সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্নতা আমাদের স্বাস্থ্যের উপর নানান খারাপ প্রভাব ফেলে, যার মধ্যে মৃত্যুহার বৃদ্ধি, কার্ডিওভাসকুলারের সমস্যা এবং কিছু ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাও দেখা দেয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, মানসিক চাপ অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি এবং হাড়ের স্বাস্থ্যের নানা সমস্যা বাড়ায়। তবে একাকীত্ব এবং হাড়ের স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক এখনও অস্পষ্ট রয়ে গিয়েছে।
সম্প্রতি গবেষকরা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বিষয়ে ইঁদুরের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা পুরুষ ইঁদুরের হাড়ের ক্ষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু স্ত্রী ইঁদুরের সঙ্গে ততটা নয়। এই গবেষণার অংশ হিসাবে গবেষকেরা অন্বেষণ করেছেন, কীভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা পুরুষ এবং মহিলা ইঁদুরের হাড়ের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত এন্ডোক্রাইন সোসাইটির বার্ষিক সভা, ‘ইএনডিও-২০২৩’-এই বিষয়টি স্থান পায়। তবে এই গবেষণা কীভাবে সামাজিক বিচ্ছিনতা হাড়ের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, তা পরিষ্কার করে ব্যা খ্যাষ করতে পারেনি।
ইউটিহেলথ হিউস্টনের ম্যাকগভর্ন মেডিকেল স্কুলের জেরিয়াট্রিক্সের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ নাহিদ রিয়ানন এই গবেষণার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। যদিও তিনি গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, “এই গবেষণাটি প্রাণীদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান৷ মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে বয়স্ক ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যাঁরা প্রায়শই সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্নতায় ভোগেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই গবেষণার ফলাফলগুলি সতর্ক থাকার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। সেই সঙ্গে তাঁদের হাড়ের খয়ের ঝুঁকি রয়েছে কিনা সেটি বুঝতেও কাজে আসবে।” তিনি এও বলেন, বয়স্কদের যাঁদের হাড়ের স্বাস্থ্যের সমস্যা রয়েছে, তাঁদের শনাক্ত করে হাড় ভাঙ্গা বা ফ্র্যাকচার এবং অক্ষমতার মতো সমস্যার হাত থেকে প্রতিরোধ করতেও এই গবেষণার ফলাফল কাজে আসবে।
ডাঃ রেবেকা মাউন্টেন, মেইনহেলথ ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চের সেন্টার ফর মলিকুলার মেডিসিনের পোস্টডক্টরাল ফেলো এবং এই গবেষণার একজন সহকারী ও প্রধান লেখক। তাঁর কাথায়, “সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যের প্রভাবগুলির সঙ্গে লড়াই করার কারণে ফলাফলগুলির ক্লিনিকাল প্রভাবও হাড়ের ক্ষতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে৷ কোভিড-১৯ অতিমারি আমাদের গত দু’ বছরে বিচ্ছিন্নতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের মধ্যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার প্রভাব বোঝার জন্য ভবিষ্যতে আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন।”
গবেষণা পদ্ধতি
● গবেষকরা ১৬ সপ্তাহ বয়সী ৩২টি পুরুষ এবং মহিলা ইঁদুরের মধ্যে বিশেষ ভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁরা ৪ সপ্তাহের জন্য বিচ্ছিন্ন পুরুষ ইঁদুরে হাড়ের খনিজ ঘনত্ব, ভলিউম ভগ্নাংশ এবং কর্টিকাল হাড়ের পুরুত্ব পরীক্ষা করেছেন। এই পরিবর্তনগুলি হাড়ের গুণমান হ্রাস এবং ফ্র্যাকচারের ঝুঁকিকে বৃদ্ধি নির্দেশ করে। ফলাফল স্বরূপ দেখা যায়, বিচ্ছিন্ন পুরুষ ইঁদুরের হাড়ের ঘনত্ব কমে গিয়েছে।
অন্য দিকে বেশ কিছু মানুষের উপর করা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বিচ্ছিন্ন মহিলারা হাড়ের ক্ষয় অনুভব করেননি। তবে হাড়ের রিসোর্পশন-সম্পর্কিত জিনের অভিব্যক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দ্রুত হাড় ভাঙার এবং ফ্র্যাকচারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
কী কারণে হাড়ের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়?
