শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সেদিন আমি কিছুটা আতঙ্কিত হয়েই দু’জনের হাত ছেড়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছিলাম, সে এক ভয়ংকর অনুভূতি। আমাদের পরের সপ্তাহে যেতে বলা হল। বলা হল সেদিন সম্ভব হলে এই নিয়ে আরও একটু খোঁজখবর নিয়ে আসতে। তাঁকে জানাতে হবে না। আমি জানলেই হবে।

আমার সূত্র বলতে তো শবনম। কিন্তু তার বিয়ে হয়েছে রক্ষণশীল পরিবারে। আমার পক্ষে সরাসরি কথা বলাটা ঠিক হবে না। অথচ আরো কিছু তথ্য জানাটা খুব জরুরি। কেন জরুরি সেটা শবনমকে বলা যাবে না কিন্তু বুনিকে তো বলতে হবে।

বুনিকে সব খুলে বললাম। ও বেশ অবাক হলেও আমাকে মানা করল।

—বেশ আমি শবনমকে ফোনে বলছি। আমি কথা বলে দেখি, যদিও কিছু বলতে পারে তোমায় জানাবো।

আবার সেই ঘরে বসে আছি। সেই তেপায়া টেবিলের সামনে তিনটি চেয়ারে আমরা তিনজন। আমি দেবরাজবাবু আর ঈপ্সিতা চ্যাটার্জি। তিনজন তিনজনের হাত সেভাবেই ধরে আছি। টেবিলের মাঝখানে সেই সুগন্ধি মোমবাতিটা জ্বলছে। এই মোমবাতির গন্ধটা কী রকম যেন সম্মোহন করে। সত্যি বলতে কি প্রথম দিন একটা অবিশ্বাস ছিল। আমি কখনওই আত্মাতে বিশ্বাস করতাম না। নিজের উপর দিয়ে পরপর ঘটনাগুলো ঘটে না গেলে হয়তো কোনও দিনই করতাম না। কিন্তু এখন করি। আমার মনের ডাক্তারনী যতই এটাকে মনের ভুল বলে প্রমাণ করতে চান তবু করি।
তবে সত্যি সত্যি কোন মিডিয়াম চট করে এমনভাবে আত্মাকে ডাকতে পারেন এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। আর পারিনি বলেই আচমকা ঈপ্সিতা চ্যাটার্জির গলায় মাসুদার উপস্থিতি আমার কাছে বড় আচমকা মনে হয়েছিল। তারপর যখন দেবরাজ বাবু ঈপ্সিতা চ্যাটার্জির মতো করে আমাকে কথা বলতে বললেন তখন আমি স্তম্ভিত। আর তারপর সেই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটলো। অন্ধকার ঘর। ঘরটা বেশ বড় হালকা পিচ কালারের দেওয়াল। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য দেখে জানলায় পাতলা ফিনফিনে মসলিনের সাদা পর্দা।

বাড়িটা বাংলো মতো। আলিপুরের ওধারে এমন বাড়ি এখনো আছে। গাছপালা দিয়ে সযত্নে ঢাকা দেওয়া বাড়ি। রাস্তা থেকে চট করে নজরে আসে না। অত ঘন গাছপালার মধ্যে বলে বাড়ির ঘরগুলো বেশি ঠান্ডা। আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল শহরের প্রাণকেন্দ্রে হলেও এই দিকটা লোকজন খুব একটা থাকে না মানে গাড়ি-ঘোড়া বেশ কম চলে। হর্নের আওয়াজে অত শোনা যায় না। সেই প্রথম দিন আমি যখন খানিকটা সম্মোহিতের মতো মাসুদাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললাম তখন নিজের অজান্তেই চোখটা খুলে ফেলেছিলাম। ঈপ্সিতা আমাকে চোখ বন্ধ করতে বলেননি। কিন্তু আফিফার কথা ভাবতে গিয়ে চোখটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-২০: চুপ, মাম্মা আসবে! শি উইল কাম নাও

ফেলে আসা স্মৃতি: সুরসম্রাজ্ঞী দীপালি নাগ, পর্ব-৩: সেই প্রথম হল শোনা ‘আমার মনের বেদনা’

