শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। করিমগঞ্জ। কুশিয়ারা নদী।

ইতিহাস সব সময়ই গৌরবোজ্জ্বল হয় না। কখনও কখনও অতীতের কিছু পাতায় লেখা থাকে অন্ধকারময় সময়ের কথা। অসমের মাটিতে বিভিন্ন ভাষার লোক অনেককাল থেকেই একসঙ্গে বসবাস করেছেন। একে অন্যের ব্যক্তি স্বতন্ত্রতাকে জাতিগত পিরিচয়কে সম্মান জানিয়েছেন। কিন্তু দেশভাগের সময় থেকে কিছু কুচক্রী মানুষের জন্য সেই ভ্রাতৃত্ববোধে ভাটা পড়ল। তীব্র জাতীয়তাবাদ অসমের শান্তি নষ্ট করে দিয়েছিল। সে সব এখন পুরনো কথা। আজ অসম শান্তিপূর্ণ একটি রাজ্য। এখানে সবাই নিজের নিজের জাতিগত ঐতিহ্য বজায় রেখে একসঙ্গে মিলে মিশে রয়েছে।
তবে যে গল্প ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে গিয়েছে সময়ের সেই সত্যতাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় যে নেই। দেশ বিভাজনের ফলে অসমের একটি বড় জেলা পাকিস্তানে চলে যায়। কিন্তু তাতে অসমের নেতাদের মধ্যে কোনও রকম ক্ষোভ বা আক্ষেপ দেখা যায়নি। অসমের একটি সমৃদ্ধশালী জেলা ছিল সিলেট। সিলেট পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ফলে রাজস্বের ক্ষতি স্বীকার করেও জাতীয়তবাতী ভাবনাকে গুরুত্ব দিলেন অসমের তৎকালীন নেতারা। গোপীনাথ বড়দলই সিলেটকে পাকিস্তানের সীমানায় দিতে কোনও রকম আপত্তি করেননি।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো অন্ধকার পর্ব ২৪: দেশভাগ এবং অসম

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

সিলেটে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লোকই ছিল। কোথাও কোথাও হিন্দু আবার কোথাও কোথাও মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন বেশি ছিল। সুতরাং বিভাজনের সীমানা নির্ধারণের জন্য ভোটের আশ্রয় নেওয়া হয়। মাউন্ট ব্যাটেনের ভারত বিভাজন পরিকল্পনার নির্দেশ অনুযায়ী ভোট হয়। মুসলিম লিগের নেতা নিজামউদ্দিন ভোটের জন্য হয়েছিল। সেই ভোটে চা বাগানের শ্রমিকদেরকে ভোটাধিকার দেওয়া হয়নি। নিজের পূর্বপুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে বহু বছর ধরে যারা এ অঞ্চলে বসবাস করছিল। আপন করে নিয়েছিল এই অঞ্চলেকে। সেই চা বাগান শ্রমিকদেরকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার যুক্তি স্পষ্ট হল না। ১৯৪৭সালের ৬ এবং ৭ জুলাইয়ের সেই ভোটের ফলে অসমের এক সমৃদ্ধশালী জেলা সিংহভাগ চলে গেল পূর্ব পাকিস্তানে। ভারত বিভাজনের দুঃজনক ইতিহাসে সিলেটের গণভোট এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল। বেঙ্গল কমিশন ভারত এবং বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণের ভারপ্রাপ্ত হয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১৬: কংগ্রেসের নেতৃত্বে দুটি জোট সরকার

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

গণ ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অসম এবং বর্তমান বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সীমানায় কোন অংশ যাবে, আর কোন অংশ বাদ পড়বে। ধর্মের ভিত্তিতে হওয়া দেশভাগের ফলে হাজার হাজার মানুষ রাতারতি গৃহহারা হয়ে গেল। সিলেট ছিল অসমের অন্তর্ভুক্ত বাংলা ভাষী জেলা, হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের লোকই ছিল সিলেটে। অসমকে অসমীয়া মুক্ত রাখতে তখনকার জননেতারাও স্বচেষ্ট ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালের ৩ জুলাই ঘোষণা করে যে, ৬ জুলাই গণভোট হবে। এইচসি স্টককে গণ ভোটের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ব্রিগেডিয়ার মহিন্দর সিং চোপড়াকে গণভোট শান্তিপূর্ণ রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

