শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


কিন্তু জানালার পাশে ওরা অনেকে বসে আছে তারাও বাইরের দিকে তাকিয়েই ছিল। তাদের মধ্যে কোনও বিকার নেই। তাহলে কি আমি ভুল দেখলাম? ট্রেনের যে গতি তাতে কোন সুস্থ মানুষ অত কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।

অদ্ভুত লাগছে কিন্তু। আমার ঠিক সামনের জোড়া সিটে এক কমবয়সী স্বামীস্ত্রী বসে আছেন। ওরা জানলায় দেখছে না। দু’ জনেই দুজনের মোবাইল ফোনে মশগুল। ওদের যদি গিয়ে আমি বলি।

—এই যে ভাই শুনছেন এখুনি দেখলাম লাইনের একেবারে পাশে একটি টিনেজ মেয়ে। উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে। ট্রেনটা কি থামাবো?

এখন অবশ্য সেই উদ্ভ্রান্ত কিশোরীকেই অনেকদূরে ফেলে এসেছি। কিন্তু যদি বলি।

—আপনি হয়তো সেই কিশোরীকে দেখতেই পাননি। কিন্তু আমি পাই। আমার একজন অশরীরী বান্ধবী আছে। মোহিনী। মিস মোহিনী।
এসব শুনলে ছেলেটির কি রিঅ্যাকশন হবে? আমার দিকে তাকাবে। তার স্ত্রীর দিকে তাকাবে। আমাকে দেখলে গুন্ডা বদমাইশ বা পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক মনে হবার কোন কারণ নেই। ছেলেটির নিরুত্তাপ হয়ে আমাকে বলতে পারে।

—আচ্ছা। কিন্তু এটা শুনে আমি কি করবো? আপনাকে নিয়ে বা আপনার অশরীরী বান্ধবীকে নিয়ে আমার আই মিন আমাদের কোন ইন্টারেস্ট নেই।
অথবা উটকো ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে যাওয়া টাইপের মানুষ হলে ছেলেটি তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ভুরুর একটা হালকা ইশারায় বলবে ‘পাত্তা দিও না’। কিংবা সে যদি একটু বদরাগী-গোছের হয় বা কোন কারণে মুড খুব খারাপ থাকে, তাহলে মুখের উপর বলে দিতেই পারে।

— দেখুন দাদা আপনি কী দেখেছেন আপনি জানেন। দরকার হলে টিটিকে গিয়ে বলুন। নাহলে আপনার জায়গায় চুপচাপ বসুন। আমাদের এসব ফালতু কথা শোনার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।

এ ভাবে কথা বলার জন্যে আশপাশে উচিত-কথক কেউ থাকলে তিনি বা তাঁরা প্রতিবাদ করতে পারেন। তাতে একটা তর্কাতর্কির সম্ভাবনা থাকছে। সবটাই অবশ্য সম্ভাবনা।

বিখ্যাত পোলিশ চিত্রপরিচালক ক্রিজস্তফ কিয়েসলোস্কি। ‘ব্লাইণ্ড চান্স’ নামের তার ছবির বিষয় ছিল সম্ভাবনা। ছবির নায়ক মেডিকেল স্টুডেন্ট। নাম উইটেক। পোল্যান্ডের লোজ থেকে ওয়ার্শ যাবে। ছুটে এসে শেষ মূহুর্তে ট্রেন ধরছে। দূর্ভাগ্যক্রমে সামনে পড়ে গেল অন্যদিকে তাকিয়ে বিয়ারে চুমুক দেওয়া একজন। কোনওক্রমে ধাক্কা বাঁচিয়ে উইটেক ট্রেনটা ধরে ফেলল। ট্রেনেই কৈশোর জীবনের প্রেমিকা জুৎস্কার সঙ্গে হঠাৎ দেখা।

