অলঙ্করণ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।
ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, স্নানের আগে সারা গায়ে-মাথায় সর্ষের তেল ভালো করে লাগাতে হয়। অনেকে আবার আঙুলের ডগায় তেল নিয়ে নাকের ফুটো, কানের ফুটো এবং নাভি দেশে একটু ছুঁয়িয়ে নেন। বাড়ির শিশুদের স্নানের আগে দলাই-মলাই করে সারা দেহে সর্ষের তেল লাগিয়ে ঘণ্টাখানেক রোদে ফেলে রাখেন অনেকেই। ইদানিংকালে এই প্রবণতা কম হলেও সরষের তেল প্রীতি বাঙালির একেবারে যে কমে গিয়েছে, তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে এই শীতকালে। স্নানের আগে ভালো করে সারা গায়ে তেল মাখলে ঠান্ডা লাগবে না, এমন ধারণা আমাদের সবারই। ধারণাটা একেবারেই ভুল নয়। তবে তেলটা সর্ষের তেল হলে চলবে না। কেন চলবে না বলার আগে, তেল কী এবং কেন, সে ব্যাপারে একটু দু-চার কথা বলি।
আমাদের দেহ গঠনের জন্য এবং তাকে সুস্থভাবে চালিত করার জন্য কয়েকটি খাদ্য উপাদান অবশ্যই প্রয়োজন। যেমন কার্বহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ এবং জল। তেল এই ফ্যাটের দলেই পড়ে। ফ্যাট বা চর্বি আবার দু-রকম। প্রাণীজ ফ্যাট, যেমন— ঘি, মাখন, মাছের তেল ইত্যাদি। উদ্ভিজ ফ্যাট, যেমন— সর্ষের তেল, বাদাম তেল, জলপাই তেল, তিল তেল, নারকেল তেল। এক কথায় প্রায় সব ভোজ্য তেলই উদ্ভিজ। নানা প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে বলে গুণগত মানের দিক থেকে এরা প্রাণীজ ফ্যাটের থেকে অনেক উন্নতমানের।
আরও পড়ুন:
ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-২৯: সাফল্যে মাথা ঘোরেনি পরান বাড়ুজ্যের
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১: চায়ের দোকান থেকে বিশ্বজয়
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১: অমৃতের সন্ধানে…
শরীরের পুষ্টির জন্য ফ্যাট বা চর্বি অর্থাৎ তেল জাতীয় পদার্থ আমাদের অবশ্যই খাওয়া উচিত। এক গ্রাম ফ্যাট পুড়িয়ে শক্তি মেলে নয় ক্যালোরি। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের গড়ে যদি রোজ ২৪০০ ক্যালোরি শক্তি লাগে, তবে তার ২৫ শতাংশ, মানে ৬০০ ক্যালোরি সংগ্রহ করতে হবে তেল-চর্বি থেকে। এর জন্য তাকে দৈনিক খেতে হবে প্রায় ৬৭ গ্রাম ফ্যাট অর্থাৎ তেল-চর্বি। এর মধ্যে আমরা প্রায় ৪০ গ্রাম ফ্যাট বিভিন্ন খাদ্য শস্য থেকে পেয়ে থাকি। বাকি ২৫-২৭ গ্রাম সংগ্রহ করতে হয় তেল-মাখন থেকে। এ জন্য প্রতিদিনই আমাদের কিছুটা করে ফ্যাট জাতীয় খাবার খেতেই হবে। দেহে পুষ্টি ও শক্তির যোগান দেওয়া ছাড়াও নানা উপকারে লাগে ফ্যাট জাতীয় খাদ্য। ফ্যাটে দ্রবীভূত ভিটামিন এ, ডি, ই, কে দেহের নানা প্রয়োজনে লাগে। দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে, বিপদে-আপদে শক্তির যোগান দিতে, খাবারকে স্বাদযুক্ত করতে, শরীরের ভেতরে নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে স্বস্থানে ধরে রাখতে এবং দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ফ্যাট জাতীয় খাদ্য আমাদের অবশ্যই দরকার।
আরও পড়ুন:
স্বাদে-গন্ধে: একঘেয়ে চিকেন কারি আর ভালো লাগছে না? বাড়িতেই রেস্তোরাঁর মতো বানিয়ে ফেলুন মুর্গ মালাই হান্ডি
চলো যাই ঘুরে আসি: মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তিশগড় নয়, আমাদের এই বাংলাতেই রয়েছেন ডোকরা শিল্পীরা