ভোটের ফলাফল অনুযায়ী সিলেটের বেশিরভাগ অংশ চলে যায় পূর্বকিস্তানে। করিমগঞ্জ ভারতে থেকে যায়। জকিগঞ্জও ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক টানাপোড়নে বাংলাদেশের অন্তরভুক্ত হয়। সিলেট সদর, সুনামগঞ্জ, করিমগঞ্জ, হবিগঞ্জ, দক্ষিণ সিলেট বা মৌলবীবাজার নিয়ে ছিল স্বাধীনতা উত্তর সিলেট। ১৯৪৭ সালের সিলেট রেফারেন্ডামে করিমগঞ্জের রাতাবাড়ি, পাথরকান্দি, বদরপুর থানা এবং করিমগঞ্জ থানার কিছু অংশ ছাড়া সিলেটের বাকি আংশ চলে যায় বর্তমান বাংলাদেশের সীমানায়। অর্থাৎ অসমের একটি বিরাট অংশ চলে গেল পূর্বপাকিস্তানে। দেশ স্বাধীন হল, কিন্ত সেই স্বাধীনতা নিয়ে এল ঘরছাড়া হওয়ার যন্ত্রণা, উদ্বাস্তু সমস্যা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। দেশ তবু বেঁচে থাকল মনের মধ্যে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৭: পাঞ্চালদেশে যাত্রাপথে পাণ্ডবদের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় কিসের ইঙ্গিত?

হাজার হাজার মানুষ অসমে চলে এলেন তাঁদের ভবিষ্যৎ গড়ে নিতে। মাটি তো মা, তাই মা বুকে টেনে নিলেন তাঁর স্বর্বহারা সন্তানদের কিন্তু প্রাদেশিকতার আঘাতের শিকার হতে থাকলেন গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাঙালি। সেই ফেলে আসা দেশ ধীরে ধীরে জায়গা করে নিল ঠাকুমা-দিদিমাদের গল্পে। একটি না দেখা দেশ অচেনা হয়ে রইল না। সিলেটের স্মৃতি সব সময় মনের মধ্যে থাকল। আর সেটাই তো স্বাভাবিক, কারণ স্বাধীনতা সংগ্রামী থেকে শুরু করে আপামর সাধারণ মানুষতো অখণ্ড স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। দিদা-ঠাকুমার গল্প জুড়ে ছিল বাসুদেব বাড়ি, ভৈরব মন্দির। কিন্তু ভারতীয় হয়ে থাকার জন্য দেশ ছাড়া হতেও রাজি ছিলেন সিলেটের বাঙালিরা, অর্থাৎ তৎকালীন অসমের সিলেটের বাঙালিরা।

নদীর ওপারে বাংলাদেশ।

স্মৃতি এবং নিত্য নুতন প্রতিকূল পরিস্থির সম্মুখীন হয়েও সম্মুখীন হয়েও বাংলার ঐতিহ্যকে বাংলা ভাষাকে সব সময় প্রাধান্য দিয়েছেন অসম তথা গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চলের মানুষ। প্রাদেশিকতা জাতীয়তাবাদী ভাবনার হাত থেকে অনেক বাঙালিই শেষ রক্ষা পাননি। ‘বঙ্গাল খেদা’ এর নামে বঙ্গভাষীকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। অসমের আলো-অন্ধকারের ইতিকথাতে এই দেশভাগ কেন্দ্রিক বাঙালির বিপর্যয় এক অন্ধকার সময়ের পর্বই বটে। তবে সেই অন্ধকারকে ভেদ করেই তো জন্ম নিল উনিশে মে। উনিশে মে যেমন ১০ জন ভাই এবং এক বোনার সঙ্গে সঙ্গে অসমের অসংখ্য বাঙালির লড়াইয়ের কাহিনি শোনায়, তেমনি প্রজন্মের পর প্রজন্মের মনে জাগিয়ে রাখে আশার আলোও।—চলবে।
ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content