এবার যদি উইটেক ট্রেন মিস করত? ধরা যাক চেষ্টা করেও বেচারি সেই বিয়ারে চুমুক দেওয়া লোকটির সঙ্গে ধাক্কা বাঁচাতে পারল না। কাচের বিয়ার মাগ ভাঙ্গল উইটেক আবার উঠে দাঁড়াল কিন্তু প্রাণপণে দৌড়ে লাফ দিয়েও ট্রেন ধরতে পারলনা। উলটে প্ল্যাটফর্মে মুখ থুবড়ে পড়ে একজন গার্ডকে ধাক্কা দিয়ে ফেলল গ্রেফতার হল।
আরও পড়ুন:

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৮: মাথার চুলটা পেছন থেকে এসে মুখটাকে ঢাকা দিয়ে দিয়েছে, মেয়েটি কি লাইনে ঝাঁপাতে চাইছে?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২: চলমান সুন্দরবন

অথবা শেষ মুহুর্তে উইটেক বিয়ারপ্রেমিকের সঙ্গে ধাক্কা বাঁচাতে পারল কিন্তু ট্রেন চলে গেল। আর এবার হঠাৎই তার ডাক্তারিপাঠের সহপাঠী বান্ধবী ওল্গার দেখা পেল। এই তিনটি সম্ভাবনায় তিনটি আলাদা আলাদা গল্প কিভাবে সৃষ্টি হয় সেই নিয়েই বিশ্বখ্যাত ক্রিজস্তফ কিয়েসলোস্কি অন্ন্যসাধারণ ছবি ‘ব্লাইণ্ড চান্স”। ঠিক যেমন এখন আমি ভাবছি।

দুর্গাপুর থেকে সাড়ে সাতটায় ট্রেন ছাড়ার কথা ছেড়েছে সাতটা তেত্রিশে। সেই পিছলে যাওয়া তিন মিনিট পুষিয়ে দিয়েছে ভয়ংকর গতিতে। ছোটবেলার “দাদা কোথায় দিদি কোথায়” নয়! “দাদাদা-দিদিদি” গতিতে ছুটেছে ট্রেন। এখন আর থামাথামির কোন গল্পই নেই। রাত সাড়ে নটায় হাওড়া ঢুকবে। দুপাশ দিয়ে চেনা-অচেনা স্টেশনগুলো যেন ট্রেনের আলোর পরশ লেগে ঝলসে উঠতে উঠতেই মিলিয়ে যাচ্ছে।

আমি একজনের মুখ থেকে অন্য জনের মুখে যাচ্ছি। মুখ চোখের ভাঁজ দেখে দেখে মনের ভাব বোঝার চেষ্টা করছি। কেউ একটা গুরু গম্ভীর অর্থনীতির পত্রিকা চোখের সামনে ধরে আছে কিন্তু পড়ছে না। যেন সেই সুকুমার রায়ের “ঠোঙ্গা-ভরা বাদামভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না!” কেউবা আধবোঝা চোখে ট্রেনের “দোল-দোল দুলুনি” উপভোগ করছেন। এরকম ভিড়ে দু-একটা ভয়ংকর কেজো লোক থাকবেই। যারা সেই মুহূর্তে কাজ না করলে ভারতের তো ক্ষতি বটেই সারা বিশ্বে একটা আলোড়ন পড়ে যেতে পারে। তাই তারা কোলে ল্যাপটপ পেতে লাভক্ষতির ঝোল টানছেন। পুরনো বাংলা ছবির মত আজকাল ট্রেনে নৃপতি চক্রবর্তী বা তরুণ কুমারের মতো সহযাত্রী পাওয়া যায় না। আজকাল কেউ বেফাঁস কথা বলতে চান না। কথা বলে বোকা বনতে কেউ রাজি নন। তাই সেই সব বুদ্ধিমান মানুষেরা দক্ষ দর্জির মতো নিজ-নিজ বুদ্ধির ফিতে খুলে সকলে সকলকে আড়চোখে মাপছেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৭: লতা-কিশোর-পঞ্চম-গুলজারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কই শিকওয়া নেহি’

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৪: এ শুধু অলস মায়া?

