মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সভা, ৩০ আশ্বিন ১৩১২ বঙ্গাব্দ।।

দীর্ঘ দিনের সংঘর্ষের পর এল স্বাধীনতা। সেই সঙ্গে এল দেশভাগের যন্ত্রণা। সর্বস্ব হারিয়ে রিফিউজি ক্যাম্পে যেতে হল শত সহস্র মানুষকে। অসমেও দেশভাগের আঁচ এসে লেগেছে। বর্তমান বাংলাদেশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান অসমের দক্ষিণ দিকে রয়েছে। সেই সময় অসমের আয়তন যথেষ্ট বড়ই ছিল। এখনকার বরাক উপত্যকা অসমের অংশ হলেও বহুকল থেকে এ এলাকা মূলত বাঙালি প্রধান অঞ্চল।

দেশভাগে সঙ্গে সঙ্গে এ এলাকার মানুষের ভাগ্য বিড়ম্বনা শুরু হয়ে গেল। আসলে ১৮৭৪ সালে ইংরেজ আমলে শাসন কার্যের সুবিধার্থে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, বেশ কিছু পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে অসম প্রদেশ গঠন করা হয়। রাজনৈতিক প্রয়োজনে বাংলার শ্রীহট্ট জেলাকে তৎকালীন অসমের প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইংরেজ সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করা। কিন্তু এ অঞ্চলের সঙ্গে বৃহত্তর অসমের সব বিষয়ে ব্যাপক ভিন্নতা রয়েছে, ভৌগোলিক অবস্থান, সংস্কৃতি এবং ভাষা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার থেকে আলাদা থাকায় বাংলা ভাষা প্রধান শ্রীহট্ট ও কাছাড়কে নিয়ে একটি পৃথক প্রশাসনিক ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। আর অঞ্চলটির প্রধান নদীর নামে নাম রাখা হয় ‘সুরমা ভ্যালি ডিভিশন’।
কাছাড় জেলায় ছিল শিলচর ও হাইলাকান্দি মহকুমা, করিমগঞ্জ ছিল শ্রীহট্ট জেলায়। এখানে ইতিহাসের আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়, যার সঙ্গে বরাক উপত্যকার ভাগ্য জড়িয়ে আছে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ সাধারণ মানুষ মেনে নিল না। ১৯১২ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। সেই সময় অসম পরিণত হল একটি গভর্নর শাসিত প্রদেশে। রাজনৈতিক সুবিধার্থে আবার সুরমা উপত্যকাকে তৎকালীন অসমের অন্তর্ভুক্ত করা হল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের হাত ধরে আবার তার ভৌগোলিক চেহারার পরিবর্তন হয়।

দেশভাগের আগে বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট জেলায় মোট পাঁচটি মহকুমা ছিল। জেলাগুলি হল: সিলেট, দক্ষিণ সিলেট যা মৌলবীবাজার নামে পরিচিত, সুনামগঞ্জ, করিমগঞ্জ, হবিগঞ্জ। তখন হাইলাকান্দি, শিলচর এবং উত্তর কাছাড় এই তিন মহকুমা নিয়ে ছিল কাছাড় জেলা। দেশ ভাগের জন্য গণভোটের সাহায্য নেওয়া হয়। করিমগঞ্জ মহকুমার রাতাবাড়ি, পাথারকান্দি, বদরপুর থানা এবং করিমগঞ্জ থানার অধিনের কিছু অঞ্চল ছাড়া বাকি এলাকা বর্তমান বাংলাদেশে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্বকিস্তানে চলে যায়। মূলত বরাক উপত্যকা ছাড়া অসমের অন্য কোথাও বিভাজনের করাল গ্রাস পরেনি। কিন্তু এই বিভাজনের ফলে কত মানুষ যে সে সময় ঘর-বাড়ি ছেড়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে নতুন আস্তানা গড়ে নেওয়ার জন্য যে অসমে এসে ছিলেন তার কোনও হিসেব নেই।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার পর্ব ২৩: ভারতীয় চলচ্চিত্রে অসমের অবদান

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল

দেশমাতা তাঁদেরকে নিজের সন্তানদেরকে কাছে টেনে নিলেও ওপার বাংলা থেকে অসমে আসা বাঙালিকে অসমের মানুষ মেনে নিতে পারেননি। তবে এ কথাও সত্যি যে, হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান নয়, তেমনি অসমের অনেকেই কিন্তু পূর্বপাকিস্তান থেকে আসা লোকজনকে সাহায্যও করেছেন। তবে অসমের বর্তমান বরাক উপত্যকায় অনেক আগে থেকেই বাংলাভাষীরা ছিলেন। দেশ ভাগের ফলে বস্তুভিটে হারিয়ে অসমে আসা সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্মবোধ করলেন এখানকার অনেক আদি বাসিন্দারা।