আবার তেলের প্রসঙ্গে ফিরি। বাজারে অনেক দামের হরেক রকম তেল পাওয়া যায়। বিজ্ঞাপনী প্রচারে বিশেষ বিশেষ ব্রান্ডের তেলের প্রতি আমরা আকর্ষিত হই। কিন্তু পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভোজ্য তেলের মধ্যে সরষের তেলের স্থান এখনও এক নম্বরে। কারণ, এতে প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। যার আবার ১৪.৫ শতাংশ হল লিনোলেনিক অ্যাসিড, যেটি হৃদরোগ প্রতিরোধ করে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। আবার লিনোলিক এবং আলফা লিনোনিক অ্যাসিড খুব ব্যালেন্সড মাত্রায় সর্ষের তেলে আছে। তাছাড়া ইউরিসিক অ্যাসিড নামে যে ফ্যাটি অ্যাসিডের উপস্থিতির জন্য সর্ষে এবং রেপসিড তেলে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়ে বলে মনে করা হতো, গবেষণায় সেটিও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই রান্নায় এবং খাবারের পাত মিলিয়ে দিনে পাঁচ থেকে দশ চামচ সরষের তেল যে কোনও পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষ প্রতিদিন খেতেই পারে। হার্টের অসুখ বা রক্তে কোলেস্টেরল বেশি থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ মতো তেল খাবেন।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৮: দেখা-অদেখা চেনা-অচেনায় ‘মরণের পরে’
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৬: ছোটদের, একান্তই ছোটদের ‘ভাই-বোন সমিতি’
এত গেল সর্ষের তেল খাওয়ার কথা। এবার বলি দেহে এবং মাথায় সরষের তেল লাগাবেন কিনা! না, লাগাবেন না। একটা জিনিস পরিষ্কার জেনে রাখুন, ত্বকের পুষ্টির জন্য তেল অপরিহার্য নয়। ত্বকের পুষ্টি আসে দেহের পুষ্টি থেকে অর্থাৎ আপনি বিভিন্ন খাদ্যের মাধ্যমে যে তেল-চর্বি গ্রহণ করেন, তার মাধ্যমে। গত প্রায় ৪৫ বছর আমি দেহে-মাথায় তেল না লাগিয়েও বেশ তেল চুকচুকে আছি এখনও। তবে শীতকালে গায়ে তেল মাখার কিছু উপকারিতা তো অবশ্যই আছে, তবে সেটা সর্ষের তেল নয়। সরষের তেল ত্বকের ক্ষতি করে। এই তেলের এন আইসো থাইয়োসায়ানেট যৌগটি ত্বকে অ্যালার্জি তৈরি করে, ইরিটেশন হয়। সরষের তেল মেখে বাচ্চাদের দীর্ঘক্ষণ রোদে রাখলে ত্বক পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, ত্বকের রং কালো হয়ে যায়। নাকে বা কানের ফুটোতে সর্ষের তেল দেওয়ারও কোনও যুক্তি নেই। যদি মাখাতেই হয় সব থেকে ভালো হল, নারকেল তেল মাখানো। অলিভ তেলও চলতে পারে। বডি ম্যাসাজ করতে আজকাল নারকেল তেলই ব্যবহার করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৯: নদীর তীর, বনের পথ, শোক সামলে ছুটল রথ…
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৬: পাতে নিয়মিত মাছ থাকলে রোগ থাকবে দূরে, শরীর হবে তরতাজা, কীভাবে খেলে পুষ্টিগুণ বজায় থাকবে?
তেল মেখে সঙ্গে সঙ্গে স্নান করলে সেই তেল ধুয়ে যায়। সব থেকে ভালো হয়, তেল আগে না মেখে, স্নান করে, স্নানের পর সারা শরীরে নারকেল তেল বা কোনও ময়েশ্চারাইজার ভালো করে মেখে নেওয়া। নারকেল তেল গায়ে লাগালে ঠান্ডা বসে যায়, এই ধারনাটা কিন্তু পুরোপুরি মিথ্যা। সুগন্ধি যুক্ত কোনও ক্রিম বা তেল কক্ষণও শিশুকে মাখাবেন না। যাই মাখান না কেন, শিশুকে বেশি দলাই-মলাই করবেন না। ওদের নরম মাংসপেশি এবং তন্তু এর ফলে ছিঁড়ে যেতে পারে।
পরিশেষে বলি, সরষের তেল নিশ্চিন্তে খেতে পারেন, কিন্তু দেহের চামড়ায় বা মাথায় লাগাবেন না। শরীরের পক্ষে এই তেল অবশ্যই ভালো, ত্বকের পক্ষে নয়।
পরিশেষে বলি, সরষের তেল নিশ্চিন্তে খেতে পারেন, কিন্তু দেহের চামড়ায় বা মাথায় লাগাবেন না। শরীরের পক্ষে এই তেল অবশ্যই ভালো, ত্বকের পক্ষে নয়।
এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক।