই। জাদুবিদ্যা, তন্ত্র সাধনা, প্ল্যানচেট ইত্যাদির সত্যতা নিয়ে আমাদের মনে অনেক সময় প্রশ্ন জাগে। ছোট শিশু যেমন ‘তার পর কী হল’ বলতে বলতে বড়দের কাছে গল্প শুনে, তেমনি বড়রা বিজ্ঞানের হাত ধরে এগিয়ে গেলেও এমন অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে চান যার উত্তর খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হয়ে উঠে। অসমের সঙ্গে এমন ধারণা দীর্ঘ দিন ধরে জড়িয়ে রয়েছে।
অসমকে নিয়ে এমন অনেক গল্প শোনা যায়, যা আদৌ কখনও ঘটে ছিল কি না, কে বলতে পারে। অসমের এক বার কোনও এক রাজা যুদ্ধ করার জন্য সৈন্য সামন্ত নিয়ে আসছিলেন। কিন্তু কোনও এক পাহাড়ে নাকি চড়াই করতে গিয়ে নাকি সমস্ত সেনাবাহিনী অদৃশ্য হয়ে যায়। তাদের কোনও চিহ্ন মাত্র আর কেউ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা আমাদের জানা নেই। কিন্তু এমন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অসমকে নিয়ে আমাদের আগ্রহের কোনও শেষ নেই।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব ৩০: ভক্তি আন্দোলনে শঙ্করদেব ও মাধবদেব

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৫: আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া

অসমের তন্ত্র সাধনার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে রয়েছে মায়ং-এর নাম। মায়াং নাম শুনলেই কেমন এক ভয় মিশ্রিত কৈতুহল জাগে মনে। মরিগাঁও জেলার মায়ংকে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত তন্ত্রবিদ্যার জন্য প্রসিদ্ধ। ১৫শ’ শতকে কাছাড়ি রাজা এখানে মায়ং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কথিত আছে, মায়াং এবং ডিমরিয়া রাজার মধ্যে প্রবল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু মায়াংদের মন্ত্র শক্তির সামনে ডিমরিয়ার সৈন্যরা বেশি সময় টিকতে পরেনি।

বলা হয়, তান্ত্রিকরা, রাক্ষস রাক্ষসীরা না কি সেই মহাভারতের যুগ থেকে মায়াং-এর জঙ্গলে আশ্রয় নেন। মানুষকে পশুতে রূপান্তরিত করা কিংবা অদৃশ্য করে দেওয়া এখানে নাকি খুব স্বাভাবিক ভাবেই ঘটত। জাদুবিদ্যা, তন্ত্র সাধনা উত্তরাধিকার সূত্রে সেখানো হয় এখানে। উল্লেখ্য, বহুদিন ধরে এখানে নরবলি দেওয়া হত। এখানে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত মায়ং সেন্ট্রেল মিউজিয়াম অ্যান্ড এম্পোরিয়ামে তন্ত্র সাধনার অনেক বই এবং কিছু জিনিসপত্র রয়েছে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্র সাধনা আসলে কী? দেহ-মনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জিজ্ঞাসা এবং তার সমাধান লাভের কঠিন প্রয়াসকে তন্ত্র সাধনা বলা যেতে পারে। মূলত ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যেমন সম্পত্তি বৃদ্ধি, রোগ নিরাময়, কিংবা অন্য কোনও কিছু প্রাপ্তির জন্য এই সাধনা করা হয়ে থাকে। তন্ত্র সাধনা এবং মন্ত্র অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। তন্ত্র সাধনায় এক জন উপাস্য দেবতা থাকেন। মন্ত্র, মুদ্রা, যন্ত্র, মণ্ডল ইত্যাদি অনেক রকম জিনিস এই সাধনার অঙ্গীভূত। ধারণী মন্ত্র, সর্বচাক মন্ত্র, সুদর্শন মন্ত্র, পক্ষীরাজ মন্ত্র ইত্যাদি বহু ধরনের মন্ত্র লিখিত রূপ অসমীয়া ভাষায় অনেক পাওয়া গিয়েছে। এই মন্ত্রগুলি ঠিক কবে রচিত হয়েছিল তা বলা মুশকিল তবে দশম একাদশ শতকে এই মন্ত্রগুলির প্রচলন ব্যাপক ভাবে ছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। প্রচলিত মত অনুযায়ী, অশরীরী শক্তি, ভূত-প্রেত, ডাইনি এদের সন্তুষ্ট করে তাদের দিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করানোর চেষ্টা করা হয় এই তন্ত্র সাধনায়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

