বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


গোপীনাথ বড়দলই ও তরুণরাম ফুকন।

ভারতের জননেতারা দেশের স্বাধীনতার প্রাপ্তির জন্য ব্যক্তিগত স্বার্থকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন সবসময়। নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার ক্ষুদ্র প্রয়াসে ব্যস্ত হয়ে থাকেননি। তাঁরা দেশ মাতার ডাকে সকল বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন স্বরাজের দিকে। চোখে ছিল নতুনের স্বপ্ন। মুখে ছিল বন্দে মাতরম ধ্বনি। অসমের গোপীনাথ বড়দলই এমনি এক জন ব্যক্তিত্ব, যিনি দেশের জন্য দশের জন্য আজীবন কর্তব্য পালন করে গিয়েছেন। মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন চির দিন। অসমের আপামর জনতাও তাঁকে ভালোবেসেছে। আজও তিনি লোকপ্রিয় গোপীনাথ বড়দলই নামেই পরিচিত। তাঁর নিঃস্বার্থপরতা এবং অসমের প্রতি তাঁর ভালোবাসার জন্য তৎকালীন অসমের রাজ্যপাল জয়রাম দাস দৌলতরাম তাঁকে ‘লোকপ্রিয়’ উপাধি দিয়ে ছিলেন। ভারত সরকারও তাঁকে ভারত রত্ন সম্মান প্রদান করেছিল।

১৮৯০ সালে বুদ্ধেশ্বর বড়দলই এবং প্রাণেশ্বরী বড়দলইয়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন গোপীনাথ বড়দলই। খুব অল্প বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। ১৯০৭ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করে কলকাতার স্কটিস চার্চ কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। তারপর তিনি আইন পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। এর পরে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেন। গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও অনেকের জীবনদর্শন গোপীনাথ বড়দলইকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ইংরেজ সরকারের বিরোধিতা করায় একাধিক বার কারাবরণ করেন তিনি।
গোপীনাথ বড়দলই একজন বিচক্ষণ রাজনীতবীদ ছিলেন। ১৯৩৫ সালে প্রাদেশিক রাজ্যগুলিকে স্বায়ত্তশাসন করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ১৯৩৬ সালে কংগ্রেসের ভোটে জয় লাভ করেও বিপক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। সুতরাং মোহাম্মদ সাদুল্লাহ অসমের রাজ্যপাল প্রধান মন্ত্রী নির্বাচন করেন। তিনি মুসলিম লিগের সদস্য ছিলেন। মুসলিম লিগের প্রধান ছিলেন মোহম্মদ আলি জিন্না। সেই সময় অসমের রাজনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। অসমের সেই অস্থির পরিস্থিতিকে সামলাতে ১৯৩৮ সালে নেতাজির অসমে পৌঁছন।

মোহম্মদ আলি জিন্না ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে পাকিস্তান করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সংগঠন মুসলিম লিগেরও একই উদ্দেশ্য ছিল। ইংরেজ সরকার এবং মুসমিল লিগ একসঙ্গে করে গোপনে অসমকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করছিল। নেতাজি বিষয়টি জানতে পেরে প্রথমে স্বাধীনতা সংগ্রামী আব্দুল কালাম আজাদকে অসমে পাঠিয়ে ছিলেন। তার পর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি নিজেই অসমে গিয়ে ছিলেন। অসমের গোপীনাথ বড়দলই, তরুণরাম ফুকন, সন্তোষ কুমার বড়ুয়া, যোগেন মণ্ডল এবং আরও অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র অসমে যাবার পর কংগ্রেসের প্রাদেশিক প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য অনেক নির্দলীয় বিধায়ক কংগ্রেসে যোগদান করেন। ফলে গোপীনাথ বড়দলইকে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করা হয়। গোপীনাথ বড়দলই শক্ত হাতে অসমের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামলানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত থাকলেও ইংরেজ সরকারের স্বেচ্ছাচারীয় এ বার যেন একটি সীমারেখা টেনে দেওয়া গেল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-১৯: শিলচর শহরের বড় হয়ে উঠার গল্প

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ১০: পূর্ণ রাজ্যে প্রথম কংগ্রেস মন্ত্রিসভা

