মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


বড় দেবী মা ভবানী। পাশে জয়া বিজয়া। ছবি: সংগৃহীত।

সোনার মদনমোহন তাঁর অলঙ্কার-সহ নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না। অপহৃত হলেন। মূর্তি চুরির পর ক্ষোভ দুঃখ মিশে গিয়েছিল কোচবিহারবাসীর মনে। এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় শহরে। কোনওভাবেই যখন মূর্তি চুরির সমাধান হচ্ছে না, শোনা যায় মূর্তি গলিয়ে ফেলে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তখন ১৯৯৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের সভায় নতুন মূর্তি স্থাপনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

সেই সূত্রেই ওই বছরের ১২ নভেম্বর বিশেষ পুজো ও অনুষ্ঠান করে শাস্ত্রীয় বিধান অনুসরণ করে নতুন মদনমোহন মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। নতুন মূর্তি ও ছাতা তৈরি করে আনা হয় বেনারস থেকে। রূপোর চৌদোলায় দুটি মূর্তি থাকে। বড় মদনমোহন ও ছোট মদনমোহন। তবে রথযাত্রা, রাস যাত্রা, দোলযাত্রা সবেতেই বড় মদনমোহনকেই সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। নতুন করে দুটি মূর্তিকেই স্থাপন করা হয়েছে। একই ভাবে পূর্ব রীতিতেই সমস্ত উৎসব হয় আজও।
কোনও ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়নি। ১২১৯ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৮১২ সালে নভেম্বর মাসে মহারাজা রাজধানী স্থানান্তরিত করেন আঠারকোঠায়। ওই কার্তিক পূর্ণিমায় রাস যাত্রার দিন সন্ধেবেলা সবাইকে নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করলেন হরেন্দ্র নারয়ণ আর ওই দিনই রাস যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনটিকেই আজ পর্যন্ত রাস যাত্রা শুরুর দিন হিসেবে ধরা হয়। রাস মেলার বয়স দুশো বছর অতিক্রম করে আরও দু’ দশক কাটিয়ে দিয়েছে বর্তমানের নিরিখে। বিশ্বের দরবারে জায়গা নেওয়া এই বৃহত্তম মেলা কোচবিহারের প্রাণ।

মদনমোহন বাড়ির পরেই কোচবিহার শহরের পশ্চিম প্রান্তে প্রায় তোর্সা উপকূলে রাজবাড়ির দক্ষিণে দেবী বাড়ি পাড়ায় অবস্থিত বড় দেবীর মন্দির বা দেবী বাড়ির দুর্গাপুজোর স্থায়ী পাকাপোক্ত মন্দির স্থান। বর্তমান বকুলতলা মোড় তোর্সা বাঁধ লাগোয়া, তারই উত্তরদিক ধরে এগিয়ে অল্প হাঁটলেই দেবী মন্দির। শারদীয়ায় এই বিশেষ পুজো কোচবিহার রাজ্য থেকে বর্তমানের শহরকে আলোড়িত করে রাখে পুজোর চার পাঁচ দিন।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১১: দেব-দেউল কথা ও মদনমোহন মন্দির

পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’

অনেকদিন আগে থেকেই ময়না কাঠের কাঠামোয় দেবী দুর্গার বিশেষ মূর্তিতে মাটির প্রলেপ পড়তে শুরু করে। এখন চলছে পুজোর প্রতিমা তৈরির কাজ সে মন্দির দালানে। এই প্রতিমাকে বড়দেবী বা ভবানী বলা হয়। মহারাজা নরনারায়ণকে হত্যা করার জন্য তাঁর ভাই শুক্লধ্বজ রওনা হলে দেবী ভবানী দশভূজা রূপ ধারণ করে মহারাজকে রক্ষা করেন। আবির্ভূতা দেবীর সেই স্বর্গীয় রূপকে অনুকরণ করে এই ভবানী মূর্তির প্রচলন করা হয়। এ মূর্তি মহারাজের বুকে গভীরে প্রোথিত হয়ে যাওয়া ছবি। যিনি স্বপ্নে এসেছেন, প্রাণ রক্ষাও করেছেন।

দুই বাংলার দুর্গার সঙ্গে দেবী ভবানীর বহু সাদৃশ্য থাকলেও মৌলিক অনেক পার্থক্যও লক্ষণীয়। দশভূজা দেবী ভবানী একাকিনী। একই সঙ্গে সিংহ ও বাঘের উপর অধিষ্ঠিতা। প্রতি বছর শারদীয়া পুজোর সময় মাটির মূর্তি গড়ে এক পশ্চিমুখী স্থায়ী মন্ডপে স্থাপন করা হয়। মন্ডপের বাইরে আটটি ‘করিন্থিয়াম’ থাম থাকায় উনবিংশ শতকের ইউরোপীয় প্রভাব আছে বলে অনুমান করা হয়। ছাদের কার্নিশের নীচে পেডিমেন্ট জাতীয় তিন কোণ অলঙ্কার লক্ষ্য করা যায়। বড় দেবীর বৈশিষ্ট শুধু মূর্তির গঠন স্বাতন্ত্রে নয়, পুজোর প্রকরণেও বটে। মহাষ্টমীর দু’মাস আগে শ্রাবণের শুক্লা অষ্টমীতে সর্ব সুলক্ষণ যুক্ত সাত হাত লম্বা ময়না গাছ কেটে আনা হয়, পূজার্চনা করে। তাকে ছেঁটে নির্দিষ্ট মাপ করার পর গুঞ্জ বাড়িতে মহাস্নান করিয়ে নতুন কাপড় জড়িয়ে মাথা তৈরি করে পুজো করা হয় মহাশক্তির। সন্ধ্যায় তাঁকে বিছানায় সাজানো পালকিতে শুইয়ে বাদ্য বাজিয়ে মদনমোহন বাড়িতে এনে রোজ পুজো করা হয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩০: আ দেখে জারা কিসমে কিতনা হ্যায় দম… এই গানে পঞ্চমের বাজি ছিলেন কিশোর ও আশা

