বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


স্কেচ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

এতো উলট পুরাণ! এতদিন যা শুনে এসেছি, জেনে এসেছি, ডাক্তারিতে পড়ে এসেছি—তার অনেক কিছুই যে পাল্টে যাচ্ছে! বেশি তেল খেলে কোলেস্টেরল বাড়ে, রক্তনালীতে চর্বি জমে, বাড়ে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা। বছর দশেক আগে পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমন কথাই বলা হত। ডাক্তার বাবুরাও চল্লিশ পার হতে না হতেই সাবধান করে দিতেন, খুব সামান্য তেল খাবেন। মাছের তেল তো একেবারেই নয়! আর এখন তারাই বলছেন, বর্ষায় ইলিশ মাছ খাবেন না তা কি হয়! সপ্তাহে দুই একদিন খেতেই পারেন। কিন্তু তেলটা ফেলবেন না আধ-এক গ্রাম তেল অবশ্যই খাবেন।

বর্ষা মানেই রুপোলী শস্যর হাতছানি, মানে ইলিশের। হাজার-বারোশো টাকা কেজি! মেছো ভেতো বাঙালি আর্থিক অনটনের মধ্যেও মাছের আকর্ষণ এড়িয়ে যেতে পারেন না, বিশেষ করে তা যদি হয় ইলিশের। ১৫ দিনে একবার হলেও একটু ইলিশ পাতে পরা চাই। ইলিশের প্রতি বাঙালিদের বিশেষ করে বাঙালদের একটা জেনিটিক দুর্বলতা আছে। স্বাদ-গন্ধ এবং পুষ্টিমূল্যে ইলিশ তুলনাহীন।
 

পুষ্টি মূল্যের বিচারে

১০০ গ্রাম ইলিশে ফ্যাট বা চর্বি থাকে ১৯.৪ শতাংশ, প্রোটিন ২১.৮ শতাংশ, কার্বোহাইড্রেট ২.১ শতাংশ, লোহা ২.১ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৮০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি টুয়েলভ ২০ মিলিগ্রাম। এছাড়া অল্প পরিমাণে ভিটামিন বি থ্রি, বিটা ক্যারোটিন, নিয়াসিন, থায়ামিন ইত্যাদি। ১০০ গ্রাম ইলিশ থেকে ২৭০ ক্যালরি শক্তি মেলে।

পুষ্টি মূল্যের বিচারে ইলিশকে পুষ্টিকর মাছ বলাই যেতে পারে। তবে একটু কিন্তু আছে! কিন্তুটা হল, অন্যান্য মাছের তুলনায় ইলিশে অনেক বেশি ফ্যাট থাকে, প্রায় ২০ শতাংশ। বেশি খেলে সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু দামের গুঁতোয় ইচ্ছে থাকলেও আমরা খুব বেশি পরিমাণে ইলিশ কেউই খাই না। ইলিশ মাছের তেল নিয়েও আমরা আতঙ্কে থাকি। বিশেষ করে যারা হৃদযন্ত্রের গন্ডগোল বা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। কিন্তু পুষ্টিবিজ্ঞানীরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ইলিশ মাছের তেল হল হার্ট ফ্রেন্ডলি।

আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৫: আমাদের নাকি রোজই চুল পড়ে!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪০: সে এক স্বর্গপুরীর ‘চিরকুমার সভা’

আমাদের খাদ্য তালিকার গুডবুকে ইলিশের ঢুকে পড়ার কারণ হল, এতে ওমেগা থ্রি নামক একটি বিশেষ ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিডের উপস্থিতি। আমরা জানি তেল-চর্বি জাতীয় যে কোনও পদার্থেই থাকে স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড বা SAFA এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড বা PUFA । এই PUFA-তেই থাকে ওমেগা থ্রি এবং ওমেগা সিক্স নামক দুটো ফ্যাটি অ্যাসিড।

স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড বা SAFA কম খাওয়াই ভালো। কারণ রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়তে পারে। আবার ওমেগা সিক্স নামক PUFA-টিও শরীরে বেশি ঢুকলে বিপত্তি ঘটাতে পারে। রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যেতে পারে, রক্তনালীতে চর্বির আস্তরণ জমে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়তে পারে।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩: ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শিপ

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২০: জীবন্ত লাশ?

