দিঘলী পুখুরি।
ফ্লাইওভার, বহুতল বাড়ি আর পাহাড় ব্রহ্মপুত্র সব মিলিয়ে গুয়াহাটি শহর। দেবী কামাখ্যার শহর। অসম তথা গোটা উত্তরপূর্বাঞ্চলের বাণিজ্যিক, যোগাযোগ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় জড়িয়ে রয়েছে এই গুয়াহাটি শহরের সঙ্গে। বর্তমানে অসমের রাজধানী হচ্ছে গুয়াহাটির দিশপুর অঞ্চল। আধুনিক জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শহর থেকে মহানগরীর দিকে এগিয়ে চলছে এই গুয়াহাটি। প্রাচীনকাল থেকেই গুয়াহাটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করেই রয়েছে। পূরাকালে গুয়াহাটিকে বলা প্রাগজ্যোতিষপুর। গুয়াহাটি শব্দটিতে গুয়া এবং হাটি এই দুই শব্দ রয়েছে। গুয়া সংস্কৃত শব্দ গুভাকা থেকে এসেছে, অর্থাৎ সুপারি এবং হাটি শব্দটি হাট শব্দ থেকে এসেছে। অর্থাৎ সুপারির হাট। তাই অনেকে মনে করেন হয়তো এই অঞ্চলে সুপারির বড় হাট ছিল তাই এই অঞ্চলের নাম হয়ে গিয়েছে গুয়াহাটি।
অনেক ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক গল্প রয়েছে ব্রহ্মপুত্র পাড়ে অবস্থিত এই শহরকে নিয়ে। কথিত আছে মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুর্যোধনের সঙ্গে কামরূপের রাজকুমারী ভানুমতির বিবাহ হয়। কন্যার বিয়ের উপলক্ষে মহারাজা ভাগদত্ত এক বিরাট পুকুর খনন করান। সেই পুকুরটি আজও গুয়াহাটি শহরের বুকে দীঘলি পুখুরি নামে রয়েছে। কামাখ্যা মন্দিরকে নিয়েও রয়েছে পৌরাণিক কাহিনি। রয়েছে বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমও। গুয়াহাটির নীলাচল পাহাড়ের কোলে অবস্থিত কামাখ্যা দেবীর মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অনেক কাহিনি। কালিকা পুরাণে রয়েছে, মহারাজা দক্ষের জামাতা ছিলেন স্বয়ং শিব। রাজা দক্ষ তাঁর আয়োজিত এক বিশাল যজ্ঞে অনেককে নেমন্তন্ন করলেও শিব সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন না। দক্ষ রাজের কন্যা তথা শিব পত্নী সতী সেখানে উপস্থিত হয়ে পতি নিন্দা শুনে তা মেনে নিতে পারেননি এবং সেই যজ্ঞের আগুনের প্রাণ ত্যাগ করেন। শিব স্ত্রীর মৃত্যুতে উন্মাদ হয়ে সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে তাণ্ডব নৃত্য করতে শুরু করেন। বিষ্ণু তখন সমগ্র সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য সতীর দেহকে সুদর্শন চক্র দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে দেন। যেখানে যেখানে সতীর দেহের টুকরো পড়েছে সেখানে সেখানে এক একটি পীঠস্থান হয়েছে। সতীর যোনি অঙ্গ এই নীলাচল পাহাড়ে পড়েছে এবং এখানে সৃষ্টি হয়েছে কামাখ্যা মন্দির।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-২০: স্বাধীনতা সংগ্রামে অসমের দুই জননেতা
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১১: কলকাতায় ত্রিপুরার রাজনীতি
এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে আরও একটি কাহিনি। প্রাচীন অসমের অসুর রাজা নরকাসুর অতিশয় পরাক্রমী ছিলেন। তিনি দেবী কামাখ্যার মন্দির তৈরি করেছিলেন। কথিত আছে, দেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে এবং নিজেকে অতিরিক্ত ক্ষমতাশালী ভেবে তিনি দেবীকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেন। দেবী তখন নরকাসুরকে শর্ত দেন যে যদি একরাত্রের মধ্যে নরকাসুর পাহাড়ে অবস্থিত মন্দিরের রাস্তা করে দিতে পারে তাহলেই তিনি তাকে বিবাহ করবেন। নরকাসুর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা নির্মাণের কাজে লেগে পড়ে। নরকাসুর বিশ্বকর্মার সাহায্য নিয়ে পাহাড়ের গায়ে একটি মন্দির এবং পাথর কেটে নির্মাণ কার্য প্রায় সমাপ্ত করে ফেলেছিল। তখন দেবীর আদেশে একটি মুরগি ডেকে উঠলে দেবী সকাল হয়ে গিয়েছে বলে গণ্য করেন। নরকাসুর পরাজিত হয়ে সেই মুরগিকে কেটে ফেলে। নরকাসুরের তৈরি মন্দিরটির কিংবা মূল মন্দিরটি ঠিক কি রকম ছিল তার সঠিক ধারনা পাওয়া শক্ত। বর্তমানের মন্দিরটি কোঁচ রাজা নরনারায়ণ ১৫৬৫ সালে পুনর্নির্মাণ করেন। গুয়াহাটি শহরের কথা বলতে গেলে কামাখ্যা মন্দিরের প্রসঙ্গ না উল্লেখ করলে প্রতিবেদনটি থেকে যায় অসম্পূর্ণ।