এই যূপ পুজো চলে শুক্লা সপ্তমী পর্যন্ত। রামা অষ্টমীর ভোরে পালকি করে যূপ আনা হয় দেবী বাড়িতে। শুরু হয় ‘ধর্মপাঠ পুজো’। আবার মহা স্নানের পর যূপ কে খাড়া ভাবে শিমুল কাঠের তৈরি পাটার উপর স্থাপন করে শুরু হয় নিত্যপুজো। তিনদিন পর শুরু হয় মূর্তি তৈরির কাজ। ডোডেয়ার হাটের শিসিম চিত্রকররা বংশ পরম্পরায় এই মূর্তি তৈরির কাজ করে আসছেন। শোনা যায়, একসময় নরবলি হত এই দেবী পুজোয়। ষষ্ঠ দিন পুজো পাঠান হয় বানেশ্বর মন্দিরে। মহাষ্টমীতে রাতে হয় গুপ্ত পুজো। নবমীতে বোয়াল মাছের ঝোল দিয়ে অন্নভোগ হয়। দশমীর দিন বেলা এগারোটায় পূজা শেষে মূর্তিকে টুকরো টুকরো করে বিসর্জন দেওয়া হয় তোর্সা নদীর জলে।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৭: আমি শুধুই উদাস, জলজ্যান্ত লাশ

এই দেবী পুজোয় কোচবিহারের বিভিন্ন প্রান্তের লোক, দূর দরান্ত থেকে অনেকেই আসেন। এই পুজো ঘিরে দেবীবাড়ি পাড়া এলাকা জুড়ে পুজোর চার পাঁচদিন বড় মেলা হয়। প্রায় সকলের শৈশবে এই দেবী বাড়ির মেলা স্মৃতি হয়ে জড়িয়ে আছে। বিভিন্ন জিনিস, টুকিটাকি চুড়ি মালা পুতুল থেকে বেলুন আর সবচেয়ে বড় কথা নানা ধরণের খাবারের দোকান রমরম করে চলে। কেনাবেচায় আধো আলো অন্ধকারেও উজ্জ্বল হয়ে থাকে। এখন তো সেখানে বৈদ্যুতিক আলোর ছটা। ভবানী দেবীর মন্দির চত্বর ও আশপাশ এলাকা ব্যতিব্যস্ত তখন। ভিড় উপচে পড়ে।

কোচবিহারের রাজবাড়ি। ছবি: সংগৃহীত।

এই মদনমোহন মন্দির আর দেবী বাড়ির মেলা জুড়ে মানুষের আবেগ একইরকম ভাবে বিস্তৃত এখনও। এই দেবী দুর্গা ভবানীর মূর্তির বিশালতা, মুখ চোখের বৃহত্ত্বের সঙ্গে অন্যান্য দুর্গা মূর্তির মিল নেই।

মনে আছে, আমাদের ছোটবেলায় রীতিমত ভয়ে সম্ভ্রমে বাবা কাকার কাঁধে চেপে ভিড়ের ফাঁক ফোকর দিয়ে রক্তবর্ণা দেবীকে লক্ষ্য করতাম। তীব্র ভয় হত। তবু যেতেই হবে এমন টান। আর এক বৈশিষ্ট্য, এই ভবানী মূর্তির দু’পাশে তাঁর দুই সহচরী জয়া বিজয়ার অস্তিত্ব। কোনও লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ নেই। জয়া বিজয়াকেও প্রতিবছর নতুন করে গড়ে নেওয়া হয়। আগে দেখেছি এদের লাল পাড় কোরা শাড়ি পরানো হত। বর্তমানে কয়েকবছর ঝলমলে অন্যান্য রঙের শাড়িও দেখেছি জয়া বিজয়ার পরণে।

এই বিরাট ভবানী মূর্তিরই ছোট সংস্করণ মদনমোহন মন্দিরের পাশে একই চত্বরে পূর্বদিকে অবস্থিত। বিরাজ করছেন রক্তবর্ণা মা ভবানীর ছোট মূর্তি রূপোর সিংহাসনে। —চলবে।

ঋণ স্বীকার:
কোচবিহার পরিক্রমা
* মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস। সাহিত্যিক ও কবি। কোচবিহার সুনীতি অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষিকা। www.samayupdates.in -এ লিখছেন ‘কোচবিহারের রাজকাহিনি’। একাধিক উপন্যাস, ছোটগল্প সংকলন, প্রবন্ধ সংগ্রহ ও কাব্যগ্রন্থ রয়েছে লেখিকার।

Skip to content