মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


মহীতোষ পুরকায়স্থ।

ইংরেজ আমল বলতেই একটি বিশেষ সময়, বিশেষ সমাজ ব্যবস্থা, স্বাধীনতা সংগ্রাম-সহ নানা ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে। ইতিহাসের পাতায় তো লুকিয়ে আছে আমাদের অতীত দিনের অনেক কাহিনি। যে অতীত যেমন বলে বিপ্লবের গল্প ঠিক, তেমনি আমাদের সমাজসেবক পূর্বসূরীদের লড়াইয়ের কথাও মনে করিয়ে দেয় বার বার। আর এ কথাতো মেনে নিতেই হয় সেই সময় তাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন বলে সমাজে শিক্ষার হার বেড়েছে। মেয়েরা খিড়কি আর সিংহদ্বারের গণ্ডি অতিক্রম করে বাইরে বেরিয়েছে। দেশের পরিবর্তন হয়েছে, সমাজে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের চেহারা পাল্টেছে।

মহীতোষ পুরকায়স্থ এমনই একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর সারা জীবন দেশের দশের কথাই ভেবেছেন। শিলচরের মানুষের কাছে তিনি তাদের শ্রদ্ধেয়, ভালোবাসার চিনুদা। ১৯১৯ সালে তিনি করিমগঞ্জের কাছে বাগবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন। নিজেকে দেশের সেবায় নিয়োজিত করেন। ১৯৩২ সালে শিলচরের অম্বিকাপট্টিতে ছাত্র ও অল্প বয়সি ছেলেরা ‘কল্যাণ সাহিত্য মন্দির’ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলে। সেখানে মূলত শরীরচর্চা, লাঠি খেলা সেখানো হত। সেই সঙ্গে সেখানে ছিল অনেক রকম বইও। তার মধ্যে বেশির ভাগ বই ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। কারণ সেই সব বই ছিল দেশভক্তিতে পরিপূর্ণ।
মহীতোষ সেই সময় স্কুলের ছাত্র। তিনি তখনই সেই ‘কল্যাণ সাহিত্য মন্দির’ সদস্য হয়েছিলেন। তার কিছুদিন আগেই শিলচরে আর্য সাহিত্য মন্দির এবং বাণী ভবনের মতো প্রতিষ্ঠান সমাজ কল্যাণের জন্য এগিয়ে এসেছিল। তিরিশের সেই উত্তাল সময়ে এই সব সংগঠনগুলির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯৩৩ সালে বিপ্লবী কালিকেশ ভট্টাচার্যের হাত ধরে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করেন। মহীতোষ বিল্পবীদের জন্য বই, রিভলভার, চিঠিপত্র ইত্যাদি পৌঁছে দিতেন। এ কাজ যথেষ্ট দায়িত্বের ছিল। পুলিশের নজরে পড়ার ঝুঁকিও কম ছিল না।

গোয়েন্দারা ডাক বিভাগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সন্দেহজনক চিঠিগুলি খুলে পড়ত। তেমনি এক চিঠির জন্য মহীতোষকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন স্কুল ছাড়তে হয়। চিঠির কথা পুলিশ তাঁর স্কুলের প্রধান শিক্ষককে জানালে তিনি মহীতোষের উপর চাপ সৃষ্টি করেন কে চিঠি পাঠিয়েছে জানতে। চিঠির বিষয় খুলে বলার জন্য চাপ দিলে তিনি মুখ খোলেননি। অবশেষে তাঁকে স্কুল পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিলেন প্রধান শিক্ষক।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-১৬: স্বাধীনতা আন্দোলনে অসমের পড়ুয়াদের ভূমিকা অপরিসীম

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৭: রাজা বীরবিক্রম মৃত্যুর কিছু দিন আগেই ত্রিপুরার ভারতভুক্তির সিদ্ধান্ত নেন

এর পরে মহীতোষ মৌলবী বাজার স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৭ সালে প্রবিশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন শিলচরে গুরুচরণ কলেজে। ক্রমশ স্বরাজের কাজে বিভিন্ন ভাবে জড়িয়ে যান। একই সঙ্গে সাংবাদিকতাও করতে শুরু করেন। কাছাড় জেলা ছাত্র ফেডারেশনের প্রথম সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন মহিতোষ। নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করতে গিয়ে ইংরেজদের বিরোধিতা করতে হয়। তাই সাহেবরা তাঁকে কারাবন্দি করার চেষ্টা করেন।

