মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


শিলচর সরকারি বিদ্যালয়। ছবি: সংগৃহীত।

বরাক নদী, বড়াইল পাহাড় এবং চা বাগান ঘেরা বরাক উপত্যকার ইতিহাসও যথেষ্ট গৌরবময়। স্বরাজের জন্য বরাকের সাধারণ মানুষও বিপ্লব করেছিলেন। সমাজের মেয়েরা নিজেদেরকে খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার মধ্যে আটকে রাখেননি, তাঁরাও পথে নেমেছেন। অল্প বয়সী ছাত্র-ছাত্রীরা এগিয়ে এসেছিল স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন চোখে নিয়ে। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী প্রত্যেক সেনানীর অবদান যথেষ্ট। তাঁদের ত্যাগের জন্যই আজ আমরা স্বাধীন দেশে মাথা উচু করে বাঁচতে পারছি।

স্বরাজের জন্য এই লড়াইটা শুরু হয়েছিল স্বদেশী আন্দোলনের আগে। কাছাড়ের সোনাইয়ে জমিদার সোনা মিয়া চৌধরী ১৮৩২ সালে প্রথম ব্রিটিশের বিরুদ্ধচরণ করেন। এর জন্য তাঁর কারাদণ্ডও হয়। উত্তর কাছাড়ের বর্তমান ডিমা হাসাও জেলার সম্বোধন ফাঙলোর কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়। ১৮৩২ সালে যখন কাছাড় ইংরেজদের অধীনে চলে গেল, তখন থেকেই ইংরেজরা যে ভারতীয়দের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধী করার জন্য ভারতীয়দের ব্যবহার করছিল সে কথা ফাঙলো প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি ধীরে ধীরে মাইবং এ ইংরেজ বিরোধী একটি সেনা গঠন করেন। ইংরেজরা সে খবর পেয়ে তাঁর শিবিরে আক্রমণ করে। ফাঙলো সেনাও নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে দেশের জন্য যুদ্ধ করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ইংরেজরা ফাঙলোকে গ্রেফতার করে। পরে তাঁকে হত্যাও করা হয়।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আইন চালু করেন লর্ড কার্জন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অসমের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সাধারণ মানুষ। এগিয়ে এলেন কামিনীকুমার চন্দ। তিনি নিজে একজন উকিল ছিলেন তাই শিলচর বার কাউন্সিসের উকিলদেরকে নিয়ে কাছাড় স্বদেশী সভা গঠন করেছিলেন। এই সংগঠনটি সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছড়িয়ে ছিল। ছাত্ররাও স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করেছিল। বিপিনচন্দ্র পাল বরাক উপত্যকার শিলচরে গিয়ে সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করতে আহ্বান জানান। স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা অংশগ্রহণ করেছিল। তাই কামিনীকুমার চন্দ এবং বিপিনচন্দ্র পাল কাঠিগড়া বড়খলা এবং লক্ষ্মীপুরে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করে তাদের স্বদেশী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বুঝিয়ে ছিলেন। ছাত্রদেরও স্বদেশী আনোদোলনে অংশগ্রহণ করে সরকারি স্কুলে না যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। ছাত্রদের যোগদান আন্দোলনকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তুললো।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-১৪: অগ্নিযুগের কন্যারা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য

ছাত্ররা বিদেশী দ্রব্য এবং বিদেশী বস্ত্র বর্জনের জন্য জোরাল আন্দোলন শুরু করে। শিলচরের গভর্নমেন্ট বয়েজ স্কুলের পড়ুয়ারা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু অভয় চরণ তৎকালী ইংরেজ সরকারের অধীনে থেকেও তাঁর ছাত্রদেরকে স্বদেশী বস্তু ব্যবহার করতে এবং বিদেশী জিনিস জ্বালিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে প্রেরণা দিয়েছিলনে। তিনি ছাত্রদের দেশের গৌরব রক্ষার জন্য, আত্মসম্মান রক্ষার জন্য লড়াই করতে শিখিয়েছেন। একবার গর্ভনারের এক প্রতিনিধি স্কুল পরিদর্শন করতে আসেন। ইংরেজ প্রতিনিধিকে তোষামোদের জন্য সেদিন এই স্কুলের ছাত্ররা এগিয়ে আসেনি।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫৬: আচমকা ‘বন্ধু’ কিশোরের প্রয়াণে ভেঙে পড়েছিলেন পঞ্চম

দশভুজা, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫: কৃষ্ণ মাণিক্য সিংহাসনে বসেই উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন আগরতলায়

