পরিবার একান্নবর্তী হোক বা ‘কাহানী আপনা আপনা’ নিজেদের নিভৃত গৃহকোণটিকে নিয়ে কিন্তু আবেগের কোনও সীমা-পরিসীমা নেই মানুষের। কীভাবে, কোন সাজে সাজালে সে হয়ে উঠবে সবার মাঝে অনন্যা ও অন্যতমা এই নিয়ে মাথাব্যথার শেষ যেমন নেই তেমনই ইচ্ছানুযায়ী বাড়ি সাজানো আদৌ আপনার সাধ্যাতীত নয় তো? আপনার এই সমস্ত প্রশ্ন ও ধন্দের উত্তর নিয়ে থাকছেন বিশিষ্ট স্থপতি অনির্বাণ দত্ত।
গৃহসজ্জাকে যথাযথভাবে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য যেমন প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম নান্দনিক বোধ ঠিক ততটাই প্রয়োজনীয় এর গঠনশৈলীর সঙ্গে প্রযুক্ত যথাযথ কাঁচামাল নির্বাচনের ক্ষমতা এবং আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করা ক্ষমতা। এই যুগলবন্দিই আপনার গৃহসজ্জাকে করে তুলতে পারে আপনার মনমতো এবং যথেষ্ট নান্দনিক শৈলীসম্পন্ন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য—কাঁচামাল নির্বাচনের বিষয়টি কিন্তু সম্পূর্ণভাবে প্রজেক্ট বা বিষয়বস্তুর বাজেটের ওপর নির্ভর করে থাকে। কোনও কিছু বা কোনও বিষয়ই চিরস্থায়ী নয়, আপেক্ষিকতার এই সূত্র মেনে নিলে একথাও সত্য যে গৃহসজ্জার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট কোনও আর্কেটাইপই যথার্থতার সংজ্ঞায়নে সংজ্ঞায়িত হতে পারে না। তবুও অভিজ্ঞতার নিরিখে কথা বলতে গেলে একদা কিছুটা হলেও মানতে হবে যে, সঠিক উপাদানের প্রয়োগ, যে কোনও গৃহসজ্জার সৌন্দর্যকেই করে তুলতে পারে দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই। নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদে তারই বিশদ উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
প্লাইউড নির্বাচন : আধুনিক প্রযুক্তির নির্মাণে প্লাইউড একটি অবশ্যম্ভাবী উপকরণ। ভালো কাঠের অপ্রতুলতার জন্য আজ সার্বিকভাবে প্লাইউডের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। বাজারে বিভিন্ন মানের প্লাইউড বর্তমান সময়ে সহজলভ্য। প্লাইউডের দাম নির্ধারিত হয় এর গুণমানের ওপর ভিত্তি করে। প্লাইউড নির্বাচন করার সময় যে জিনিসগুলির ওপর নজর দেওয়া উচিত, সেগুলি হল—
প্লাইউডের গ্রেড : নিজের বাড়িতে ন্যূনতম বিডব্লুআর ৭১০ গ্রেডের প্লাইউড ব্যবহার করা উচিত৷ বিডব্লুআর কথাটির অর্থ হল ‘বয়েলিং ওয়াটার রেসিস্টেন্স’, অর্থাৎ ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ফুটন্ত জলে প্লাইউডটি রেখে দিলেও মানগত দিক থেকে এর কোনও বিচ্যুতি ঘটবে না। বিডব্লুআর গ্রেড প্লাইউড তৈরি করার সময় ফেনল ফর্মালডিহাইড কেমিকাল ব্যবহার করা হয়, যা এর জলবিরোধী গুণমানকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে। ৭১০ গ্রেড হল উচ্চমানের আইএসও গ্রেড যা এর গুণগতমানকে প্রত্যয়িত করে৷
অন্যান্য বিশিষ্ট : ৭১০ গ্রেডের সঙ্গে যে কটি বৈশিষ্ট্য দেখে নেওয়া উচিত সেগুলি হল—অ্যান্টি টার্মাইট এবং অ্যান্টি বোরার মান। নিখুঁত পৃষ্ঠতলের জন্য দরকার ক্রমাঙ্কন বা ক্যালিব্রেশন (calibration)। বাজারে সবদিক থেকেই ক্রমাঙ্কন প্লাইউড বর্তমান। একটি ১৯এমএম বিডব্লুআর এবং ৭১০ গ্রেড প্লাইউডের ন্যূনতম ওজন হওয়া উচিত ৪২ কেজি৷ বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠান, তাদের প্লাইউডের সঙ্গে কুড়ি বছর বা পঁচিশ বছরের ওয়ারেন্টি লিখিতভাবে দিয়ে থাকে. প্লাইউড কেনার সময় অবশ্যই লিখিতভাবে সার্টিফিকেট নিয়ে নেওয়া উচিত এবং ভবিষ্যতে কোনও ত্রুটি দেখা দিলে প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের কথামতো সেই সমস্ত প্লাইউড প্রতিস্থাপন করতে বাধ্য থাকবে।
