মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ভাষা শহিদ স্টেশন।

পাহাড়, নদী, স্থানীয় মানুষ এবং আরও অনেক কিছুর মধ্য দিয়েই ফুটে উঠে একটি জায়গার চেহারা। তবে তা সম্পূর্ণতা পায় তার ইতিহাসের নিবিড় পাঠ থেকে। তেমনি অসমের ইতিহাসের মধ্যেও লুকিয়ে আছে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনের কাহিনি। গ্রাম থেকে নগরায়নের কাহিনি। আজকের বড় বড় দোকান, বিল্ডিং, অফিস-কাছারি, যানবাহনে পরিপূর্ণ শহরগুলিও একদিনে হঠাৎ করে শহর হয়ে উঠেনি। একটি শিশুর বেড়ে উঠার মতো একটি শহরেরও প্রতিদিন পরিবর্তন হয়। একসময় শিলচর শহরের রাস্তায় রাস্তায় এতো আলোর ঝলমল ছিল না। হাতে গোনা কয়েকটি কেরোসিন তেলের বাতি জ্বলত। কথিত, পূর্ণিমার রাতে সেই আলোও জ্বালানো হত না। ১৯২৯ সালে শহরে প্রথম বিদ্যুৎ সংযোগ হল। শহরের রাস্তায় হাতি নেমে আসত। শহরের অনেকটা অংশ নিয়ে ছিল ধান খেত।

মূলত ইংরেজরাই শিলচরকে নতুন চেহারা প্রদান করে। তারা নিজেদের সুবিধার জন্য রেল লাইন পেতেছিল। তার ফলে এ অঞ্চলের বিপুল পরিবর্তন হয়। রেললাইন স্থাপিত হওয়ায় দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা অনেকটা সহজ হয়ে উঠে। জানিগঞ্জ-সদরঘাট অঞ্চলে অফিস আদালত গড়ে উঠে। এই ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন থমাস ফিসারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয়। মূলত তাঁর হাত ধরেই শিলচর শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। পরবর্তীকালে জন এডগার্স সাহেব শিলচর শহরকে নগরায়ণের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান।
শিলচর-কলকাতা স্টিমার পরিষেবা চালু হয় ১৮৫০ সালে। এরই মধ্যে ১৮৫০ এ শিলচরের বুকে জন্ম নিল আধুনিক খেলা—পোলো এবং তার জন্যই গড়ে ওঠে পোলো ক্লাব। ইংরেজ সাহেবরা লক্ষ্য করলেন এখানকার মণিপুরিদের সগোল কাংজেই নামের এক ধরনের খেলার সঙ্গে পোলোর অনেকটাই মিল রয়েছে। ক্যাপ্টেন রবার্ট স্টুয়ার্ট নিজেও মণিপুরিদের সঙ্গে খেলেছিলেন। তারপর তিনি এবং মেজর জেনারেল জোসেফ শের ১৮৫৯ সালে পৃথিবীর প্রথম পোলো ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাসের পাতায় শিলচরের নাম লিখে দিলেন। বর্তমানের পুলিশ গ্রাউন্ড, টাউন ক্লাব বা ইন্ডিয়া ক্লাবই সেই অতীতের পোলো ক্লাবটি।

১৮৫২ সালে হেড পোস্ট অফিস স্থাপিত হয়। টেলিগ্রাফ পরিষেবা চালু হয় ১৮৬১ সালে। এ দিকে বরাকে চা উৎপাদনও প্রক্রিয়াও বিস্তার লাভ করে। ফলে ব্যবসায়িক দিক দিয়েও শিলচর ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছিল। ১৮৬৩ সালে শিলচর শহরে হাই গ্রামার স্কুল স্থাপিত হয়। পরবর্তী সময়ে তার নাম হয় গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুল। রেভান্ট উইলিয়াম প্রাইজ সাহেবের উদ্যোগেই এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

১৮৮২ সালে স্টেশন কমিটি শহরের বুকে আরও স্কুল খোলার প্রস্তাব রাখেন। হরকিশোর গুপ্ত, হরিচরণ দাস, অভয়াচরণ ভট্টাচার্য স্কুলের শিক্ষক নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন। হরকিশোর গুপ্তকে সবাই দেওয়ানজি নামেই সম্মোধন করতেন। কারণ, তিনি ডেপুটি কমিশনারের সেরেস্তার দেওয়ান ছিলেন। তাঁর নিজস্ব জমির উপর বর্তমানে একটি বাজার রয়েছে যাকে স্থানীয়রা ‘দেওয়ানজি বাজার’ নামেই চেনে। হরিচর দাস শিলচর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, হরিচরণবাবুই প্রথম এ অঞ্চলের বিএলবি পাশ করেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-১৮: স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজির ডাকে সাড়া দিয়েছিল গোটা অসমবাসী

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৯: একাত্তরে ত্রিপুরা, মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা

১৮৮২ সালে শিলচর শহরে স্থাপিত হয় অভয়াচরণ পাঠশালা। এই কমিটিই মেয়েদের জন্য স্কুল চালু করার পদক্ষেপ নেয়। এর ফলে মেয়েরা ধীরে ধীরে বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে লাগল। মিস ইভানসন এবং মিস উইলিয়ামস নামে দু’জন মেম শহরবাসীর বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মেয়েদের পড়াশোনা করাতেন। কিন্তু একজন ইংরেজ বিধর্মী মহিলা বাড়িতে ঢুকে মেয়েদের পড়াবেন সেটা স্বাভাবিক ভাবেই সেই সময় মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। মেম দিদিমণি ফিরে যাওয়ার পর বাড়ি গোবর জল দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হত। তারপর স্টেশন কমিটির আর্থিক সাহায্যে একটি মেয়েদের স্কুল গড়ে উঠে। তবে মেয়েদের এই স্কুলটি শুরু হতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছিল। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং মূল উদ্যোগতা ছিলেন ভারতচন্দ্র ভট্টাচার্য।

মিশনারীরাও মেয়েদের জন্য একটি স্কুল শুরু করেছিলেন। শিলচরের মেয়েরা হাতে বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যেতে শুরু করল। ১৯০৫-১৯০৬ সাল নাগাদ মিস উইলিয়াম দেশে ফিরে যান। মিস ইভানসনের পক্ষে একা স্কুল চালানো সম্ভবপর ছিল না। তাই সিলেটের মিশন থেকে মিস লয়েড শিলচরে আসেন। মেয়েদের মধ্যে পড়াশুনা করার প্রবণতাও ক্রমশ বাড়ছিল। তারাপুর মিউনিসিপালটি আরও একটি মেয়েদের জন্য স্কুল শুরু করে। এদিকে ভারতচন্দ্রের স্কুলটি মিশনারি স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২১: গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী—এক শক্তির গল্প

১৮৬৪ সালে স্থাপিত হল একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ১৮৭৬ সালে কিতিঞ্জ লাইব্রেরি নামে একটি লাইব্রেরিও স্থাপিত হয়। দেশ স্বাধীনের পরে তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘অরুণচন্দ গ্রন্থাগার’। তবে এ কথা মেনে নিতেই হয় যে, রেল পরিষেবা শুরু হওয়ায় এত উন্নয়নমূলক কাজ করা সম্ভবপর হয়েছে। ১৮৮২ সালে প্রথম রেল স্টেশনের জন্য কমিটি গঠিত হয়। ১৮৩৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রেল স্টেশনের উন্মোচন হয়।

পরবর্তীকালে এই কমিটিই পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত হয়। ১৮৯৮ এ অসম ও বাংলার মধ্যে রেল পরিষেবা শুরু হয়। ঘন জঙ্গল, টানেল, ঝর্ণা সব পেরিয়ে মিটারগেজ রেল ছুটতো তার গন্তব্যে। ১৯৬১-র ভাষা আন্দোলনের জন্য শিলচরেই এই রেল স্টেশন ইতিহাসের পাতায় বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। স্বাধীন দেশে নিজের মাতৃভাষাতে কথা বলার অধিকার আদায় করতে গিয়ে এই রেল স্টেশনেই এগারোজন তরুণ-তরুণী পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। তাই শিলচর রেল স্টেশনের প্রসঙ্গ এলেই মনে পড়ে যায় ওই অমর ভাষা শহিদদের কথাও।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৮: স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩০: এই রাত তোমার আমার…

১৯১০ সালে প্রথমবার শিলচর শহরের বুকে গাড়ি চলেছিল। তার আগে ঘোড়ার গাড়ি কিংবা গরুর গাড়িই মানুষ ব্যবহার করত। তার পর এল সাইকেল কিংবা রিকশা। সাধারণ শহরবাসী আসেপাশে পায়ে হেঁটেই যেতেন। তখন সব রাস্তাই মাটির ছিল। শহরের বুকে তখনও পাকাসড়ক তৈরি হয়নি। জানিগঞ্জ, তারাপুর অঞ্চলে প্রথমে পাকাসড়ক তৈরির কাজ শুরু হয়। তারপর অন্যান্য অঞ্চলেও রাস্তার কাজ শুরু হয়। ১৯০৭ সালে এই শহরের ১৪ মাইল রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ করত মিউনিসিপ্যালিটি বোর্ড। শিলচর শহরের অন্যতম বাজারের নাম ‘ফাটক বাজার’। এই বাজারের ভিতর বাঁশের বেড়া দেওয়া ফাটক ছিল বলে এর নাম হয়ে যায় ‘ফাটক বাজার’। এই ফাটক বাজারে ছিল জেল। ১৮৬৯ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ফলে জেলটি ধ্বংস হয়ে যায়।

সময়ের হাত ধরে শিলচর শহরের চেহারা পাল্টাতে থাকে। স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এই শহরও। গান্ধীজি, জওহরলাল নেহরু এই শিলচরে এসেছিলেন। ১৯৩৮ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুরও আগমন ঘটেছিল এই শহরে। ইতিহাসের কতই রং বদলানোর রূপ দেখে এই শহর। আর সেই সঙ্গে নিজেও হয়ে যায় সেই বদলানো রূপেরই এক গল্প। শিলচর শহরেরও রূপ পাল্টেছে এবং পাল্টাচ্ছে। আসলে সময়ের সঙ্গে এই পরিবর্তনটাই তো নতুনের জন্য অসংখ্য সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content