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৮: ছবি আঁকতে আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ টান দিতেন গড়গড়ায়, চিবোতেন পান
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা
আহোমরা দীর্ঘদিন অসমে রাজত্ব করেছে। আহোম রাজত্বকালেও এই শহরের গুরুত্ব যথেষ্ট ছিল। কোঁচদের রাজত্বকালেও রাজধানী ছিল এই শহর। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজা এবং রাজধানী দু’য়ের পরিবর্তন হল। ইয়ান্ডুবু সন্ধির হাত ধরে ইংরেজ শাসনকাল শুরু হল অসমেও। ১৮৭৪ সালের পর অসমের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় শৈল শহর শিলঙে। ১৯৭২ সালে মেঘালয় রাজ্য অসম থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং অসমের রাজধানী পুনরায় গুয়াহাটিতে চলে আসে। ইংরেজদের আগমনের পর থেকে কিংবা তার আগেও গুয়াহাটি শহর অনেক পরিবর্তন দেখেছে।
১৯০১ সালে গুয়াহাটিতে স্যার হেনরি জন স্টেডম্যান কটনে ‘কটন কলেজ’ স্থাপিত করার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষা লাভ করার পথ অনেকটা সুগম হয়ে গেল গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চলের পড়ুয়াদের জন্য। গুয়াহাটির পান বাজার অঞ্চলে এই কলেজ স্থাপিত হয়। শুধু তাই নয়, ১৮৩৫ সালে অসমের প্রথম বিদ্যালয় কটন কলেজেই গভর্নমেন্ট হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলও শুরু হয় এই পানবাজারের বুকেই। ১৯৩৯ সালে এই অঞ্চলেই জন্ম নেয় গুয়াহাটি গার্লস কলেজ। রাজবালা দাস এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি নিজে একজন মহিলা হয়েও সেই সময়ের সমাজের একাধিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে অসমে মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার আলো বিস্তার করার জন্য এগিয়ে আসেন।
১৯০১ সালে গুয়াহাটিতে স্যার হেনরি জন স্টেডম্যান কটনে ‘কটন কলেজ’ স্থাপিত করার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষা লাভ করার পথ অনেকটা সুগম হয়ে গেল গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চলের পড়ুয়াদের জন্য। গুয়াহাটির পান বাজার অঞ্চলে এই কলেজ স্থাপিত হয়। শুধু তাই নয়, ১৮৩৫ সালে অসমের প্রথম বিদ্যালয় কটন কলেজেই গভর্নমেন্ট হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলও শুরু হয় এই পানবাজারের বুকেই। ১৯৩৯ সালে এই অঞ্চলেই জন্ম নেয় গুয়াহাটি গার্লস কলেজ। রাজবালা দাস এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি নিজে একজন মহিলা হয়েও সেই সময়ের সমাজের একাধিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে অসমে মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার আলো বিস্তার করার জন্য এগিয়ে আসেন।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩১: আলাস্কায় কারও সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বললেই আত্মীয়তার স্পর্শ পাওয়া যায়