এদিকে জাতীয়তাবাদ এবং জাতিগত সংঘাত প্রকট হতে থাকল। রাজনৈতিক মহলেও তার ছাপ স্পষ্ট দেখা গেল। ১৯৪৭ সালে অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ বলেন, “Assamese would be the official and state language’। তিনি এও জানান, “Assamese would also be the medium of instruction in schools…”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৫: বসু পরিবার-এ উত্তমকুমার দিনভর একটি শব্দই রিহার্সাল করেছিলেন, কোনটি?

শুরু হল আরেক লড়াই। পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে নিজের দেশের মানুষের কাছে হতে হল অনাদৃত। এই বৈমাত্রিক মনোভাব বাড়তে থাকে। ১৯৪৭ সালের ২৩ অগস্টেই গুয়াহাটিতে ‘জাতীয় মহাসভা’ এক বিশাল জন সভায় ‘বঙ্গাল খেদা’ স্লোগান তোলে। ১৯৪৭ এর ২৫ সেপ্টেম্বর কামরূপের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার একটি সার্কুলারে অসম থেকে বাঙালিদের বহিঃস্কৃত করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “directly aimed at ousting the bengalee community from the soil of Assam for good.”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

স্বাধীন ভারতে ১৯৪৭ সালের অসমের প্রথম বিধানসভা অধিবেসনে গভর্নর স্যার আকবর হায়দারি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “The natives of Assam are now masters of their own house. They have a government which is both responsible and responsive of them” আকবর হায়দারি আরও বলেন, “The Bengali has no longer the power, even if he had the will to impose any thing on the people of these Hills and valleys which constitute Assam.”

১৯৪৮ সালে গোপীনাথ বড়দলৈ বলেন, “it is not the intention of the government to make Assam a bilingual state and for the sake of homogeneity of province..they (non Assamese) to adopt Assamese language. Assam is for Assamese.”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে

দেশভাগের যন্ত্রণা থেকেও তখন বড় হয়ে উঠল বেঁচে থাকার লড়াই। সাধারণ বাঙালি মানুষের মনে এক অনিশ্চয়তা, এক ভীতি কাজ করতে থাকে। কুচক্রীরা বিভিন্ন ভাবে তাদের চক্রান্ত চালাতে থাকে। দেখতে গেলে এতে অসমের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। গোটা রাজ্যের শান্তিভঙ্গ হয়েছে। আবার অর্থনৈতিক সামাজিক ক্ষতিও হয়েছে। শিক্ষার আলো থেকে দূরে সরে গিয়ে যুবোসমাজের একটা বিশাল অংশ মেতে উঠেছিল ‘বঙ্গাল খেদ’ অভিযানে। গ্লানি, অপমান, দাঙ্গা, প্রাণহাণী কত কিছুই না দেখতে হয়েছে অসমের বাঙালিদের। ইতিহাসের এ সত্যতা এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই।

উনিশের ভাষা আন্দোলন।

দেশভাগের যন্ত্রণাকে বুকে নিয়ে যাঁরা ওপার থেকে এপারে এলেন তাঁদের রাতের ঘুম আর দু’চোখে এল না। এ ভাবে চলল দীর্ঘ দিন। বলা যায়, এ ছিল অসমের এক অন্ধকারময় সময়, যে সময় বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে অসমের সামগ্রিক উন্নতির চিন্তা করা উচিত ছিল। সেই সময় জাতীয়তাবাদী মনোভাবের জন্য চরম ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে গোটা রাজ্যকেই। স্বাধীনতার আনন্দ থেকে বড় হয়ে উঠল স্বাধীন দেশে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের দুঃখ। এ অদৃশ্য লড়াই চলল দীর্ঘ দিন। ছোঁয়াছে রোগের মতো দেখতে দেখতে পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব। ধীরে ধীরে এই দীর্ঘ যন্ত্রণা থেকে জন্ম নিল উনিশ। অর্থাৎ উনিশে মে’র ভাষা আন্দোলন। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আজও স্বমহিমায় মানুষের মনে বেঁচে রয়েছে অমর উনিশের আত্মবলিদানের কাহিনি। আর এ কথাও মেনে নিতে হয় এই উনিশই প্রতিনিয়ত অসম তথা গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষকে শোনায় চরৈবেতির মন্ত্র। —চলবে।
ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content