ঠিক এমন একটা সময় সেই অঘটনটা ঘটলো। কাউকে কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়ে আচমকা ঝুপ করে ট্রেনের সব আলো নিভে গেল। কানে তালা লেগে যাবার মতো আচমকা নৈঃশব্দ্য। ট্রেনের চাকা গড়াতে গড়াতে গড়াতে এক সময় থেমে গেল। ঝিঁঝিঁ ডাকা নিশ্চুপ অন্ধকার মাঠ। দু চারজন অতি উৎসাহী মোবাইলের বিন্দু আলোতে চাপ চাপ অন্ধকারকে ভেদ করতে গিয়ে বিফল হলেন। আর ঠিক তখনই দরজার কাছে তাকে দেখে চমকে উঠলাম।

ট্রেন ছাড়া ঠিক পরপরই যাকে দেখলাম। সেই অদ্ভুত কিশোরী। রেল লাইনের একেবারে পাশে। প্রায় তাকে ছুঁয়ে দিয়ে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। একটি টিনেজ মেয়ে। উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে। মুখ দেখা যাচ্ছে নয়া। মাথার পেছন থেকে সামনে আসা লম্বা চুলে কিশোরীর মুখ ঢাকা পড়েছে। এক হাতে অদ্ভুত একটা পুতুল? আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এসি চেয়ার কার। কাচের দরজার দিক থেকে এল। দরজার বাইরে থেকে বন্ধ কাচের দরজা দিয়ে যেন ভেসে কামরার মধ্যে এসে গেল। ভাসতে-ভাসতেই সে যেন এগিয়ে আসছে মধ্যের করিডর দিয়ে। নিকষ কালো একটা দম আটকানো অন্ধকারের মধ্যে হালকা নীলচে আলোই তার অবয়ব স্পষ্ট। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলাম আরো এক হাড় হিম করা দৃশ্য।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৬: কবির অসুখ-বিসুখ

বিচিত্রের বৈচিত্র, মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

কাচের দরজাটায় দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের আঙ্গুল বা হাতের কব্জি। মোটা বেঁটে লম্বাটে আঁকাবাঁকা নানা ধরনের আঙুল। কয়েকটা আঙুল আবার কাটা। আমি তাকাতে পারছি না। আমার গা গুলোচ্ছে। আমি প্রাণপণে যেন নিজেকে বোঝাচ্ছি।

— কুল! কুল!! এসব মায়া। হ্যালুসিনেশন। একটা বা দুটো কাউন্সেলিং। অল্প কিছু ওষুধে সেরে যাবে। মনের ভুল।

ঠিক তখনই প্রায় আমার গায়ের কাছ থেকে কে যেন বলে উঠলো।

— মায়া নয়। হ্যালুসিনেশন নয়। ওরা সকলেই আছে।

আমার একেবারে পাশটিতে সেই চুলে মুখঢাকা কিশোরী। গলাটা চেনা। ভীষণ চেনা। সেই স্যুইমিং পুল। রাতে নিজের বাড়ীর সামনে সেই ঠিকানা খোঁজা মহিলা বা হোটেলের রিডিং সেশনের ঠিক পরে যে মহিলা প্রশ্ন করেছিল। গতরাতে যিনি টেলিফোনে এসেছিলেন। আমার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির শরীরের ঘ্রাণ আমার নাকে। শ্মশানে আগুনে দাহ হতে থাকা চামড়া মাংস পোড়া গন্ধ। আবার বলল

— আমরা অনেকে এসেছি। তোমায় দেখতে।

মোহাবিষ্ট মায়াবী কণ্ঠস্বর। চেনা বলার ঢং। তবে কি মোহিনী?—চলবে।

সোজা বাঁকা আঙুল ছোটবড় নানা হাত কব্জি। ছবি: সংগৃহীত।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content