১৯৪০ সালে বর্তমান জায়গায় স্থানান্তরিত হয় এবং স্যার রাধাকান্ত হ্যান্ডিকের সম্মানার্থে এই কলেজের নাম হ্যান্ডিক গার্লস কলেজ। আর কে হ্যান্ডিকের সহযোগিতা ছাড়া মহিলাদের জন্য এই মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর হত না। রাজবালা দেবী একজন প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সমাজ কর্মী ছিলেন। শুধু দু’ জন ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কলেজের ভিত স্থাপিত করেন। এগিয়ে এলেন রাধাকান্ত হেন্ডিক। এই কলেজের জন্য যথেষ্ট আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলেন তিনি। আজ মহিলারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করলেও সমাজের বেড়াজাল অতিক্রম করে স্কুল কলেজ পর্যন্ত পৌঁছনো খুব একটা সহজ ছিল না। সেই সময় ১৮৫০ সালে গুয়াহাটিতে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মাত্র ১৩জন মেয়েরা বইখাতা হাতে নিয়ে সেই স্কুলে যেত। বাড়ির বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করা সেই সময় অনেক বড় ব্যাপার ছিল। ইংরেজ মেম শিক্ষিকারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য বলতেন। ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মেয়েদের বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। চার্লস উড মেয়েদের শিক্ষালাভের জন্য সরকারি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে ইংরেজ সরকারকে চিঠি লিখেছিলেন। ধীরে ধীরে গুয়াহাটি তথা সমগ্র অসমে মেয়েদের পড়াশুনার হার বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কামাখ্যা মন্দির।
১৮৮১ সালে অসমে রেল এল নতুন যুগের আগমন বার্তা নিয়ে। মূলত চা এবং কয়লার ব্যবসার সুবিধার্থে ডিব্রুগড় থেকে মর্গেরিটা পর্যন্ত প্রথম মিটার গজ রেল চালু করা হয়। ১৯০০ সালে অসম বেঙ্গল রেলওয়েজের হাত ধরে গুয়াহাটির বুকে এল রেল গাড়ি। তার আগে মূলত জল পথই ছিল অসমের অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃরাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম। ব্রহ্মপুত্রের বুকে চলত ছোট বড় নৌকা কিংবা ফেরি। স্বাধীনতার পূর্বে পাণ্ডু বন্দর দিয়ে অসমের বন্দরগুলির মধ্যে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এই বন্দর দিয়ে অনেক মানুষ যেমন যাতায়াত করত তেমনি চা, জুট এবং অন্যান্য সামগ্রী অসম থেকে রফতানিও হত কলকাতা এবং চিটাগং এর বন্দরে ।
পুরাতন এবং নতুনের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে গুয়াহাটি শহর প্রতিদিন এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের দিকে। ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংস্কৃতির সঙ্গে তালে তাল মিলিয়েছে আধুনিকতা। আধুনিক এই শহরে যেমন রয়েছে আহোম কিংবা কোঁচ রাজত্বের ছাপ তেমনি ব্রিটিশ শাসন কালের চিহ্নও দেখতে পাওয়া যায়। গুয়াহাটির নিজস্ব আয়তনও যেমন বড় তেমনি তার সর্ম্পকের কিছু বলা মানে সিন্ধুকে বিন্দুতে ধরার চেষ্টা করা।—চলবে।
পুরাতন এবং নতুনের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে গুয়াহাটি শহর প্রতিদিন এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের দিকে। ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংস্কৃতির সঙ্গে তালে তাল মিলিয়েছে আধুনিকতা। আধুনিক এই শহরে যেমন রয়েছে আহোম কিংবা কোঁচ রাজত্বের ছাপ তেমনি ব্রিটিশ শাসন কালের চিহ্নও দেখতে পাওয়া যায়। গুয়াহাটির নিজস্ব আয়তনও যেমন বড় তেমনি তার সর্ম্পকের কিছু বলা মানে সিন্ধুকে বিন্দুতে ধরার চেষ্টা করা।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।