সাবিত্রী লজ।
গজেন্দ্র নারায়ণের নিষ্ঠা ও কর্ম কুশলতায় একসময় মহারাজা তাঁকে সিভিল জাজ-এর দায়িত্ব ন্যস্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রজাদের নানা জনের নানা বিরোধিতায় ওই পদে না বসিয়ে ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে দেবীগঞ্জে চাকলাজোত এস্টেটের সুপারিনটেনডেন্ট অব এস্টেট-এর দায়িত্ব দিয়ে সেখানে পাঠানো হয়। অবশ্য রাজ্যের সাধারণ মানুষ “তাঁর সত্য নিষ্ঠা, সাধু ভাব দেখিয়া দেশের অধিকাংশ লোকেরাই তাঁকে শ্রদ্ধা ও মান্য করিত।”
দেবী গঞ্জে রাজ কর্মচারী ও প্রজারাও তাঁকে ভালো বাসত। সেখানে পুণ্যাহে তাদের রচিত সঙ্গীতের প্রথম চরণে সেই ভালোবাসার পরিচয় ফুটে উঠেছে।
“দেবীগঞ্জ বাসী আনন্দে তে ভাসি, দাও ফুল রাশি কুমার গলায়”। সাবিত্রী দেবী সম্বন্ধেও প্রজারা উচ্ছ্বসিত। ওই গানেই আছে, “সাবিত্রী সমান, সাবিত্রী রমণী/পবিত্র করিতে এসেছে ধরনী/তোমার তুলনা কি দেব মা আমি/ তোমারই উপমা তোমাতে রয়/”
দেবী গঞ্জে রাজ কর্মচারী ও প্রজারাও তাঁকে ভালো বাসত। সেখানে পুণ্যাহে তাদের রচিত সঙ্গীতের প্রথম চরণে সেই ভালোবাসার পরিচয় ফুটে উঠেছে।
“দেবীগঞ্জ বাসী আনন্দে তে ভাসি, দাও ফুল রাশি কুমার গলায়”। সাবিত্রী দেবী সম্বন্ধেও প্রজারা উচ্ছ্বসিত। ওই গানেই আছে, “সাবিত্রী সমান, সাবিত্রী রমণী/পবিত্র করিতে এসেছে ধরনী/তোমার তুলনা কি দেব মা আমি/ তোমারই উপমা তোমাতে রয়/”
কিন্তু এঁদের বিরোধীরা অনেকেই কোচবিহারে সক্রিয় ছিল। তাই মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাঁকে কোচবিহার থেকে দূরে সরানোর ব্যবস্থাও হয়। শেষপর্যন্ত তিনি কলকাতায় চলে আসেন। প্রসঙ্গত একটি বিষয় উল্লেখ্য, মামলা লড়ার জন্য বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী চিত্তরঞ্জন দাশ কোচবিহারে এসেছিলেন। সাক্ষীরা অনেকেই মিথ্যা বলেছিল। ব্যাপার দেখে চিত্তরঞ্জন অবাক হয়ে বলেছিলেন, “আমি জীবনে অনেক মোকদ্দমা করিয়েছি। কিন্তু এরূপ আগাগোড়া মিথ্যা মোকদ্দমা কখন ও জীবনে দেখি নাই।” কোচবিহারের ইতিহাসে এ মোকদ্দমার গুরুত্ব আছে।
আরও পড়ুন:
কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৯: রাজবাড়ির সান্নিধ্যে নারীর উড়ান
যে উপদেশ গিয়েছি ভুলে…
১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সাবিত্রী দেবী প্রথম কোচবিহারে আসেন। সে সময়ে রাজধানী শহরে ইটের বাড়ি অত্যন্ত অল্পই ছিল। ইটও তৈরি হতো না তেমন। আর ভূমিকম্পেরও ভয় ছিল। বেশিরভাগ ছিল ‘খড়ের বাঙলা’ এমন কি, রাজ বাড়িতেও খড়ের ঘর ছিল। কারণ, বর্তমান রাজপ্রাসাদ ১৮৭৯-৮০ থেকে নির্মাণ শুরু হয়ে প্রায় ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলেছে। খড়ের ঘর অনেকসময় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেত, এরকম অগ্নিকাণ্ডের কথা সাবিত্রীদেবী উল্লেখ করেছেন। আগুন নেভানোর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাও তেমন ছিল না। পাতকুয়া বা পুকুর থেকে জল তুলে আগুন নেভানোর চেষ্টা হতো। কিন্তু খড়ের আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে তা নেভানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতো।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৪: মুহূর্ত মিলায়ে যায় তবু ইচ্ছা করে, আপন স্বাক্ষর রবে যুগে যুগান্তরে
এছাড়া কোচবিহারে বন্যাও হতো খুব। চারদিকে নদী ঘেরা রাজ্য পরে শহর। বিশেষত, তোর্সা জলোচ্ছ্বাসে শহর ভেসে যেত। একসময় কোচবিহারে ভীষণ বন্যায় বহু মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে গেলে গজেন্দ্র নারায়ণ নিরাশ্রয় মানুষদের নিজের প্রকাণ্ড আটচালা বা চৌয়াড়ি ঘরে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সাবিত্রীদেবী কোচবিহারে এসে সেখানকার রাতের ঝিল্লি রব, বর্ষার জলে শহরের ভর ভর অবস্থা বর্ণনা দিয়েছেন।