মাসুদার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যে দিক থেকে তার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে সে দিকটায় চোখ গিয়েছিল। হ্যাঁ, এখানে আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার বলা হয়নি। মাসুদার কথাগুলো ঈপ্সিতা চ্যাটার্জির মুখ থেকে শুনছিলাম বটে কিন্তু সেটা আসছিল দূরের জানলা থেকে। আমার পাশ থেকে নয়। অথচ আমি বুঝতে পারছিলাম যে ওঁর ঠোঁট নড়ছে। দূরের যে জানলার সাদা পর্দাটা উড়ছিল ঠিক সেখান থেকে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে যেন মাসুদাকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। মানে মাসুদাকে তো আমি আগে দেখিনি বা কেউ তার বর্ণনাও আমাকে দেয়নি।

কিন্তু তার চেহারা দেখে আমার মনে হল এটাই মাসুদা। ঠোঁটের ওপরে আঙুল তুলে রয়েছে চোখটা আমার দিকে। মাথাটা একটু নামানো। শরীরের যে অংশগুলো দেখতে পাচ্ছি সেগুলো উজ্জ্বল অদেখা অংশগুলো অন্ধকারে মিশে আছে। আমার কাছাকাছি আসার পরে ঠিক সেই রাতের মতোই আচমকা একটা সাদা চাদরে যেন জড়িয়ে গেল মাসুদা সে ছটফট করছে হাঁপাচ্ছে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে ছোট ছোট দুটো হাত পা দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছে বন্ধ চাদরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে। সেই ভয়ংকর নৃশংস দৃশ্য দেখে আমি আর থাকতে পারিনি।

সেদিন আবার আমাকে বলা হল—

—আপনি আরও যা যা নতুন জেনে এসেছেন সেগুলো নিয়ে ভাবুন। আপনি আপনার পরিচিতার কথা। আপনার আশেপাশে তার অস্তিত্বের কথা ভাবুন। ভাবুন তিনি কী পছন্দ করতেন। কীভাবে কথা বলতেন। কী কথা বলতেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

ইনি একজন পেশাদার “ঘোস্ট বাস্টার” এটাই ওঝার আধুনিক সংস্করণ। ওঁর গলার মধ্যে কথা বলার মধ্যেও একটা সম্মোহন রয়েছে। উনি এই কথাগুলো যখন আমায় বলছেন তখন আমার হঠাৎ মনে হল আশ্চর্য এই ঘরের যে রং সেটা আফিফার খুবই পছন্দের। যে বয়সের মেয়েরা লাল নীল সবুজ কমলা, এইসব চড়া রং পছন্দ করত সেই বয়সে আফিফার পছন্দ ছিল প্যাস্টেল শেডের রং যে রং-এর মধ্যে উত্তাপ কম উজ্জ্বলতা কম একটা হালকা মসৃণতা আছে। আফিফার সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি বা নেলপলিশ লিপস্টিক সবেতেই সেই হালকা রঙের আধিক্য। খুব যে একটা গিফট প্রেজেন্ট করেছি তা তো নয়! চাকরিবাকরি করি না।

বাবার দেওয়া হাত খরচা থেকে বাঁচিয়ে ছোটখাট নেলপলিশ বা লিপস্টিকই তো হয়! আমি পছন্দ জানতাম। তাই কখনও কোন গিফট বদলাতে হয়নি। আসিফা আমার কাছ থেকে গিফট পেতে খুব পছন্দ করত। জানতো আমি হাত খরচের পয়সা বাঁচিয়ে এসব করি। কিন্তু সে নিয়ে কোনদিন একবারও বলেনি “কেন এসব কিনেছো।” গিফট হাতে পেলে ঝকঝক করত ওর মুখ চোখ।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১২: জয়রামবাটিতে প্রত্যাবর্তন