উন্নতমানের আঠা নির্বাচন : নির্মাণ শিল্পের ক্ষেত্রে ফেভিকল হল একটি বহুল প্রচলিত আঠা। বাজারে ফেভিকল কোম্পানির বিভিন্ন গ্রেডের আঠা পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে আসবাবপত্রর জন্য ফেভিকলের মেরিন গ্রেড আঠা হল ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ। মেরিন গ্রেড ব্যবহার করলে, ভবিষ্যৎ-এ laminate বা জয়েন্ট আলগা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সাধারণ ফেভিকলের থেকে মেরিন গ্রেডের মূল্য কিন্তু সামান্যই বেশি। কিন্তু এই আঠার ক্ষেত্রে সবথেকে স্বস্তির বিষয় হল এটি যে এই নির্দিষ্ট আঠাটি কাঠের কাজের স্থায়িত্ব বাড়াতে অনেকটাই সাহায্য করে।
প্লাস্টার : যে কোনও দেওয়ালেরই গুণগতমান রক্ষার্থে এবং রঙের সম্পূর্ণতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অনেকটা দায়িত্বই কিন্তু থাকে প্লাস্টারের ওপর। প্লাস্টার করার সময় সিমেন্ট এবং বালির যথাযোগ্য সংমিশ্রণ এবং অনুপাতগত ভারসাম্য ভীষণ জরুরি। ডিলারের অভ্যন্তরীণ প্লাস্টার করার ক্ষেত্রে সিমেন্ট এবং বালির অনুপাত হওয়া উচিত— ১:৪, অর্থাৎ এক ভাগ সিমেন্টের সঙ্গে মিশ্রিত হবে চার ভাগ বালি। মাঝারি দানার বালি ব্যবহার করলে প্লাস্টারের গুণগতমান শ্রেষ্ঠতর হয়৷ যদিও, এক্ষেত্রে একটি ভ্রান্ত অছে, সেটি হল, প্লাস্টারের সময় মিহি দানার বালি ব্যবহার করলে এবং মাঝারি দানার বালি ব্যবহার করলে, পৃষ্ঠতলে যে রুক্ষতা তৈরি হয়, তা পরবর্তীকালে পুটটির উপাদান জমাট বাঁধতে সাহায্য করে এবং পুটটির বাঁধন দৃঢ় হয়। বর্তমানে পরিবেশ দূষণের কারণে, উচ্চ মান যুক্ত মাটি পাওয়া বিরল. ফলত ইটে নোনা আসার সম্ভাবনা বেশি। তাই প্লাস্টার করার সময় প্রথম থেকেই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই কেমিক্যাল কম্পাউন্ড ব্যবহার করা উচিত—প্লাস্টারের সংমিশ্রণে, তাহলে ভবিষ্যতে নোনার আক্রমণ থেকে বাঁচা সম্ভব। সিলিংয়ে প্লাস্টারের ক্ষেত্রে এর অনুপাত হওয়া উচিত ১:৩।
ইলেকট্রিকাল ওয়্যারিং : যথাযথ এবং নিরাপদ গৃহসজ্জার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বাড়িতে ইলেকট্রিকাল ওয়ারিঙের সময় নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলা। এক্ষেত্রে সমস্ত সুইচের (সিঙ্গেল লুপ) সংযোগ করা উচিত ১.৫ স্কয়ারে মিলিমিটার তার সহযোগে, ডাবল লুপ-এর সুইচ বা সকেট পয়েন্টসের সংযোগ করা উচিত ২.৫ স্কয়ারে মিলিমিটার তার দিয়ে, যে কোনও ইলেকট্রিকাল যন্ত্র (যেমন ওয়াটার হিটার, বাতানুকূল যন্ত্র, বা চিমনি) বা ১৬ এমপি৷ প্লাগ পয়েন্টের সংযোগ করা উচিত ৪ স্কয়ারে মিলিমিটার তার দিয়ে৷ ইলেকট্রিকাল তার নির্বাচন করার সময় অবশ্যই আন্টি-স্মোক তার ব্যবহার করা উচিত৷ মাইন সুইচ বা ডিবির সংযোগ করা উচিত ৮ স্কয়্যার মিলিমিটার তার এর মাধ্যমে।
ছবি : লেখক