শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।

সাধারণ মানুষ দেশকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখে, তা বাস্তবায়িত করতে তারা নির্ভর করে জননেতার উপর। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এমনই একজন জননেতা যাঁর উপর ভরসা করে পরাধীন ভারতের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে। অসমের মানুষের মনে নেতাজি বাসা বেঁধেছিলেন, এখানকার মানুষও স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র তিন বার অসমে গিয়েছিলেন। তখন অসমের আয়তন আজকের অসমের থেকে বড় ছিল। বর্তমান মেঘালয় রাজ্য অসমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শিলং ছিল অসমের রাজধানী। রাজনৈতিক নানা বিষয় নিয়ে নেতাজি ব্যস্ত থাকলেও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে দেখা না করে তিনি কখনওই অসম থেকে ফেরেননি। বিভিন্ন সভা, সমিতির মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা সব সময় করেছেন তিনি।

আট থেকে আশি সব বয়সের মানুষেরই ভরসা ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্রের উপর। আর সেই ভরসা থেকেই অসমের প্রথম মহিলা সাংবাদিক কল্পনা বড়ুয়া অল্প বয়সেই নেতাজির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। শিলংয়ের লাবান এসামিস গার্লস স্কুলের ছাত্রী কল্পনা নেতাজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন। অবশেষে কল্পনার বাবার তাঁকে শিলংয়ের হিন্দু মিশন কমপ্লেক্সে একটি জনসভায় নিয়ে যান। সেখানেই নেতাজির সঙ্গে কল্পনার দেখা হয়। কল্পনা তাঁর আত্মীয়-পরিজনের কাছ থেকে ৭৫ টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। সেই অর্থ তিনি নেতাজির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ছোট্ট কল্পনার কাছে নেতাজি জানতে চেয়েছিলেন, কেন এই টাকা তিনি দিচ্ছেন। উত্তরে ওই স্কুল পড়ুয়া জানিয়েছিল, দেশমাতৃকার সেবার জন্য এই অর্থ সে সংগ্রহ করেছে। নেতাজি তাঁকে প্রাণ ভরা আশীর্বাদ করেছিলেন। অসমের মানুষের বুক ভরা ভালোবাসা পেয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের চিরস্মরণীয় সেনানী নেতাজী সুভাষচন্দ্র। নেতাজি এমন একজন দেশপ্রেমী যিনি ভারতের স্বাধীন আকাশে জাতীয় পতাকা দেখার জন্য দেশের সীমানা অতিক্রম করেছিলেন।
শিলংয়ের সেন্ট অ্যাডমন্ড কলেজে হওয়া এক জনসভায় নেতাজি স্পষ্ট ভাষায় নিজের মনের কথা জানিয়েছিলেন। সেই সভায় পড়ুয়া, স্থানীয় লোকজন এবং কয়েকজন ইংরেজ সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। নেতাজি বলেন, তিনি একজন দেশভক্ত, দেশকে ভালোবাসেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পিছু পা হবেন না। তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেন ভারতের রাজতন্ত্র কোনও বিদেশি শক্তির হাতে থাকবে। নেতাজির বক্তৃতা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। অনেকেই নেতাজির সঙ্গে বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্তও হয়েছিলেন। সেন্ট অ্যাডমন্ড কলেজের পড়ুয়ারা নেতাজিকে ‘ফরগেট মি নট’ ফুলের তোড়া দিয়ে সংবর্ধনা জানান।

নেতাজি প্রথম বার ১৯২৭ সালে অসমে যান। ছিলেন শিলংয়ে। ১৯৩৮ সালে তিনি আবার অসমের তৎকালীন রাজধানী শিলংয়ে গিয়েছিলেন। সেই সফরে তিনি গোলকগঞ্জ এবং ধুবড়ি শহরেও যান। গৌরীপুরের একটি শোভাযাত্রায় বক্তৃতাও দেন। অসম থেকে বহু মানুষ নেতাজির আজদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করতে এগিয়ে এলেন। প্রথম বার তিনি শিলং গিয়েছিলেন মূলত নিজের চিকিৎসা করাতে। শিলংয়ে বর্তমানে ওকল্যান্ডে তিনি বেশ কয়েক মাস থেকে ছিলেন। মেনমারের মণ্ডলায় জেল থেকে ফেরার পর তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছিল না। তাই একটু স্থান পরিবর্তনের জন্য শৈল শহর শিলংকে বেছে নিয়েছিলেন। শিলংয়ের এক মাত্র অ্যালপ্যাথি চিকিৎসক পুলিনবিহারী দেব তাঁর চিকিৎসা করছিলেন। সেই সময় তিনি খুব বেশি লোকজনের সঙ্গে দেখা করতেন না। তবে গোপীনাথ বড়দলই এবং তরুণ রাম ফুকন দেখা করতে যেতেন নেতাজির সঙ্গে। শিলংয়ের পোলো বাজারে, লাবানের হরি সভায়, লোয়ার মোপ্রেম এবং আরও বেশ কিছু জায়গায় জনসভায় সুভাষ বসু ভাষণ দেন। সেই সঙ্গে তিনি যুব সমাজকে দেশের কাজে যোগ দিতে আহ্বান জানান।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-১৭: ইংরেজদের কোপে পড়ে মহীতোষ পুরকায়স্থকে ছাড়তে হয়েছিল স্কুল