● ডাঃ মাউন্টেনের দল সেই প্রক্রিয়াগুলি অনুসন্ধান করছে, যার দ্বারা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা হাড়ের ক্ষয় করতে পারে। এর মধ্যে স্ট্রেস হরমোন এবং শরীরের সহানুভূতিশীল স্নায়ুতন্ত্রও অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, প্যাসিফিক নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের একজন নিউরোলজিস্ট ডাঃ উইলিয়াম বাক্সটন বিশ্বাস করেন, হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধের জন্য সর্বোত্তম উপায়গুলির মধ্যে একটি হল ওজন বহন করার ব্যায়াম। যদি কেউ বিচ্ছিন্ন থাকেন, তাহলে তাঁর বাড়ির বাইরে যাওয়ার ও কাজকর্ম করার সম্ভাবনা কম থাকে। ফলস্বরূপ, তাঁদের ওজন বহন করার মতো কাজ করার প্রবণতাও কমে যায়। ডাঃ রিয়ানন উল্লেখ করেছেন, বিষণ্নতা এবং কম ওজন— দুর্বলতা, অক্ষমতা এবং গতিশীলতা হ্রাস করতে পারে, যা হাড়ের ক্ষয় হতে পারে। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন। এই ধরনের গবেষণা অন্তর্নিহিত বিপাকীয় পরিবর্তনগুলি বুঝতে ও সঠিক সময় সঠিক চিকিৎসা দিতে সাহায্য করবে।
পুরুষ এবং মহিলা ইঁদুরের মধ্যে প্রভাবের পার্থক্য
● ডাঃ মাউন্টেন হাড়ের উপর ইস্ট্রোজেনের প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা বিবেচনা করে পুরুষ এবং মহিলাদের উপর সামাজিক বিচ্ছিন্নতার প্রভাবগুলির অনুসন্ধান করছেন। তিনি জানান, এটাও সম্ভব যে, বিচ্ছিন্নতা পুরুষ এবং মহিলা ইঁদুরের মধ্যে বিভিন্ন উপায়ে বা ভিন্ন ‘টাইম স্কেলে’ কাজ করছে। ডাঃ ডগলাস ল্যান্ড্রি জার্ভিস, শার্লট, এনসি-তে নোভান্ট হেলথের একজন অর্থোপেডিক সার্জন। তিনি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবে ডগলাসের পরামর্শ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা টেস্টোস্টেরন উৎপাদন এবং হরমোনের ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে। সম্ভাব্য হাড়ের বিপাককে নেতিবাচকভাবে পরিবর্তন করতে পারে। মহিলাদের হরমোন চক্র ৪-সপ্তাহের ব্যবধানে কম প্রভাবিত হতে পারে। প্যাসিফিক নিউরো সাইন্স ইনস্টিটিউট-এর ফল প্রিভেনশন ইউনিট এবং নিউরোমাসকুলার ও নিউরোসাইন্স বিভাগের অধ্যক্ষ নিউরোলজিস্ট ডাঃ উইলিয়াম বাক্সটনের মতে, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন একাকী পুরুষেরা মহিলাদের তুলনায় শারীরিকভাবে কাজকর্ম কম করে থাকেন, যা কিনা হাড়ের স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তাহলে কীভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এড়াবেন?
● অপার্থিব জগতের তুলনায় পার্থিব জগতে বেশি সময় কাটানো স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। ফেসবুকে বন্ধু না বানিয়ে বাস্তব জগতে মুখোমুখি বসে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা শরীর স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশি ভালো। সমমনস্ক মানুষজনের সঙ্গে বেশি সময় কাটান। সারাদিন ঘরে বসে না থেকে প্রতিদিন কিছুটা সময় প্রকৃতির মাঝে কাটানো এবং কিছুটা সময় হাটাহাটি করলে শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।
* প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান (health-science): ড. দোলন দাস, (Dolan Das) শারীরবিদ্যার অধ্যাপিকা, কল্যাণী মহাবিদ্যালয়।