আচমকা আমার ঠিক পাশে কারও একটা নড়াচড়া অনুভব করলাম। সুইমিং পুল থেকে ফেরার পথে যেদিন গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলাম ঠিক তার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আফিফার উপস্থিতি আমি বুঝতে পারতাম। ওই দিন ওই ঘটনা ঘটার পর থেকে আফিফা হারিয়ে গিয়েছে। আজ আবার বুঝতে পারলাম আফিফা আমার কাছে। আমার ঠিক পাশে। ঠিক যেমনভাবে পরিচিত কারো উপস্থিতি বোঝা যায়। ঈপ্সিতা কথা বলতে শুরু করল। মাসুদার গলা, আমি আগে কখনও শুনিনি। সেদিন ধরে নিয়েছিলাম কমবয়সী বাচ্চা মেয়ের গলাটা মাসুদারই হবে। কিন্তু আজ আমি আফিকার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। চেনা মানুষের শুধু গলা নয়, কথা বলাটাও চেনা হয়। ঠিক সেভাবেই কথা বলছেন ঈপ্সিতা চ্যাটার্জী।

কিন্তু কথাগুলো স্বাভাবিক নয়। আফিকা যেন চিৎকার করে কারো সঙ্গে ঝগড়া করছে—

—আমি জানি সব জানি। দুবাই থেকে তোমাকে কেন সব কিছু বন্ধ করে আচমকা বাড়ি আসতে হয়েছে সেটা আমি জেনে গিয়েছি। আবার সেই নোংরা ব্যবসার মধ্যে তুমি ঢুকছো। আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না।

এই কথাগুলো বলার পর মুহূর্তে যেন একটা প্রচণ্ড ধাক্কায় আফিফার শরীরটা দূরে জানালায় গিয়ে ছিটকে পড়ল। আমি চমকে উঠে দেখলাম আফিফা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে গোটা মুখটা রক্তাক্ত। অতি কষ্টে গোঙাতে গোঙাতে আফিফা মানে ঈপ্সিতা চ্যাটার্জী বলে উঠলেন—

—এই ভালো। শেষ করে দাও। আমাকে এই কথার মধ্যেই অদ্ভুতভাবে ঈপ্সিতা চ্যাটার্জির গলা থেকেই মাসুদার আতঙ্কিত কন্ঠস্বর বেরিয়ে এল।

—মাম্মা।

—মাসুদা বেটি…
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৫: আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে / খুঁজে পেতে আনি খেতে-নয় বড় সিধে সে!…

পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…

একই সঙ্গে দুটো আলাদা গলা মিলেমিশে বেরিয়ে আসছে ঈপ্সিতা চ্যাটার্জির কণ্ঠস্বর থেকে। মেয়েকে সম্ভবত ধরতে এগিয়ে গিয়েছিল আফিফা। তার স্বামী ফিরোজ বাধা দিতে যেন হিংস্র বাঘিনীর মতো ফুঁসে উঠলো সে।

—এই! আমার মেয়ের গায়ে তোমার ওই নোংরা হাত ছোঁয়াবে না তুমি!!
ঈপ্সিতা চ্যাটার্জির কথার মধ্যেই আমি মাসুদার আতঙ্কিত কান্না শুনতে পাচ্ছি। তাকে জড়িয়ে ধরে আফিফা যেন কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো।

—একটা কাজ করো আমাদের দুজনকে একসঙ্গে শেষ করে দাও আমাদের তোমার সঙ্গে আর বেঁচে ত্থাকা সম্ভব নয়, আমাদের শেষ করে দাও তারপর তোমরা যা খুশি করো।

কথাটা শেষ হল না আফিফার শরীরটা যেন একটা সাদা চাদরের মধ্যে জড়িয়ে গেল। কাঁপতে থাকা মোমবাতির আলোয় আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সেই চাদরের মধ্যে থেকে ছোট্ট মেয়ে মাসুদা, তার মা আফিফা দু-হাতপা ছুঁড়ছে। মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তাদের দু’ জনের গোঙানি আমি শুনতে পাচ্ছি শ্বাস আটকে যাওয়া ছটফটানি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার চোখের সামনেই যেন আজ ওরা তিলেতিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

এতক্ষণ নড়তে থাকা হাত পাগুলো ক্রমশ এলিয়ে পড়ল আর হঠাৎ ধপ করে সেই চাদরমোড়া এলিয়ে পড়া শরীর দুটোতে আগুন ধরে গেল। পোড়া শরীরের চড়চড় শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমার নাকে আসছে আবার সেই চামড়া-পোড়া মাংস-পোড়া গন্ধটা। এই ঘর কালচে ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে।—চলবে।

চাদরে মুড়ে দমবন্ধ প্রাণ।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content