স্কেচ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।
প্রদীপের পিতামহ প্রায় ৯০ বছর বেঁচে ছিলেন। এই দীর্ঘ জীবনে তার নাকি কোনও চোখের সমস্যা হয়নি, চশমাও নিতে হয়নি! প্রসঙ্গ উঠলেই উনি সগর্বে উত্তর দিতেন, আমরা তো ওপার বাংলার মানুষ। সপ্তাহে অন্তত দু’দিন খাবারপাতে মাছের মুড়ো চিবিয়ে খেতাম। শুধু প্রদীপের দাদুই নন, বহু প্রাচীন-প্রাচীনারা এখনও বিশ্বাস করেন, মাছের মুড়ো চিবিয়ে খেলে চোখের জ্যোতি বাড়ে, খালি পায়ে সবুজ ঘাসে হাঁটলে চোখে নাকি ছানি পড়ে না–ইত্যাদি। এ সব কথার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। শুধু চোখ কেন, দেহের যে কোনও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের জন্য মাছ অবশ্যই একটি অতিপ্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান আমাদের কাছে, আলাদা করে শুধু চোখের জন্য নয়। এর শতকরা ১৫ থেকে ২৫ ভাগ জুড়েই থাকে প্রোটিন। ফ্যাট-কোলেস্টেরল নাম মাত্র, থাকে প্রচুর ক্যালসিয়াম-ফসফরাস সহ নানা খনিজ পদার্থ এবং অবশ্যই নানা ভিটামিন। তা ছাড়া সহজপাচ্য বলে মাছ রোগীদেরও আদর্শ খাদ্য।
ছোট মাছ কাঁটাসুদ্ধ চিবিয়ে খাওয়া যায় বলে বেশি পুষ্টিকর। কারণ এই কাঁটা থেকেই আমরা বেশি পরিমাণে ক্যালশিয়াম এবং ফসফরাস পাই। তাই বলে বড় মাছকে কম পুষ্টিকর ভাববেন না। আবার ইলিশ-পমফ্রেট-লোটে সহ নানা নোনা জলের মাছে ওমেগা-৩ জাতীয় পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (PUFA) বেশি পরিমাণে থাকার ফলে, রুই কাতলা পাবদার মত মিষ্টি জলের মাছের থেকে এরা ঢের বেশি উপকারি। মাছের তেল এবং ছালেই থাকে ফ্যাট, তাই অবশ্যই এগুলো খাবেন, খাবেন না ফুলকোটা।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪০: ব্রণ হয়েছে? তার মানেই কি লিভার খারাপ?
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫০: স্বপ্নের ‘যাত্রা হলো শুরু’
একসময় তো হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কায় আমরা ইলিশ মাছ খেতে ভয় পেতাম। এতে ফ্যাট ২০% এবং ক্যালোরি ২৭০, যা অন্য মাছের থেকে বেশি। কিন্তু গবেষণায় জানা গিয়েছে বেশি পরিমাণ ওমেগা-৩ নামক PUFA ইলিশ মাছে (২০-৩০ শতাংশ) থাকার ফলে, আমাদের রক্তে জমে থাকা ফ্যাট বা কোলেস্টেরল, লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LDL) এবং ট্রাই গ্লিসারাইডের মাত্রা অনেক কমে যায়, ফলে কমে যায় হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কাও। ওমেগা-৩ পরিবারভুক্ত PUFA-র মধ্যে রয়েছে লিনোলেনিক, ইকোসা পেন্টানোয়িক, ডেকোসা হেক্সায়নিক অ্যাসিড-সহ নানা অ্যাসিড। এছাড়া ইলিশ সহ নানা নোনা জলের মাঝে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ডি, বি কমপ্লেক্স এবং খনিজ লবণ ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, সালফার, আয়োডিন ইত্যাদি থাকে।
আরও পড়ুন:
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৯: আহা, মরি—কেটেলবেরি
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৫: সারদা মায়ের রোগ নিরাময়
চিংড়ি আমাদের খুব প্রিয় মাছ কিন্তু বেশি প্রোটিন এবং কোলেস্টেরল থাকার জন্য প্রেসার এবং হার্টের রোগীদের চিংড়ি কম খাওয়াই ভালো। কুচো চিংড়ির খোসা অনেক সময় ছাড়ানো সম্ভব হয় না। এই খোসায় কাইটিন নামক দুষ্পাচ্য প্রোটিন থাকার জন্য পেট গরম হতে পারে। অতএব সাবধান! চিংড়ির দেহের মোট কোলেস্টেরলের বেশিরভাগটাই যেহেতু মাথার ঘিলুতে থাকে, তাই ঘিলু ফেলে দিয়ে খাবেন বয়স্ক মানুষেরা। এছাড়া যাদের চিংড়িতে অ্যালার্জি আছে, তারাও খাবেন না। মাঝারি মাপের চিংড়িও বেশ পুষ্টিকর।
যে কোনও মাছ কাঁচা অবস্থায় দু-তিন দিন, রান্না করা অবস্থায় এক-দু দিনের বেশি ফ্রিজে রাখবেন না। শুঁটকি মাছের প্রোটিন ভেঙে নাইট্রোজেন যুক্ত অ্যামাইনো কম্পাউন্ড তৈরি হয়, তাই পুষ্টিমূল্য অনেক কমে যায় এবং ফ্যাটি অ্যাসিড অক্সাইডেশন (রানসিডিটি) হয়ে বোটকা গন্ধ ছাড়ে। বয়স কালে পুষ্টির জন্য নয়, মুখের স্বাদের জন্য মাঝেমধ্যে শুঁটকি চলতে পারে।
যে কোনও মাছ কাঁচা অবস্থায় দু-তিন দিন, রান্না করা অবস্থায় এক-দু দিনের বেশি ফ্রিজে রাখবেন না। শুঁটকি মাছের প্রোটিন ভেঙে নাইট্রোজেন যুক্ত অ্যামাইনো কম্পাউন্ড তৈরি হয়, তাই পুষ্টিমূল্য অনেক কমে যায় এবং ফ্যাটি অ্যাসিড অক্সাইডেশন (রানসিডিটি) হয়ে বোটকা গন্ধ ছাড়ে। বয়স কালে পুষ্টির জন্য নয়, মুখের স্বাদের জন্য মাঝেমধ্যে শুঁটকি চলতে পারে।
আরও পড়ুন:
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৪: সত্তরের হীরের টুকরো
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর
টাটকা মাগুর, শিঙ্গি, কই হল রোগীর জন্য আদর্শ মাছ। এদের জ্যান্ত অবস্থায় বাজারে মেলে। বাড়িতেও অল্প জলে রেখে দিলে দিন কয়েক জ্যান্ত থাকে। এরা যেমন খনিজ সমৃদ্ধ (১০০ গ্রামে ৬০০ মিলিগ্রাম), তেমনি সহজপাচ্যও বটে। কাজেই এবার থেকে প্রতিদিন ৫০-৬০ গ্রাম মাছ অবশ্যই খাবেন। বড় মাছ, ছোট মাছ, নোনা জলের মাছ, মিষ্টি জলের মাছ— সব মিলিয়ে মিশিয়ে। শেষ কথা হল, মাছের মুড়ো খেলে চোখের জ্যোতি বাড়ে একথা যেমন ঠিক নয়, পাশাপাশি এটাও সত্যি চোখ-সহ দেহের যে কোনও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য প্রতিদিন আমাদের পাতে মাছ থাকাটা জরুরি।
যোগাযোগ: ৯৮৩০২১৭৯২৮
যোগাযোগ: ৯৮৩০২১৭৯২৮
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।