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৮: ভারতভুক্তির পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা

১৯৩৮ সালে নেতাজি আবার অসম যান। তবে এ বার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে তাঁর অসম ভ্রমণ। আসলে সেই সময় অসমের রাজনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। সেই অস্থির পরিস্থিতিকে সামলা দিতেই নেতাজির অসমে যাওয়া। মহম্মদ আলি জিন্না ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে পাকিস্তান করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সংগঠন মুসলিম লিগেরও একই উদ্দেশ্য ছিল। ইংরেজ সরকার এবং মুসমিল লিগ যুক্তি করে গোপনে অসমকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করছিল। নেতাজি ব্যপারটি জানতে পেরে প্রথমে স্বাধীনতা সংগ্রামী আবুল কালাম আজাদকে অসমে পাঠিয়ে ছিলেন। তার পর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ডট হিসেবে তিনি নিজেই অসমে গিয়ে ছিলেন। প্রথমে গুয়াহাটি, তারপর অসমের তৎকালীন রাজধানী শিলংয়ে যান। নেতাজির আগমনেই অসমের রাজনৈতিক চেহারার পরিবর্তন ঘটে। তবে এই পরিবর্তন খুব সহজ ছিল না। রীতিমতো সাংবিধান মেনে যথেষ্ট বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে নেতাজি এবং অসমের রাজনৈতিক নেতাদের। অসমের গোপীনাথ বড়দলই, তরুণরাম ফুকন, সন্তোষ কুমার বড়ুয়া, যোগেন মণ্ডল-সহ বহু মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

উল্লেখ্য, ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন প্রণীত হয়। এই আইন ভারতের প্রাদেশিক রাজ্যগুলিকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। ফলে দেশের সব রাজ্যগুলি ভারত ফেডারেশনের জন্য যোগ দেয়। প্রত্যেক রাজ্য থেকে একজন মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। তখন মুখ্যমন্ত্রী বলা হত না, প্রধানমন্ত্রী নামে সম্বোধন করা হত। নেতাজি সুভাষচন্দ্র অসমে যাওয়ার পর কংগ্রেসের রাজ্য প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য বেশ কয়েকজন নির্দল বিধায়ক কংগ্রেসে যোগদান করেন। ফলে গোপীনাথ বড়দলইকে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। গোপীনাথ বড়দলই শক্ত হাতে অসমের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামলান। প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত থাকলেও ইংরেজ সরকারের স্বেচারিতায় এ বার যেন একটি সীমারেখা টেনে দেওয়া গেল। গোপীনাথ বড়দলইকে প্রধানমন্ত্রী করে দেওয়ায় বৃহত্তর অসমকে পাকিস্তানের সীমানার মধ্যে যাওয়া থেকে রদ করা গেল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬০: একটু বসো চলে যেও না…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৩: শ্রীমার বড় ভাইজিরা—নালু ও মাকু

নেতাজি শিলচর আসেন ১৯৩৯ সালে। কাছাড় জেলা স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন সভাপতি সুশীলরঞ্জন চক্রবর্তীর কর্মদক্ষতা দেখে তিনি তাঁকে লিখেছিলেন, “work for the present, but prepare for the future.” ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দামামা যখন বাজল, তখন নেতাজি ইম্ফলে চলে গেলেন। ১৯৪৪ সালের ৭ এপ্রিল ‘জাপানিস এয়ার ফোর্স’ শিলচর রেল স্টেশনকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করেছিল, এবং ভুলবশত কাছাড়ের বরজালেঙ্গাতে বোমা ফেলে দেয়। উদ্দেশ্য সফল হলে গোটা অঞ্চলে ইংরেজ শাসকদের মেরুদণ্ড ভেঙে যেত এবং নেতাজি বাংলা হয়ে দিল্লিতে পৌঁছতে পারতেন।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসমের স্থানীয় নেতা থেকে সাধারণ মানুষ সবার অবদান অনস্বীকার্য। আবার অসমের রাজনৈতিক ইতিহাসে নেতাজির অবদানও অপরিসীম। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content