১৯৩০ সালে ইংরেজ সরকার আইন চালু করেছিল যে, সরকারি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এবং অভিভাবকরা ইংরেজ বিরোধী কোনও রকম কাজ করতে পারবেন না। তখন অসমের শিক্ষা অধিকর্তা ছিলেন কানিংহাম। কানিংহামের চোখ রাঙানিকে পাত্তা না দিয়ে ছাত্ররা দলে দলে আন্দোলনে যোগদান করতে লাগল। গভমেন্ট বয়েজ স্কুলের ৩৯ জন ছাত্রকে স্কুল থেকে বহিঃস্কার করা হয়। ৩৮ জন ছাত্র ক্ষমাপ্রার্থনা করে আবার স্কুলে ফিরে গেলেও কামিনীকুমার চন্দের পুত্র সেই স্কুলে ফিরে না গিয়ে শান্তিনিকেতন চলে যান। ওই ৩৮ জন পড়ুয়া আবার স্কুলে ফিরলেও তারা নিজেদের দেশভক্তির জায়গা থেকে বিন্দু মাত্র দূরে সরে যায়নি। তাই তো বিপিনচন্দ্র পাল যখন শিলচরে এসেছিলেন, তখন এই গভমেন্ট বয়েজ স্কুলের এবং অন্যান্য স্কুলের ছাত্ররা তাঁকে অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে এসেছিল। সুরেন্দ্র মোহন এন্ডো ‘স্টুডেন্ট কমিউনিটি কাছাড়’ এর পক্ষ থেকে সম্বর্ধনাপত্র পাঠ করেছিলেন। বিপিনচন্দ্র পাল ছাত্রদের সঙ্গেও কথা বলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

১৯২১ সালের আগে বরাক উপত্যকায় মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভাবে ইংরেজদের অধীনে। একটি মাত্র স্কুলই ছিল মেয়েদের জন্য। স্কুলের এক জন শিক্ষক বলেছিলেন, জেনারেল ডি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ঠিকই করিয়েছিলেন। ভারতীয়দের সঙ্গে এমনটাই হওয়া উচিত। এই মন্তব্যে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্র এবং তাদের অবিভাবকরা মেনে নিতে পারল না। কামিনীকুমার চন্দের মেয়ে অমিতাকুমারী চন্দ তখন সেই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তেন । অমিতাকুমারী নিজের সহপাঠী কয়েক জনের সঙ্গে এই শিক্ষকে বিরোধিতা করে স্কুল ত্যাগ করেন। কামিনীকুমার মেয়েকে সমর্থন করছিলেন। তার পর শুরু হল মেয়েদের জন্য স্বদেশী স্কুল গঠন করার তোড়জোড়। কামিনীকুমার স্কুলের জন্য জমি দান করলেন। এগিয়ে এলেন অনেক দেশপ্রেমী মানুষও। গঠিত হল স্বদেশী স্কুল। এই স্কুল প্রতিষ্ঠিত করতে অনেকের অবদান থাকলেও শ্যামাচরণ দেবের নাম উল্লেখ করতেই হয়। আজ আমরা স্কুলটিকে ‘দীননাথ নবকিশোর বালিকা বিদ্যালয়’ নামে জানলেও বোর্ডে একটি বন্ধনীর মধ্যে ‘স্বদেশী স্কুল’ শব্দটিও রয়েছে।

সম্বোধন ফাঙলো। ছবি: সংগৃহীত।

ইংরেজ আমলের আগে কাছাড়ি রাজার রাজত্বে এখানে বেশ কয়েকটি স্কুল ছিল। কাছাড়ি রাজা গোবিন্দ চন্দ্রের রাজ সভায় বাংলা সাহিত্যচর্চা হতো তবে বিদেশী শিক্ষা রীতি তখন এ অঞ্চলে ছিল না। ইংরেজ সাহেব টি ফিসার এ অঞ্চলে স্কুল চালু করার প্রস্তাব দেন। প্রথমে শিলচর, হাইলাকান্দি এবং কাটিগড়াতে স্কুল চালু হয়। বিদেশী রীতিনীতি এবং শিক্ষার সুত্রপাত হল তাতে। ইংরেজি ভাষাও সেখান হল। তবে এ কথা মেনে নিতেই হয় যে, ইংরেজদের স্কুলে কিংবা ইংরেজ শিক্ষকদের কাছে পাঠ গ্রহণ করেও ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের মনে স্বরাজের গুরুত্ব কমে যায়নি কখনও। তাই তো নিজেদের ব্যক্তিগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content