মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা।

১৯৩৫ সালে সমগ্র ভারত যখন স্বরাজের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখন অসমের সাংস্কৃতিক জগতেও ঘটে গেল এক বিপ্লব। জন্ম নিল অসমের প্রথম চলচ্চিত্র ‘জয়মতী’। মূলত জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালাই অসমে চলচ্চিত্রের সূচনা করেছিলেন। সেই সময় সিনেমা নিয়ে মানুষের ধারণাই স্পষ্ট ছিল না। সুতরাং দক্ষ কর্মী পাওয়া ছিল দুষ্কর। সিনেমা নির্মাণের খুঁটিনাটি অনেক কাজ জ্যোতিপ্রসাদকেই করতে হতো।

১৯৩৯ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন। দেবদাস অসমীয়া, বাংলা এবং হিন্দি তিনটি ভাষাতেই হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে জ্যোতিপ্রসাদ ইন্দ্রমালতী নামে আরও একটি সিনেমা তৈরি করেন। এই ছবিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ভূপেন হাজারিকার। আহোম রাজকুমারী জয়মতীকে নিয়ে লেখা লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার নাটক নিয়ে প্রথম সিনেমা নির্মাণ করা হয়।
অসমীয়া সাহিত্যে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ঠাকুরবাড়ির জামাতা আধুনিক অসমীয়া সাহিত্যে জোয়ার নিয়ে এসেছিলেন। তিনি খুব সহজে অনেক জটিল বিষয় পাঠকের সামনে তুলে ধরতেন। নিজের জন্ম তারিখ নিয়ে তাঁর কাছে সঠিক তথ্য ছিল না। এ কথা তাঁর আত্মজীবনীতে একেবারে শুরুর দিকেই তিনি উল্লেখ করেছেন। তাঁর আসল জন্ম তারিখটি তিনি মনে করতে পারেননি। তাই সরকারি কাজের সুবিধার জন্য ১৮৬৪ সালটি তিনি জন্ম সাল বলে ব্যবহার করেছেন। লক্ষ্মীনাথ একবার বলেছিলেন, অশ্বিন মাসের লক্ষ্মীপূজার দিন তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাই তাঁর নাম রাখা হয় লক্ষ্মীনাথ। নিজের জীবন সম্পর্কে এমন অনেক তথ্য জনসমক্ষে তুলে ধরতে তিনি দ্বিধা বোধ করেননি। এতেই তাঁর মনের উদারতার পরিচয় আমরা পাই।

লক্ষ্মীনাথের অমর সৃষ্টির জন্য তাঁকে সাহিত্য রথী বলা হয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বতীয় কন্যা প্রজ্ঞা সুন্দরীর সঙ্গে বেজবরুয়া বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। লক্ষ্মীনাথ যেমন বড়দের জন্য লিখেছেন নাটক, ঐতিহাসিক রচনা, জীবনী সাহিত্য, তেমনি অসমীয়া শিশু সাহিত্যেও তাঁর অবদান রয়েছে। তাঁর রচিত গান, ‘ও মোর আপুনার দেশ’ অসমের রাজ্য সঙ্গীত। ১৯৩৮ সালের ২৬ মার্চ তিনি দেহত্যাগ করেন। অসম সাহিত্য সভা এই দিনটিকে সাহিত্য দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-২২: গুয়াহাটির সে কাল-এ কাল

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গরিয়া, গোলপাতা ও হেতাল

রত্নগর্ভা অসম জননীর বুকে জন্মগ্রহণ করেছেন অনেক স্বনামধন্য মনীষীরা। জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা তাঁদের মধ্যে একজন। অসমীয়া সাহিত্য সংস্কৃতিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন তিনি। অসমের প্রথম সিনেমা ‘জয়মতী’ তাঁর হাত ধরেই দর্শকের সামনে এসেছিল। ১৯০৩ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম পরমানন্দ আগরওয়ালা এবং মা ছিলেন কিরণময়ী দেবী। তাম্বুল বাড়ি চা বাগানে তাঁর জন্ম। তাঁর জন্ম এক সংস্কৃতিমনস্ক মারওয়ারি পরিবারে। তাঁর পূর্ব পুরুষেরাও সৃষ্টিশীল কাজ চালিয়ে গিয়েছেন অসমীয়া ভাষায়। আগরওয়ালা রাজস্থান থেকে এসে অসমে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে

জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালার কাকু চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা জোনাকি পত্রিকার সম্পদক ছিলেন। বাবা পরমানন্দ আগরওয়ালও একজন সেতার বাদক ছিলেন। জ্যোতিপ্রসাদ অর্থবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার জন্য এডিনবার্গ পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু অর্থবিজ্ঞানের থেকেও তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি। তাই সাত মাস জার্মানিতে থেকে সিনেমা নির্মাণের প্রশিক্ষণ লাভ করে দেশে ফেরেন। দেশ তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুনে জ্বলছে। দেশে ফিরে তিনিও স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কারাবরণও করেন। কিন্তু হাজার প্রতিকূলতা এলেও সংস্কৃতিমনস্ক জ্যোতিপ্রসাদ ১৯৩৫ সালে অসমের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন। ১৯৩৯ সালে ‘ইন্দ্রমালতী’ ছবি নির্মাণ করেন। পাশাপাশি ছোট গল্প, উপন্যাস, শিশু সাহিত্য ইত্যাদি রচনা করে অসমের সাহিত্য ভাণ্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর রচিত গান জ্যোতিসংগীত নামে পরিচিত।

লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া ।

জ্যোতিপ্রসাদ অসমীয়া সাহিত্য সংস্কৃতিকে ভালোবাসতেন বলেই ‘অসমীয়া ভাষা উন্নতি সাধিনী সভা’ গঠন করে ছিলেন। অসমীয়া ভাষা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে সাহিত্যের রূপকার বলা হতো। ১৯৫১ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়াল দেহত্যাগ করেন।

ভারতীয় চলচ্চিত্রে অসমীয়া সিনেমা নিজস্বতার ছাপ রেখেছে। জ্যোতিপ্রসাদের হাত ধরেই অসমে চলচ্চিত্রের সূচনা হয়েছিল বলে রাজ্যের চলচ্চিত্র জগতকে ‘জলিউড’ বলা হয়। ‘ড. ভূপেন হাজারিকা রিজিওনাল গভর্নমেন্ট ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’ উত্তর পূর্বাঞ্চলের একমাত্র সরকারি সংস্থা, ‘জ্যোতি চিত্রবন ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন’ নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৪: দুষ্টরা সুযোগ পেলেই যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে অধিকার কায়েম করে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৪: প্রজাদের আনন্দ, স্বস্তি, আশ্রয় রাম—তাঁর কাছে প্রজাদের আনুগত্যের স্থান কোথায়?

অসমীয়া সিনেমা জগতে প্রথম নায়িকা হলেন আইদেউ নীলাম্বর হান্দিক। ১৯২০ সালে তাঁর জন্ম। বাবার নাম নিলাম্বর হ্যান্ডিক। মায়ের নাম মালখি হ্যান্ডিক। পরাধীন ভারতের রক্ষণশীল সমাজের একজন নারীর পক্ষে পর্দায় জনসমক্ষে আসা খুব একটা সহজ বিষয় ছিল না। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে বিনোদন জগতে প্রবেশ করায় তাঁর আর সংসার করা হয়ে উঠেনি। সিনেমাতে তিনি রানি জয়মতীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। যিনি তাঁর স্বামী এবং পুত্রকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজে অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেছিলেন। ঐতিহাসিক এই চরিত্রকে তিনি পর্দায় একেবারে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। কিন্তু একজন বিবাহিত রমনির ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য কেউ তাঁকে ঘরণী করতে রাজি হননি। ১৯৮৫ সালে অসমে সিনেমা জগতের শুভারম্ভের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে নীলাম্বর হান্দিককে বিশেষ সম্মান প্রদান করা হয়। ২০০২ সালে ১৭ ডিসেম্বর তিনি প্রয়াত হন।

‘জয়মতী’ ছবিতে আইদেউ নীলাম্বর হান্দিক ।

অসমের ফিল্মি দুনিয়ার সূচনালগ্নে আইদেউ হ্যান্ডিকের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। নিজের জীবনের স্বাদ-আলহাদ সব কিছু বাদ দিয়ে তিনি মেয়েদের জন্য সিনেমাতে অংশগ্রহণের পথ সুগোম করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর মর্যাদা পেলেন না। বরং তিরস্কৃত হয়েছেন। আজকের ভারতের সিনেমা জগতের সঙ্গে সেই সময়ের বিস্তর ফারাক ছিল। আজ আমরা রুপোলি পর্দার যে চাকচিক্য দেখি, তা এতো সহজে হয়ে উঠেনি। হ্যান্ডিকের মতো আরও অনেক নায়িকার বলিদানের ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে ভারতীয় সিনেমা জগতে।

‘জয়মতী’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ফনী শর্মা। পরবর্তী সময়ে তিনি একাধারে নির্দেশনা এবং অভিনয় দুই-ই করেছেন। ‘পিয়লী ফুকন’ চলচ্চিত্রটি নির্দেশনা করেন ফনী। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন পিয়লী ফুকন। তাঁর জীবনের উপর নির্মিত এই সিনেমা। উল্লেখ্য, ‘নাগপাশ’ নাটকের মাধ্যমে তিনি রক্ষণশীল সমাজের চেহারা তুলে ধরেছেন। তাঁকে নাট্যসূর্য উপাধি প্রদান করা হয়।

সময়ের অনেক পরিবতর্ন হয়েছে। সিনেমার কালো-সাদা পর্দা রঙিন হয়েছে। বড় বাজেটের সিনেমা তৈরি হচ্ছে। অভিনয় করে যোগ্য মর্যাদা পাচ্ছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। কিন্তু এর পিছনে রয়েছে এক সংঘর্ষের কাহিনি। আসলে সংঘর্ষ করে আমাদের পূর্বসূরীরা আগামী প্রজন্মের পথের কাঁটা সরিয়ে দেন। তাই তো তাঁদের ত্যাগের কথা মনে রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যতের পথে।—চলবে।
ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content