১৯৪০ সালে গন্ধীজি যুদ্ধ নীতির বিরোধিতা করে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের আহ্বান করেন। শিলচরের জননেতা অরুণকুমার চন্দ সেই সময় কাছাড় জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। তিনিও সত্যাগ্রহ করেন। শিলচরের সদরঘাটের আদালত চত্বরে এক বিরাট জনসভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় তিনি বলেন, “সাম্রাজ্যবাদী এই লড়াইয়ে হাম নেহি দেঙ্গে এক পাই, হাম নেহি দেঙ্গে এক ভাই।” তাঁকে তখনই পুলিশ গ্রেফতার করে। যাঁরা সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা এই একই ধ্বনি দিয়ে সভাযাত্রা বের করেন। তারপর দিন মহীতোষ পুরকায়স্থকেও পুলিশ গ্রেফতার করে। সাধারণ মানুষ এবং ছাত্ররা এর বিরুদ্ধে মিছিল বের করে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালে পর্যন্ত তিনি কারাগারে ছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৪২ সালে ২৪ ঘণ্টার নোটিসে ভারত রক্ষা আইনের সাহায্যে তাঁকে কাছাড় জেলা থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৪৫ সালে তিনি আবার শিলচর ফেরেন। স্বাধীনতার পরও তিনি সাংবাদিকতা এবং রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই অগ্নিযুগের মনীষীরা তাঁদের জীবন দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন দেশভক্তি কাকে বলে। সুরমা উপত্যকায় বিপ্লবীরা তিরিশের দশকে বিপ্লবীরা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে বেশ কিছু ডাকাতি করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে তিনসুকিয়া মেল ডাকাতিতে শিলচরের উমাশঙ্কর পাটোয়া, শচীন্দ্র নাথ দাস কুরি, বিপুলানন্দ কর চৌধরীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এদিকে শিলচর গুরুচরণ কলেজের প্রথম বার্ষিক শ্রেণির ছাত্র প্রমোদ রায়কে বদরপুর রেলস্টেশনে পুলিশ গ্রেফতার করে। উল্লেখ্য, সেই সময় তাঁর কাছে একটি রিভলবার পাওয়া যায়। বরাক উপত্যকার তৎকালীন জননেতা অরুণকুমার চন্দ ১৯৪১ সালে কারারুদ্ধ হন। অসুস্থতার জন্য তাঁকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গৃহবন্দি থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে তখন তিনি আর শিলচর ফেরেননি।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪০: দুর্বল বা অসহায়রা একত্র হলে তাঁরাই অজেয় হয়ে ওঠেন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৯: মহাভারতের বিচিত্র কাহিনিগুলিতে আছে মৃত্যুজয়ের অভয়বাণী

ইংরেজরা শ্রমিকদের সঙ্গে যথেষ্ট খারাপ ব্যবহার করত। তাঁদের দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে ১৯৩৯ সালে অরুণাবন্দ চা বাগানে এক বিশাল ধর্মঘট করে স্থানীয় চা বাগানের শ্রমিকরা। তাঁদের দাবি ছিল মজুরি বৃদ্ধি, বাগান কর্তৃপক্ষ যেন দুর্ব্যবহার না করে, হস্থক্ষেপ করা যাবে না ব্যক্তি স্বাধীনতায়। সেই ধর্মঘট বিরাট রূপ ধারণ করে। বাগান কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১২ জন নেতৃস্থানীয় শ্রমিককে বাগান থেকে বহিষ্কার করে। সেই সময় এগিয়ে আসেন অরুণকুমার চন্দ, কংগ্রেস জেলা সম্পাদক অচিন্ত্যকুমার ভট্টাচার্য। সনৎকুমার দাসের বাড়ি উধারবন্দে থাকায় তিনি সংগ্রামী শ্রমিকদের খাওয়াদার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর বাড়িতে।

দেশের স্বাধীনতার লাভের জন্য যাঁরা নিজেদের জীবনকে প্রাধান্য দেননি, তাঁদের কথা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। হাজারটা প্রতিবেদনেও দেশভক্ত বিপ্লবীদের কথা ফুরোবে না। আর এ কথাও স্বীকার করে নিতে হয় যে, অনেক বিপ্লবীদের ত্যাগ সম্পর্কে আমরা জানিও না। তবে কিছু কিছু নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকে। তাঁদের জীবন আসলে একটি সমুদ্র সমান। সেই সমুদ্র থেকে আমরা আহরণ করে নেই অনেক অজানা তথ্য।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content