শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


স্কেচ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

এমনটা ভাবেন অনেকেই। মাছ, মাংস সোয়াবিনের মতো প্রোটিন প্রধান খাদ্যের উচ্চ মূল্যের কথা মাথায় রেখে অনেকেই বিকল্প হিসেবে প্রোটিন প্রধান নানা ধরনের ডালের কথাই ভাবেন। এই ভাবনায় দোষের কিছু নেই। যদিও ডালকে আজকাল আর কম মূল্যের খাদ্যশস্য হিসেবে ভাবা যায় না। তবু মাছে-ভাতে বাঙালির পাশাপাশি ডালে-ভাতে বা ডালে-রুটিতে বাঙালি ও অবাঙালির সংখ্যাও কিন্তু কম নয়।

ডালকে বলা হয় ‘পুয়োর ম্যানস মিট’ অর্থাৎ গরিব মানুষের মাংসের বিকল্প খাদ্য। কারণ মাংসে যে পরিমাণ প্রোটিন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থাকে, ডালে তার কোনও অংশে কম তো থাকেই না বরং বেশি থাকে এবং গুণগত মানে সেগুলো অনেক উন্নতমানেরও বটে। আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় মোট ক্যালোরি শক্তির ৩০ ভাগ আশা চাই প্রোটিন থেকে। ডালের প্রোটিনে প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিডের সবগুলোই পাওয়া যায়, শুধু দুটি বাদে, মিথিওনিন এবং সিস্টিন। অঙ্কুরিত ডালে কিন্তু এই দুটিই পাওয়া যায়, যে জন্য জলে কিছুক্ষণ ডালকে ভিজিয়ে রেখে অনেকেই খেয়ে থাকেন।
ডালে কার্বোহাইড্রেট থাকে ৫৫ থেকে ৭০ শতাংশ। থাকে নানা ধরনের খনিজ পদার্থ, ভিটামিন এবং ডায়েটারি ফাইবার, যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। ডালের মোট কার্বোহাইড্রেটের প্রায় ৩০ শতাংশই হল অতি উচ্চমানের জটিল স্টার্চ বা শ্বেতসার জাতীয় পদার্থ, যা হজম করতে সময় লাগে। সহজপাচ্য সরল স্টার্চ মাত্র পাঁচ শতাংশ। এ ছাড়া ডালের ট্রিপসিন ইনহিবিটর যৌগটি হজমকার্যে এবং দেহের নানা খনিজ পদার্থ শোষণে বাধা দেয়। গরম জলে ডালকে কয়েক ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে এরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ডালে প্রচুর আয়রন থাকার জন্য অ্যানিমিয়া রোগীদের নিয়মিত ডাল খেতে বলা হয়। তবে যে কোনও ডালই বায়ুবর্ধক, হজম হতে সময় নেয়। তাই সব সময় পরিমিত পরিমাণেই ডাল খাওয়া উচিত।

নানা ধরনের ডালের মধ্যে মুগ ডাল আমাদের খুব প্রিয়। ভীষণ পুষ্টিকর এই ডাল। উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদযন্ত্রের নানা সমস্যায় ফাইবার এবং পটাশিয়াম সমৃদ্ধ এই ডাল ভীষণ উপকারি। হজমের গন্ডগোলে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে, মুখে রুচি আনতে এবং ডায়াবেটিসে মুগের ডালের স্যুপ নিয়মিত খেতে পারেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৯: ডায়াবেটিসে কি আলু একদম বন্ধ?

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৮: ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম এবং ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস

মটর ডালও আমাদের খুব প্রিয়। কাঁচা অবস্থায় যাকে আমরা মটরশুঁটি বলি, সেটাই পাকলে হয় মটর, আর ভাঙলে মটর ডাল। পুষ্টিমূল্যও অনেকটা বেড়ে যায়। অন্যান্য খাদ্য উপাদান ছাড়াও মটরশুঁটিতে ক্যাটেচিনস, এপিক্যাটেচিনস, আলফা এবং বিটা ক্যারোটিনয়েডস, ফেনোলিক অ্যাসিড, ফ্ল্যাবোনয়েড এবং নানা ধরনের পলিফেনিক যৌগ থাকায় দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, অকাল বার্ধক্য আটকানো যায়, শরীর এবং মনে বাড়তি শক্তির সঞ্চার হয়।