 

ওমেগা থ্রি-র জাদু

ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের উপস্থিতির জন্য ইলিশ মাছ এখন শুধু আর আমাদের কাছে সুস্বাদু নয়, দেহের পক্ষে প্রচণ্ড উপকারিও বটে। গুণের শেষ নেই ওমেগা থ্রি-র।
রক্তনালিতে বাড়তি কোলেস্টেরল জমতে দেয় না।
হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণ করে।
রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল কমায়।
রক্তের টাইগ্লিসারাইডকে নিয়ন্ত্রণ করে।
জয়েন্টের প্রদাহ আর্থারাইটিস কমায়।
হাড়ের ক্ষয় রোধ করে।
জরায়ু, স্তন এবং প্রস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধ করে।
মানসিক রোগ প্রতিরোধ করে।
ত্বকের অসুখ ও হাঁপানি কমাতে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে ও ওজন কমাতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২: চলমান সুন্দরবন

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৭: কোরবা হয়ে সাতরেঙ্গা

 

কী থাকে ওমেগা থ্রি ফাটি অ্যাসিডে?

এটি আসলে ১৮টি কার্বন পরমাণু বিশিষ্ট একটি আলফা লিনোলেনিক অ্যাসিড, যা লিভারে গিয়ে প্যানক্রিয়াটিক এনজাইম বা অগ্নাশয়ের উৎসেচকের সাহায্যে ইকোসাপেন্টানয়িক অ্যাসিড এবং ডেকোসাহেক্সানয়িক অ্যাসিডে ভেঙে যায়। এই দুই অ্যাসিডের ম্যাজিক এফেক্টগুলোই ওমেগা থ্রি সমৃদ্ধ ইলিশকে হার্ট ফ্রেন্ডলি আরেকটু ঠিকঠাক বললে হিউম্যান বডি ফ্রেন্ডলি করে তুলেছে। শুধু ইলিশ নয়, অন্যান্য কয়েকটি মাছ যেমন পমফ্রেট, লোটে, ভোলা, কই, ভেটকি তেলাপিয়া, রুই, কাতলাতেও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড কম বেশি থাকে।

মাছের তেলও কিন্তু ফ্যালনা নয়। এতে থাকে ফ্যাটি অ্যাসিডের ট্রাই গ্লিসারাইড এস্টার, সামান্য ফ্যাটি অ্যাসিড, ফসফোলিপিড এবং নানা ধরনের ভিটামিন। নিয়মিত আধ গ্রাম থেকে এক গ্রাম মাছের তেল খেলে হৃদরোগের সম্ভাবনা ৪০ শতাংশ কমে যায়। ফ্যাট সমৃদ্ধ যে কোনও খাদ্য উপাদানে ওমেগা সিক্স এবং ওমেগা থ্রি-র আদর্শ অনুপাত হওয়া উচিত ৪:১। সুখের কথা, মাছে থাকা এই অনুপাত আদর্শ অনুপাতের কাছাকাছি। সেজন্যই শুধু পুষ্টির জন্য নয়, রোগ প্রতিরোধ করার জন্য প্রতিদিন অন্তত ৫০ গ্রাম মাছ খাওয়া প্রয়োজন। ইলিশ মাছের বেলায়ও একই কথা। একবারে বেশি খাবেন না, হজমে অসুবিধা হবে।

যে কোনও মাছ বেশি ভেজে খেলে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড-সহ নানা খাদ্যগুণ নষ্ট হয়ে যায়। বরং ভাপে ইলিশ বা হালকা ঝোলে ইলিশ অনেক বেশি উপকারি। কাজেই এই বর্ষায় পকেটের রেস্ত বুঝে সপ্তাহে অন্তত দু-দিন জমিয়ে ইলিশ খান, সঙ্গে অবশ্যই ইলিশ মাছের তেল।

* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content