সাবিত্রী দেবীর বাড়ির অনতিদূরে ঘর্ঘরা নদী থেকে গোরুর গাড়ি করে খাবার জল নিয়ে আসা হতো। রাজবাড়িতেও সেই জলই সরবরাহ হতো। পরে সাগর দিঘির জল তাঁদের বাসস্থান বা রাজবাড়ির অতি কাছে হওয়ায় সেখানকার জলই সরবরাহ হতো। এত স্বচ্ছ ছিল সাগর দিঘির জল যে সকলেই সে জল পান করতেন।
সাবিত্রী দেবীর বাড়ির অনতিদূরে ঘর্ঘরা নদী থেকে গোরুর গাড়ি করে খাবার জল নিয়ে আসা হতো। রাজবাড়িতেও সেই জলই সরবরাহ হতো। পরে সাগর দিঘির জল তাঁদের বাসস্থান বা রাজবাড়ির অতি কাছে হওয়ায় সেখানকার জলই সরবরাহ হতো। এত স্বচ্ছ ছিল সাগর দিঘির জল যে সকলেই সে জল পান করতেন।
রাজবাড়িতে লেখিকা।
বহু পূর্বে কোচবিহারে দেবীপূজায় নরবলি হতো। সাবিত্রী দেবীর সময়ে ওই নিয়ম অনুযায়ী ময়দার পুতুল বানিয়ে বলি প্রদত্ত হতো। সুনীতি দেবীর শিক্ষানুরাগের কথা বলতে গিয়ে সাবিত্রী দেবী উল্লেখ করেছেন, তাঁর ছেলেরাও রাজবাড়িতে মহারাজার ছেলেদের সঙ্গে খেলতে যেতেন, আবার সন্ধের মধ্যে ফিরে আসার নির্দেশ ছিল। শিক্ষা চর্চার জন্য। ছেলেদের সুশিক্ষায় বিদ্বান ও সব ব্যাপারে উন্নতির দিকে বড় ই যত্নবান ছিলেন রাজ পরিবার।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩২: কি ‘উপহার’ সাজিয়ে দেব
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে নারীদের জন্য একটি ‘টেকনিক্যাল বিদ্যালয়’ স্থাপিত হয়। সেখানে জামা, কামিজ, খাবার, জেলি ইত্যাদি তৈরির শিক্ষা দেওয়া হতো। সাবিত্রী দেবী বলেছেন, এখানে ক্রমশ নারীরা আসতে শুরু করে, রাত প্রায় সাত, আটটা পর্যন্ত ঘরের কাজ সেরে মেয়েদের নিয়ে তিনি সমস্ত কাজ করতেন। যে সব মহিলারা বাড়ির বাইরে আসতেন না, তাঁরাও উৎসাহ নিয়ে আসতে লাগলেন। সাবিত্রী লজে একটি নীতি বিদ্যালয় ছিল। ছেলে মেয়েরা এখানে নীতি শিক্ষা করত।
তোর্সার পাড়
শ্রদ্ধেয় গজেন্দ্র নারায়ণ জেলখানার কয়েদিদের কাছে বক্তৃতা করতেন। মন বদলানোর চেষ্টায় তাদের সদুপদেশ দিতেন। আধুনিক ভাবনার সংশোধনাগারে র আভাস তখনই আমরা কোচবিহারের আধুনিক তায় পেয়ে যাই। রাজ পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও কোচবিহারের সাহিত্যচর্চা এক বিরাট জায়গা নিয়েছিল। রাজসভা বা রাজসভার বাইরে সাহিত্যচর্চা চলত। বিশিষ্ট বাগ্মী, বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরুষ কেশবচন্দ্র ন’টি পত্র পত্রিকা বাংলা ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন। এগুলি হল, বামাবোধিনী পত্রিকা, ধর্মতত্ত্ব পত্রিকা, সুলভ সমাচার, মদ না গরল, ধর্ম সাধন, বালক বন্ধু, পরিচারিকা, বিষ বৈরী ও নববিধান। তিনি আবার ইংরেজিতে ছ’টি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ইন্ডিয়ান মিরর, লিবারেল, দি থিইস্টিক রিভিউ, দি সানডে মিরর এবং দি নিউডিসপেনশন।
পত্রিকা ছাড়াও তাঁর গ্রন্থ সংখ্যাও প্রচুর। সাবিত্রী সুনীতির মাও কবিতা লিখতেন। তাঁকে নিয়েও সাবিত্রী দেবীর আলোচনা তাঁর গ্রন্থে আছে। আর সুনীতিদেবী তো প্রথম যুগের অন্যতম আত্মজীবনীকার।
এবার আসব রাজা মহারাজা, তাঁদের ধর্মবিশ্বাস ও দেব দেউলের কথায়। পরের অধ্যায়ে চোখ রাখুন।
ঋণ স্বীকার:
● কোচবিহার জেলা বইমেলা ২০১৯-২০
● কোচবিহার পরিক্রমা
পত্রিকা ছাড়াও তাঁর গ্রন্থ সংখ্যাও প্রচুর। সাবিত্রী সুনীতির মাও কবিতা লিখতেন। তাঁকে নিয়েও সাবিত্রী দেবীর আলোচনা তাঁর গ্রন্থে আছে। আর সুনীতিদেবী তো প্রথম যুগের অন্যতম আত্মজীবনীকার।
এবার আসব রাজা মহারাজা, তাঁদের ধর্মবিশ্বাস ও দেব দেউলের কথায়। পরের অধ্যায়ে চোখ রাখুন।
ঋণ স্বীকার:
* মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস। সাহিত্যিক ও কবি। কোচবিহার সুনীতি অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষিকা। www.samayupdates.in -এ লিখছেন ‘কোচবিহারের রাজকাহিনি’। একাধিক উপন্যাস, ছোটগল্প সংকলন, প্রবন্ধ সংগ্রহ ও কাব্যগ্রন্থ রয়েছে লেখিকার।