ছোলার ডালও বাঙালির খুব প্রিয়। রুটি বা লুচির সঙ্গে বাঙালির পাতে ছোলার ডাল অলটাইম ফেভারিট। দেশি, মুম্বাই এবং কাবলি—তিন ধরনের ছোলা মেলে বাজারে। প্রোটিন ছাড়াও থাকে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেলস, ফাইবার ইত্যাদি। অ্যানিমিয়া, ডায়াবেটিস, ওবেসিটি এবং হজমের সমস্যা ছোলার ডাল উপকারি। তবে খেতে হবে অল্প পরিমাণে, তা না হলে রক্তে অক্সালিক অ্যাসিড বেড়ে গিয়ে স্টোন হতে পারে কিডনিতে এবং মূত্রনালীতে। ছোলার ডালের বেসন এবং ছাতুও উপকারি। তবে সারারাত জলে ভিজিয়ে রেখে কল বার করা গোটা ছোলা খেতে পারলে পুষ্টি বেশি মেলে। কারণ এতে ভিটামিন সি তিন গুণ এবং ভিটামিন এ-র মাত্রা আট গুণ বেড়ে যায়। খোলায় ভাজা ছোলাও খুব পুষ্টিকর এবং মুখরোচকও বটে।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৭: বিপৎকালে দেখতে পাই, রাখাল ছাড়া বন্ধু নাই…

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ

এছাড়া মসুর ডাল, অড়হর ডাল, বিউলির ডাল এবং খেসারি ডাল আমরা খেয়ে থাকি। এদের প্রত্যেকটিই যথেষ্ট পুষ্টিকর। তবে খেসারি ডালে বিটা অক্সালিন অ্যামাইনো অ্যালানিন বা বোয়া (BOAA) নামে একটি রাসায়নিক পদার্থ থাকাতে দীর্ঘদিন খেলে স্নায়ু ঘটিত রোগ হতে পারে। খোসা ছাড়িয়ে ভালো করে গরম জলে ধুয়ে নিয়ে বেশিক্ষণ ধরে জলে সেদ্ধ করলে এই বিষাক্ত রাসায়নিকটি নষ্ট হয়ে যায়, তখন নিশ্চিন্তে এই ডাল খাওয়া যায়।

নিরামিষাসীদের কাছে উচ্চমানের প্রোটিন সমৃদ্ধ ডাল যে মাছ-মাংসের বিকল্প খাদ্য, তা আজ বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত। তবে বেশি নয়, প্রতিদিন খাবার পাতে এক কাপ (২০০ মিলি) ডাল অবশ্যই রাখবেন, সে আপনি ভেজ বা নন-ভেজ যাই হোন না কেন।
আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র: তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা

 

ডাল খাওয়ার আগে কয়েকটা কথা জেনে রাখা ভালো

রক্তে যদি ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকে তবে মসুর ডাল, মটর ডাল, মটরশুঁটি, রাজমা খাবেন না। এগুলো পিউরিন যুক্ত খাদ্য। ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

সব ডালে সব ধরনের প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে না, তাই ডাল খাবেন মিলিয়ে মিশিয়ে। সপ্তাহে দুদিন ধরুন মসুর খেলেন, দুদিন মুগ, একদিন ছোলা, একদিন বিউলি, একদিন অড়হর ডাল। আবার প্রতিদিন পাঁচমিশালি করেও ডাল খেতে পারেন।

ডাল ভালো করে ধুয়ে নিয়ে সারারাত জলে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকালে রান্না করবেন। প্রচুর ক্ষতিকর রং এবং কীটনাশক মেশানো হচ্ছে আজকাল ডালে।

প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় রোগ প্রতিরোধে, অকাল বার্ধক্য রুখতে এবং ক্যানসার প্রতিরোধে ডাল দারুণ কার্যকরী। ভাত বা রুটির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে ডালের পুষ্টি মূল্য বেড়ে যায়।

যাঁদের খুব হজমের গন্ডগোল, গ্যাস এবং অম্বলের সমস্যা আছে— ডাল খুবই কম খাবেন তারা।

পরিমাণ মতো জলে ডাল রান্না করবেন প্রেসার কুকারে। এতে পুষ্টিমূল্য ঠিকঠাক থাকবে।

যাঁরা প্রেসার, হাটের অসুখ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, দুর্বলতা, অস্থিক্ষয়, হাইকলেস্টেরল ও অকাল বার্ধক্যে ভুগছেন, তাঁরা প্রতিদিন এক কাপ (২০০ মিলি) করে ডাল অবশ্যই খাবেন। মনে রাখবেন, ১০০ গ্রাম ডাল থেকে উন্নতমানের প্রোটিন পাওয়া যায় শতকরা ২০ থেকে ২৫ গ্রাম এবং পুষ্টি মূল্য ৩০০ থেকে ৩৫০ কিলো ক্যালরি। তবে আবার বলছি, ডাল খেতে হবে পরিমিত পরিমাণে।

* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content