শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


স্কেচ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

বিড়াল বাড়ি। পাড়ার লোক এই নামেই খগেন বাবুর বাড়িটিকে চেনে। আসলে খগেন বাবুর যে খুব একটা পশুপ্রীতি আছে তা কিন্তু নয়, কিন্তু বউ প্রীতি ভয়ংকর। ভয়ে কিংবা ভক্তিতে বউ রমা দেবীর তালে তাল মিলিয়ে চলেন তিনি। আর তাই নিঃসন্তান খগেন বাবুর বাড়িতে ডজন খানেক মা ষষ্ঠীর বাহনের নিত্য দাপাদাপি। রমাদেবীর সপ্তাহ খানেক ধরে গলায় তীব্র ব্যথা, সঙ্গে অল্প জ্বর, ভালো করে খাবার গিলতেই পারছেন না। নিজেরা ডাক্তারি করেও যখন কমলো না, তখন বেশ ভয় পেয়েই গেলেন তিনি। সারাদিন বিড়াল নিয়ে থাকেন, সেই বিড়াল থেকেই গলায় ডিপথেরিয়া হলো না তো! ছুটলেন তিনি গলার ডাক্তারের কাছে।

সাধারণ মানুষ, যাদের মধ্যে বহু শিক্ষিতও আছেন, এখনও মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে বিড়াল থেকেই ডিপথেরিয়া ছড়ায়। অথচ এই ধারণার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে ডিপথেরিয়া না ছড়ালেও বিড়াল থেকে কিছু অসুখ ছড়াতেই পারে। সে আলোচনায় পরে আসছি।
এই রোগটির নেপথ্যে রয়েছে এক ধরনের জীবাণু, যার নাম করিনিব্যাকটেরিয়াম ডিপথেরি ব্যাসিলাই। এরা আক্রমণ করে প্রধানত নাক এবং গলাকে। কখনও চোখ, ত্বক এবং দেহের অন্যান্য স্থানেও এই রোগ দেখা দেয়। গলার টনসিল ফ্যারিংস এবং ল্যারিংস সব থেকে বেশি আক্রান্ত হয়। এই জীবাণু থেকে এক ধরনের বিষাক্ত রস বা টক্সিন বার হয়, যা রক্তে মিশে গিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটায় হার্ট এবং নার্ভের উপর। রোগীর দেহে প্রকাশ পায় নানা উপসর্গ।

ডিপথেরিয়া রোগের প্রাথমিক উপসর্গ অনেকটা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো। সর্দি, জ্বর, নাক দিয়ে জল ঝরা, চোখ ছল ছল, গলা ব্যথা, কথা বলতে ও গিলতে কষ্ট, গ্ল্যান্ড ফুলে যাওয়া ইত্যাদি। তবে গলার কষ্টের খুব বাড়াবাড়ি থাকে। রোগীর জল গিলতেও কষ্ট হয়। শিশুদের অনেক সময় মুখ দিয়ে লালা ঝরে, শ্বাসকষ্ট হয়, গলা জুড়ে ঘা দেখা দেয়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩০: প্রচুর প্রোটিন, তাই যতখুশি ডাল খান?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫: চন্দ্রমণির বধূবরণ

গলা পরীক্ষা করলে দেখা যায় টনসিল এবং ফ্যারিংসের উপরে এক ধূসর পর্দার মতো পড়ে আছে, যা টেনে তুলতে গেলে রক্তপাত ঘটে। গলার ভিতরটা ফুলে থাকে। নারীর গতি অনিয়মিত হতে পারে। সময় মতো রোগ ধরা না পড়লে নানা বিপত্তিও ঘটতে পারে। শ্বাসপথ আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। ফুসফুসে রোগ ছড়াতে পারে। শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুও হতে পারে। স্নায়ু প্রদাহ বা পলি নিউরাইটিস হতে পারে। হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এই রোগের চিকিৎসা বাড়িতে রেখে করা উচিত নয়। গলার আক্রান্ত অংশ থেকে রস নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করলেই ডিপথেরিয়া রোগের জীবাণু ধরা পড়ে। রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোনও হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে পাঠানো উচিত। সেখানে অ্যান্টিটক্সিন, অ্যান্টিবায়োটিক, ফ্লুইড ইত্যাদির সাহায্যে চিকিৎসা শুরু হয়। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর রোগীকে বাড়িতে কিছুদিন পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হয়। প্যারালাইসিস বা অন্য কোনও জটিলতা দেখা দিলে দীর্ঘদিন বিশ্রামের প্রয়োজন হয়।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৯: গাধা পিটিয়ে ঘোড়া