গোপীনাথ বড়দলই অসমকে দেশভাগের প্রকোপ থেকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি অসমের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বলা যায়, লোকপ্রীয় গোপীনাথ বড়দলইয়ের নেতৃত্বে সমগ্র অসম তথা গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চল কেবিনেট মিশন প্ল্যানের হাত থেকে রক্ষা পায়। তাঁর বিচক্ষণতার জন্যই অসম পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়নি। এ ব্যাপারে সর্দার ভল্লব ভাই প্যাটেল তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করেন। দেশ ভাগ হওয়া কেউ রদ করতে পারল না। হাজার হাজার মানুষকে এক অনিশ্চয় ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়ে দেশ স্বাধীন হল। কিন্তু অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন তো স্বপ্নই থেকে গেল।

দেশভাগের ফলে যারা রিফিউজি হয়ে ভারতে চলে এলেন তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করতে গোপীনাথ বড়দলই এগিয়ে এসেছিলেন। গান্ধীবাদী গোপীনাথ একজন মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তাঁর উদ্যোগেই অসমে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়, হাই কোর্ট, অসম মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ সালের ৫ আগস্ট লোকপ্রীয় গোপীনাথ বড়দলই দেহ ত্যাগ করেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার

মহামানবের সাগরতীরে

অসমের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলে অনেকেরই নাম মনে পড়ে। দেশবন্ধু তরুণরাম ফুকন একজন অন্যতম বিপ্লবী ছিলেন। ১৮৭৭ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম বলরাম ফুকন এবং মায়ের নাম ভাগীরথী দেবী। বিলেত থেকে আইন পাশ করে দেশে ফিরেন। তবে ওকালতি ছেড়ে তিন স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। কংগ্রেস দলের একজন স্বক্রিয় সদস্য ছিলেন। গান্ধীজির খুবই আস্থাভাজন ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনকে সম্পূর্ণ ভাবে স্বার্থক করার জন্য তিনি অসম ঘুরে ঘুরে গান্ধীজির বার্তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। খাদি কাপড় ব্যবহার করা এবং বিদেশী দ্রব্য বর্জন করার জন্য অসমের সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

গুয়াহাটি কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ছিলেন তরুণরাম ফুকন। ১৯২০ সালে ভাইসরয়কে গুয়াহাটি পরিদর্শন করতে দেননি। ১৯২১ সালেও গভর্নরকে অসমের মাটিতে পা রাখতে দেননি। ১৯২১ সালে তরুণরাম ফুকন এবং গোপীনাথ বড়দলইকে ইংরেজ পুলিশ গেরফতার করে। কিন্তু দেশভক্তদের হৃদয় ভয় শূণ্য থাকে। জেলের ভয় তাঁদের পথের বাধা হাতে পারে না। তাই তো এক বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে দুই জননেতা আবার লেগে পড়েন দেশোদ্ধারের কাজে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬২: ক্রৌঞ্চবধের বিষাদ কী ছেয়ে আছে রামায়ণের প্রেক্ষাপট?

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩০: এই রাত তোমার আমার…

পরে তরুণরাম ফুকন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। মতিলাল নেহরু এবং চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ দল গঠন করার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশকে ইংরেজমুক্ত করা। শিলচর জেলে থাকাকালীন তিনি দেশাত্মবোধক গান এবং কবিতার বই স্তিতিমালা রচনা করেন। তিনি সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো প্রসার করতে স্বচেষ্ট হন। বর্ণবৈষম্য দূর করে অসমের জনগণ যাতে সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার লাভ করতে পারেন, সে বিষয়ে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ করেন। মহিলাদেরকেও দেশের রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেন।

১৯২৮ সালে অসম ছাত্র সম্মেলনের সভাপতি পদে ছিলেন তরুণরাম ফুকন। গুয়াহাটি শহরের মিউনিসিপ্যালিটি বোর্ডের প্রধান থাকায় জনসাধারণের হিতার্থে একাধিক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করেন। গুয়াহাটি শহরে প্রথম বাইসাইকেল এবং গাড়ি কিনেছিলেন তরুণরাম ফুকন। একজন বিশিষ্ট জননেতা ছিলেন তিনি। মানুষের কল্যাণই ছিল তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য। ১৯৩৯ সালের ২৮ জুলাই তরুণরাম ফুকন ইহলোক ত্যাগ করেন।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content