সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

২০২২ এর জানুয়ারি। একটি খবর সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দেয়। ৫৭ বছর বয়সী মিস্টার ডেভিড বেনেট নামে আমেরিকার একজন হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ‘জেনেটিকালি মডিফাইড’ (জিনগত পরিবর্তন সম্মিলিত) শুকরের হৃদপিণ্ড প্রথম সফলভাবে প্রতিস্থাপন করেন। পুরো পর্বটি রীতিমতো কল্পবিজ্ঞানের গল্পকেও হার মানায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় ওই বছরই মার্চ মাসে ঠিক ৬১ দিনের মাথায় তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু বিজ্ঞান তো তার জন্য থেমে থাকবে না। এই নিয়েই এখন নানান গবেষণা চলছে সারা দুনিয়ায়, যাতে আমাদের শরীরের অকেজ হয়ে যাওয়া অংগুলিকে আমরা আবার বাঁচিয়ে তুলতে পারি।

জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন, এই পদ্ধতিতে মানুষের শরীরের অকেজ বা নষ্ট হয়ে যাওয়া কোনও অঙ্গ অন্যকোনও একটি প্রজাতির প্রাণীর অঙ্গ মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়।
 

গবেষণার প্রেক্ষাপট

বিজ্ঞানীরা গত ৩০ বছর ধরে শূকরের থেকে মানুষের দেহে অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। গবেষণার কাজে ব্যবহৃত এই শূকরকে প্রথম ‘জেনেটিকালি মডিফাই’ করে নেওয়া হয়, যাতে মানুষের দেহে তাদের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করলে কোনও সমস্যা না হয়। আর এই গবেষণা যদি ১০০ শতাংশ সফল হয় তাহলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নতুন দিক খুলে যাবে। এরই খানিকটা সফলতা আমরা গত বছর আমেরিকার ওই ৫৭ বছর বয়সী হৃদরোগীর ক্ষেত্রে দেখেছিলাম।

মানব শরীরে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেনের সরবরাহ সমস্ত কোষে ঠিকমতো না পৌঁছলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই কোষের মৃত্যু হতে শুরু করে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, মস্তিষ্কে যদি ৩ মিনিটের বেশি রক্ত চলাচল বন্ধ থাকে তাহলে মৃত্যু অবধারিত। তারপর মস্তিষ্ককে পুনরুজ্জীবিত করা অসম্ভব। কিন্তু বিজ্ঞানের গবেষণার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখিয়েছে, কয়েক ঘণ্টা রক্ত সরবরাহ বন্ধ থাকার পরও মৃত কোষগুলিকে আবার পুনর্জীবিত করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু এই ধরনের গবেষণা এতদিন পর্যন্ত কেবলমাত্র গবেষণাগারে পরীক্ষামূলক প্রাণীর বিভিন্ন অঙ্গ নিয়ে করা হতো।

আরও পড়ুন:

জিন এডিটিংয়ে নতুন দিশা, ইঁদুর ফিরে পেল দৃষ্টিশক্তি! মানুষের অন্ধত্বে আলো দেখাবে এই গবেষণা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৫: শরীর ফিট রাখতে রোজ ভিটামিন টনিক খাচ্ছেন?

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৪: কাওয়ার্ধা পরিভ্রমণ

২০১৯ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নিনাদ সেসটান প্রথম এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখান। তিনি এবং তাঁর গবেষক দল কসাইখানায় মৃত্যুর চার ঘণ্টা বাদে ৩২ খানা শূকরের মস্তিষ্ক নিয়ে দেখিয়েছিলেন যে, তাঁদের তৈরি বিশেষ কক্ষে এবং রাসায়নিক দ্রবণের সাহায্যে নির্জীব সেই সব মস্তিষ্কে স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া ও জৈবিক বিক্রিয়া শুরু হয়েছে। মস্তিষ্ক আবার গ্লুকোজ থেকে শক্তি উৎপাদন শুরু করেছে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হচ্ছে যা গ্লুকোজ মেটাবলিজম-এর ফলে উৎপন্ন হয়। পুরো ৩৬ ঘণ্টা এই মস্তিষ্কগুলোকে যে যন্ত্রের সাহায্যে সজীব রেখে এই অসাধ্যসাধন হয়েছিল তার নাম ছিল ‘অর্গান-এক্স’।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি

বশ মানছে না ভুঁড়ি? রইল পাঁচটি সহজ টোটকা

ষাট পেরিয়ে, পর্ব-১২: প্রবীণদের টিকা—আপনি নিয়েছেন তো? দ্বিতীয় পর্ব

 

অর্গান-এক্স কী?