জনশ্রুতি, একসময় গোটা কামরূপ যাদু -মন্ত্র, মায়াবিদ্যা, বশীকরণ ইত্যাদির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। আর এই মায়াং ছিল এই তন্ত্র সাধনার মূল কেন্দ্র। অতিথিকে রাতে ছাগল বানিয়ে বন্ধি করে রাখা, মরা মাছকে বাঁচিয়ে তোলা কিংবা মন্ত্র বলে করো চরম ক্ষতি করার অনেক প্রচলিত গল্প আজও মায়াংকে নিয়ে রয়েছে। এই সমস্ত গল্পের সত্যতা কিংবা প্রণাম সাপেক্ষ্য কিছু আছে কি না তা জানা নেই। মায়াং-এর তন্ত্র সাধক দের বেজ বলা হত। মায়ং-এ অনেক পুরনো মন্দির এবং প্রাচীন মূর্তি রয়েছে। এই সমস্ত নিদর্শনের নির্মাণ কাল ঠিক কবে তা অনুমান করা যায় না। কোথাও বা অতীতের চিহ্ন বহন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোনও ভগ্ন মন্দির আবার কোথাও বা শিব আর উমার অদ্ভুত মূর্তি ১০ ফুট উচ্চতার এক গণেশের মূর্তিও দেখতে পাওয়া যায় কাছশিলা পাহাড়ে। প্রকৃতির অকৃপণ দান রয়েছে এই মায়াং-এ। বিভিন্ন জনজাতির লোকজন দীর্ঘদিন ধরে শান্তি পূর্ণ ভাবে বসবাস করছেন এখানে। রয়েছে দারুণ সুন্দর একটি অভয়ারণ্য যেখানে এক শিং এর গন্ডার মূল আকর্ষণ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৬: বার্নার্ড শ ও শার্লটি —তবে কেন মিছে ভালোবাসা/২

বিজ্ঞানের উন্নতির ছোয়া দেখতে পাওয়া যায় মায়াং-এর সাধারণ মানুষের মধ্যেও। অসমের জাদুবিদ্যা, বানমারা-এ সমস্ত গল্প পাঠকের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করলেও এ কথা কিন্তু আমাদের মেনে নিতে হয় যে এমন ঘটনার কোনো নির্ভরযোগ্য প্রামাণ্য তথ্য সামনে আসেনি। কোনও কিছুই যে আসলে বিজ্ঞানের বাইরে হতে পারে না সে কথা মেনে নিতেই হয়। তন্ত্র সাধনা এক ধরনের বিশেষ সাধনা পদ্ধতি কিন্তু বান মারা কিংবা মানুষকে পশু করে দেওয়া এ সমস্ত ঘটনা যে ঠিক কবে কার সঙ্গে বা কার নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে ঘটে ছিল তা কিন্ত জানা যায় না। মায়াং-এ যে সমস্ত প্রাচীন মন্ত্রের বই কিংবা মূর্তি ইত্যাদি রয়েছে তা আসলে বিস্তৃত গবেষণার দাবি রাখে। হয়ত অতিদের কোনও না বলা না শোনা গল্প লুকিয়ে রয়েছে এ অঞ্চল। অভয়ারণ্য, প্রকৃতি এবং প্রত্নতাত্যিক বিভিন্ন আকর্ষণ সব কিছু মিলিয়ে মায়াং ভ্রমণ প্রেমী মানুষের জন্য হওয়া উচিত বিশেষ আকর্ষণীয় স্থান।—চলবে।
*ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।।

Skip to content