রোগটা খুব ছোঁয়াচে। রোগীর হাঁচি-কাশি থেকে বাতাসে মিশে এই রোগ ছড়াতে পারে। এছাড়া রোগীর ব্যবহৃত জামাকাপড়, বাসনপত্র বিছানা থেকেও এই রোগ দ্রুত ছড়ায়। কাজেই রোগীকে সবসময় আলাদা রাখতে হবে। এই রোগ শিশুদের বেশি হয়। বছরের যে কোনও সময়ই রোগটা হতে পারে। পুরুষ বা মহিলা, যে কেউই আক্রান্ত হতে পারেন। ডিপথেরিয়া ব্যাসিলাই শ্বাসপথ দিয়ে প্রবেশ করে অর্থাৎ নাক বা গলা দিয়ে, খুব কম ক্ষেত্রে ত্বকের কোনও ঘা বা ক্ষত দিয়েও প্রবেশ করতে পারে।

এই রোগের প্রতিষেধক অনেকদিন আগেই বেরিয়েছে। কাজেই এখন ডিপথেরিয়া হলেও জীবন সংশয়ের আশঙ্কা অনেক কমে গেছে। শিশু জন্মাবার পর তিন থেকে নয় মাস বয়সের মধ্যে চার সপ্তাহ ব্যবধান রেখে পরপর তিনটি ট্রিপল অ্যান্টিজেন ইঞ্জেকশন নিতে হয়। এতে ডিপথেরিয়া, টিটেনাস এবং হুপিং কাশির প্রতিষেধক থাকে। পরবর্তী এক বছর এবং পাঁচ বছর বয়সে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়।

শিশুর জ্বর, গিলতে কষ্ট, গলা ফোলা এবং মুখ দিয়ে লালা ঝরা— এই চারটি উপসর্গ থাকলে তৎক্ষণাৎ ডাক্তার ডাকবেন। সামান্য দেরি মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৮: ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম এবং ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: টেম্পেল ট্রি চাঁপার এই গুণগুলি সম্পর্কে জানতেন?

 

বিড়াল ঘাটাঘাঁটির সঙ্গে ডিপথেরিয়ার কোনও সম্পর্ক আছে?

এ বার বিড়াল ঘাটাঘাঁটির প্রসঙ্গে আসি। এর সঙ্গে ডিপথেরিয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে বিড়ালের লোম এবং লালা থেকে অনেকের অ্যালার্জি হতে পারে। বিশেষ করে যেসব বিড়াল সারাদিন পাড়া ঘুরে বেড়ায়। সাধারণত বাড়ির পোষা বিড়ালরা খুব যত্নেই থাকে। তাদের নিয়মিত প্রতিষেধক দেওয়া হয়, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। কাজেই তাদের থেকে সচরাচর রোগ ছড়ায় না। অ্যালার্জির উপসর্গ তো সবাই জানেন। হাঁচি-কাশি, নাক দিয়ে জল ঝরা, খুসখুসে কাশি, চোখ ছল ছল, নাক-চোখে চুলকোনি ইত্যাদি। যেসব শিশু সারা বছর সর্দি-কাশিতে ভোগে, তাদের বিড়াল কুকুর সহ যে কোনও কোনো পশু এবং পাখি থেকে দূরে রাখাই ভালো।

* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content