বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

জ্বরের কথা উঠলেই আমার ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ে। ছোটবেলা থেকে কৈশোরকাল পর্যন্ত আমার রোগভোগেই কেটেছে বছরের বেশিটা সময়। তার মধ্যে জ্বরের স্থান ছিল এক নম্বরে। জ্বর হলেই ঠাকুমা আমাকে ট্যাকে গুঁজে ছুটতেন পাড়ার ডাক্তার ডি এল কুণ্ডুর কাছে। একটু বড় হওয়ার পর অবশ্য নিজে নিজেই যেতাম। ডাক্তারবাবুর নির্দেশ মতো দিলীপ কম্পাউন্ডারের হাতে তৈরি মিক্সার পেটে না পড়লে জ্বর ছাড়তো না। যতদিন জ্বর থাকতো, ভাত থাকতো নিষিদ্ধ খাদ্য তালিকায়। ফলমূল, শাক-সব্জি আর দু’বেলা বার্লি, সাগু বা চিঁড়ের মণ্ড— এই ছিল পথ্য। ভাত খাবার জন্য তখন মনটা সারাদিন আঁকুপাঁকু করত। জ্বর কমার পর ডাক্তারবাবু অনুমতি দিলেই মায়ের হাতে রান্না করা গলা ভাত, ডিম সেদ্ধ বা মাছ সেদ্ধ দিয়ে এক থালা খেয়ে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতাম।
সে সব দিন এখন অতীত। জ্বর-সহ যে কোনও রোগেই ভাত এখন আর খাদ্য তালিকায় ব্রাত্য নয়। রাতারাতি কি এমন গুণ ভাতের মধ্যে খুঁজে পেলেন ডাক্তারবাবুরা, যে অসুখ-বিসুখ হলে সহজপাচ্য খাদ্য তালিকায় ভাতকে নিয়ে এলেন এক নম্বরে!

ভাতের পুষ্টি উপাদান নিয়ে এ বার দু-চার কথা বলি। চাল থেকে ভাত হয়, জানি আমরা সবাই। চালে থাকে শতকরা ৭৮ ভাগ কার্বহাইড্রেট, প্রোটিন শতকরা ৭ ভাগ, ফ্যাট ০.৫ ভাগ। শক্তি পাওয়া যায় ১০০ গ্রাম ভাত থেকে প্রায় ৩৪৫ কিলো ক্যালরি। এছাড়া প্রচুর ভিটামিন বি কমপ্লেক্স থাকে চালে, প্রধানত ভিটামিন বি। কিন্তু ধান থেকে চাল তৈরি করতে গিয়ে এর পুষ্টি মূল্য অনেকটাই কমে যায়। বিশেষত চাল যত ফাইন হবে, ততই তা পুষ্টিহীন হয়ে উঠবে। কারণ চালকে ফাইন করতে গিয়ে এর বহিরাবরণ পেরিকার্প এবং জার্ম স্তর— দুটোই উঠে যায়। ফলে ভিটামিন বি টু এবং ভিটামিন বি-এর হার অনেক নেমে আসে। ক্যালশিয়ামের মাত্রাও অর্ধেক হয়ে যায়, প্রোটিনও কমে যায়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৭: যত কাশি, তত কাফ সিরাপ?

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-১০: ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’

এই ফাইন চালকে আবার বেশি ধোওয়াধুয়ি করার ফলে এবং জলে সেদ্ধ করার ফলে প্রায় ৬০ শতাংশ ভিটামিন ধুয়ে বার হয়ে যায়। ভাতের ফ্যান গৃহিণীরা সাধারণত ফেলে দেন। অথচ এই ফ্যানেই তো যত পুষ্টি। ফ্যান শুদ্ধ ভাত, যাকে মাড় ভাত বলা হয়, তা অবশ্যই খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত, সম্ভব হলে নিয়মিত। ফুরফুরে সুগন্ধি সুপার ফাইন চাল খেতে ভালো লাগলেও, শরীরের পক্ষে তা মোটেও উপকারি নয়।

অনেকে মনে করেন ফ্যান ভাত খেলে আমাশয় হয়, হাত পা ফোলে, বাত হয়। সবকটিই কিন্তু ভুল ধারণা। আমাশয় হয় অ্যানটামিয়োবা হিস্টোলাইটিকা নামক একটি জীবাণু পেটে ঢুকলে। জল ও খাদ্যের মাধ্যমেই এরা পেটে ঢোকে। ফ্যানভাতকে এজন্য দোষ দিয়ে লাভ নেই।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫২: বইয়ের সব কপি কবির নির্দেশে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল

মুড়ি মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া কতটা ক্ষতিকর? জানুন চিকিৎসকের মতামত

ভাত খেলে বাত হয়, এটাও বাত কে বাত, অর্থাৎ কথার কথা। দেহে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়লে গেঁটে বাত বা গাউট দেখা দিতে পারে, গাঁট বা জয়েন্ট ফুলতে পারে। ইউরিক অ্যাসিড ভাতে থাকে না। ভাত খেলে শরীরে রস জমে, হাত পা ফোলে, এ ধারণারও কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। যে কোনও খাদ্য উপাদানের সিংহভাগ জুড়েই থাকে জল। এই জল দেহের প্রয়োজনে কাজে লাগে। চাল থেকে ভাত তৈরি করতে গিয়ে ভালো করে সিদ্ধ করতে হয়। এর ফলে নানা ভিটামিন ও খনিজ লবনের সঙ্গে কিছুটা জলও ভাতে প্রবেশ করে।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৭: কুডার ছুঁয়ে শিরপুর

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৪: মন তোর শক্তিই ‘মন্ত্রশক্তি’

গৃহিণীদের কাছে অনুরোধ, সুপারফাইন চালের ভাত খেলে যে অনেক ফাইন দিতে হতে পারে, সেটা সব সময় মাথায় রাখবেন। বেশি ধোওয়াধুয়ি করে এবং সব ফ্যান গেলে ভাতটাকে ঝরঝরে করতে গিয়ে জলে দ্রবণীয় ভিটামিনগুলোকে বিসর্জন দেবেন না। কারণ এদের অভাবে স্নায়ু দুর্বলতা, স্নায়ু ঘটিত নানা রোগ, মানসিক অবসাদ ও অস্থিরতা, ডায়েরিয়া, চর্মরোগ, ঠোঁটে ও জিভে ঘা, দেহের কম বৃদ্ধি, রক্তাল্পতা-সহ নানা বিপত্তি দেখা দিতে পারে। নানা কারণে অনেকেই আতপ চাল খেয়ে থাকেন। কিন্তু সিদ্ধ চালের পুষ্টিমূল্য আতপ চাল থেকে অনেক অনেক বেশি। বি গ্রুপের ভিটামিন সিদ্ধ চালে তিনগুণ বেশি থাকে। ধোওয়াধুয়ির সময় আতপ চালের অনেক পুষ্টি উপাদান বেরিয়ে যায়, সিদ্ধ চালে কম বার হয়। কারণ ধান সিদ্ধ করার সময় এর অন্যতম উপাদান শ্বেতসার চালের মধ্যে ঢুকে গিয়ে অন্য উপাদানগুলোর সঙ্গে মিশে যায়।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের সুন্দর মাছ

ডায়েট ফটাফট: স্যালাডে স্বাস্থ্যরক্ষা, কী ভাবে তৈরি করবেন সেই সব পুষ্টিকর খাবার? দেখে নিন একঝলকে

অসুখ হলে অনেকে ভাতের থেকে রুটি বেশি পছন্দ করেন। আটার রুটি যা গম থেকে প্রস্তুত হয়, অবশ্যই পুষ্টিকর এবং পুষ্টিমূল্য ভাতের কাছাকাছিই। তবে প্রচুর রাফেজ বা ফাইবার জাতীয় খাদ্য উপাদান থাকার ফলে হজম করতে অসুবিধা হয়। যে কোনও সময় পেট খারাপ হতে পারে। জ্বরজারি হলে এমনিতেই আমাদের হজম করার জন্য যে সমস্ত উৎসেচকের প্রয়োজন হয়, সেগুলোর ক্ষরণ কমে যায়। যে জন্য রুটি হজম করাটা খুব মুশকিল হয়ে পড়ে। ডাক্তারবাবুরা তাই আজকাল জ্বরজারি হলে কিংবা পেটের অসুখ হলে গলা গলা ভাত খেতে নিদান দেন। সঙ্গে আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ, মাছ সেদ্ধ ইত্যাদি।

এই হল ভাতের সাতকাহন। ভাত অবশ্যই পুষ্টিকর খাদ্য এবং সহজপাচ্য। ডাক্তারের বারণ না থাকলে জ্বরজারি হলে খাদ্য তালিকায় সু সিদ্ধ গলা ভাতকেই রাখবেন।
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content