অরগ্যান এক্স হল হার্ট-লাং মেশিনের মতো একটি যন্ত্র, যা কোনও বড় অস্ত্রোপচারের সময় হার্ট, হৃদপিণ্ড এবং ফুসফুসের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ যন্ত্রের মাধ্যমে চালিয়ে যায়। এই যন্ত্রের সাহায্যে শূকরের দেহের রক্তের সঙ্গে একটি এক্সপেরিমেন্টাল প্রতিরোধমূলক তরল মিশিয়ে সারা দেহে রক্তবাহের মধ্যে দিয়ে সরবরাহ করা হয়, যাকে পারফিউশন বলে। এই তরলের মধ্যে অক্সিজেন এবং সিন্থেটিক হিমোগ্লোবিন, যা লোহিত রক্তকণিকার মধ্যে থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করে, মিশ্রিত থাকে। এছাড়া শূকরের রক্তের বিভিন্ন ইলেকট্রোলাইট এবং রক্ত জমাট না বাধার জন্য যে রাসায়নিক পদার্থগুলি প্রয়োজন সেগুলিও মিশ্রিত থাকে।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫০: ‘ফিশ পাস’ পুরোদমে চালু হলে ইলিশের প্রজনন বাধাহীনভাবে সম্ভবপর হবে

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৫: অসুখের শরীর, সমাজের কাছে ভয় নারীর

 

চিকিৎসা বিজ্ঞানে আলোড়ন

নিনাদ সেসটান এবং তাঁর গবেষক দল হার্ট অ্যাটাক হওয়া শূকরগুলিকে এক ঘণ্টার পর এই অর্গান এক্স যন্ত্রের সাহায্যে পারফিউশন পদ্ধতিতে ছয় ঘণ্টা ধরে পরীক্ষামূলক রক্ত ও তরলের মিশ্রণটি চালিয়ে যান। অর্গান-এক্স সারা শরীরে সমস্ত কোষে পরিমাণ মতো অক্সিজেন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়। রক্ত সরবরাহ বন্ধ হলে শরীরের যে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়, এই যন্ত্রটি সেটিরও প্রতিরোধে সফল হয়।

এই পরীক্ষা নিরীক্ষার পর মৃত্যুর সংজ্ঞা নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে রীতিমতো বিতর্কের সৃষ্টি হয়। নিনাদ সেসটান-এর গ্রুপ মৃত শূকরের শরীরকেই অর্গান-এক্স এর সাহয্যে মৃত্যুর এক ঘণ্টা বাদে জীবত করার চেষ্টা করেন এবং আবারও অসাধ্যসাধন করলেন। অর্গান-এক্স যন্ত্রে রাখবার পর তাঁরা সেই মৃত শূকরদের দেহে আবার হৃদস্পন্দন শুনতে পেলেন। লিভার এবং কিডনিও যে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ পেয়েছেন। মস্তিষ্কের মধ্যে চাঞ্চল্যতাও দেখা গেল।

সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা হল, অর্গান-এক্স যন্ত্রে রাখা মৃত শুয়োরদের মাথার সামান্য নড়াচড়াও লক্ষ্য করা গিয়েছে। গবেষকদের কাছে এই ঘটনার এখনও পর্যন্ত কোনও ব্যাখ্যা নেই। গত বছর আগস্ট মাসে বিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘নেচার’ এ সাড়া জাগানো এই বিজ্ঞানমূলক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পরে সারা দুনিয়াতে সত্যিই শোরগোল পড়ে গিয়েছে।

* প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান (health-science): ড. দোলন দাস, (Dolan Das) শারীরবিদ্যার অধ্যাপিকা, কল্যাণী মহাবিদ্যালয়।

Skip to content