রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

 

রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা কী?

আমাদের চোখের একটি বিরল জিনঘটিত বংশগত রোগ হল এই রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা। রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসারে ভুগলে জন্মের পর থেকে ধীরে ধীরে চোখে দেখার সমস্যা আসতে থাকে। পরবর্তীকালে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি একদমই থাকে না। এর লক্ষণ জন্মের পর শিশু অবস্থায় আসতে শুরু করে এবং ৪০ বছর বয়সে পৌঁছনোর মধ্যেই আক্রান্ত ব্যক্তি একেবারেই অন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই রোগের কোনও চিকিৎসা ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এবং জিন থেরাপি গবেষণার অগ্রগতির ফলে রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে প্রায় চার হাজার জনের মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত। গবেষণায় জানা গিয়েছ্যে, প্রায় ১০০টি জিনের মিউটেশনের জন্য রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা হয়ে থাকে।

আমাদের চোখের দৃষ্টিশক্তির জন্য দু’ ধরনের রিসেপটার থাকে। একটি হল রড কোষ এবং অন্যটি কোন কোষ। রড কোষ থাকার জন্য আমরা কম আলোতেও দেখতে পাই এবং কোন থাকার ফলে আমরা উজ্জ্বল আলোয় রঙিন জিনিসপত্র দেখতে পাই। এই রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা রোগের ফলে প্রথমে কম আলোতে দেখার অনুভূতি আমাদের নষ্ট হতে থাকে অর্থাৎ রড কোষগুলি ঠিক মতো কাজ করা ক্ষমতা হারায় এবং ধীরে ধীরে তা কোন কোষগুলিতেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শেষে সম্পূর্ণভাবেই দৃষ্টিশক্তির লোপ পায়, যা আর কোনওভাবেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কারণ এটি একটি জিন ঘটিত রোগ। সম্প্রতি চিনের কয়েকজন বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন যে, ইঁদুরের চোখে রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা হলে তার হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টিশক্তি ‘জিন এডিটিং’ এর মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ‘জার্নাল অফ এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিন’ নামক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকায় চিনা গবেষকদের এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২৩ এর মার্চ মাসেই। সেখানে তাঁরা দেখিয়েছেন সিআরআইএসপিআর (CRISPR) ‘জিন এডিটিং’ পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে এই ইঁদুরের রেটিনাটিস পিগমেন্টোসা রোগটিকে সারানো সম্ভব।
আরও পড়ুন:

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: মাঝে মাঝেই মাথাব্যথায় ভুগছেন? মাইগ্রেন নয় তো

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১১: ফুটবলের ব্ল্যাক প্যান্থার: লেভ ইয়াসিন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৭: কবির লেখা, লেখার গল্প

এর আগে ‘জিনোম এডিটিং’ এর সাহায্য নিয়ে ইঁদুরের চোখের জেনেটিক রোগ ‘লিবার কনজেনিক্যাল অ্যামিউরোসিস’ এর ফলে হারিয়ে যাওয়ার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা গিয়েছে। এই রোগের ফলে রেটিনার পিগমেন্ট এপিথেলিয়াম স্তর (যা চোখের স্নায়ু কোষ রড এবং কোণের আলোক গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে) ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধীরে ধীরে দেখার ক্ষমতা লোপ পেতে থাকে। রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসার মতো মানুষের চোখের বেশিরভাগ বংশগত রোগই ফটো রিসেপ্টর রড এবং কোণের সমস্যার জন্যই হয়ে থাকে, যার ফলে ধীরে ধীরে আমাদের দেখার ক্ষমতা কমতে কমতে শেষ পর্যন্ত একেবারে অন্ধ হয়ে যেতে হয়।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৯: মিশ্র মাছচাষ পদ্ধতিতে শুধু ফলন বাড়েনি, মাছের বৈচিত্রের সমাহারও নজর কেড়েছে

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৪: সমাজে নারীর বন্ধ্যাত্ব এবং পিতৃতান্ত্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮: ‘বাইরে বেরুলেই বিপদ!’

 

গবেষণা পদ্ধতি

বিজ্ঞানীরা এই গবেষণায় ‘জিন এডিটিং’ বিশেষ এক উন্নতমানের যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে ইঁদুরের চোখের স্নায়ু কোষ বিশেষত ক্ষতিগ্রস্ত বা মৃতপ্রায় ফোটোরিসেপ্টার কোষ রড এবং কোণের জিনোমকে এডিট করে ইঁদুরের রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। গবেষণাগারে ইঁদুরের পিডিই৬বিটা (PDE6beta) জিন, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম তৈরি করে, মিউটেশন করিয়ে রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা রোগটি সৃষ্টি করেছেন। অন্ধ হয়ে যাওয়া এই ইঁদুরগুলির দৃষ্টিশক্তি আবার ফিরিয়ে আনার জন্য গবেষক দল একটি নতুন এবং উন্নত মানের সিআরআইএসপিআর (CRISPR) পদ্ধতি যা PESpRY নামে পরিচিত এবং যা যেকোনও জিনের যে কোন জায়গায় হওয়া মিউটেশনকে ঠিক করতে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে পিডিই৬বিটা (PDE6beta) জিনের মিউটেশনকে ঠিক করতে PESpRY সিস্টেমকে ব্যবহার করা হয়েছে এবং অন্ধ হয়ে যাওয়া ইঁদুরগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এনজাইমটিকে কার্যকর করা গিয়েছে।

ছবি: প্রতীকী।

দেখা গিয়েছে, চার মাস বয়সী ইঁদুরগুলি যাদের রেটিনাইটিস পিগমেন্টটোসা আছে তাদের রেটিনার স্তরটি খুবই পাতলা এবং ফোটোরিসেপ্টার রড কোষের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু যাদের PESpRY সিস্টেমকে ব্যবহার করে জেনেটিক মিউটেশন ঠিক করা হয়েছে তাদের রেটিনার স্তর অনেক মোটা এবং সেখানে রড কোষের সংখ্যাও অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে জিন এডিটিং এর সাহায্যে রড এবং কোন কোষের মৃত্যু ঠেকানো গিয়েছে এবং সেগুলির আলোর উপস্থিতিতে স্নায়ু উদ্দীপনাও অনেক। গবেষকরা আরও নানা ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন যে, জিন এডিট করা হয়েছে এমন ইঁদুরগুলির পরিণত বয়স পর্যন্ত চোখের দৃষ্টি একই রকম থাকে। বিভিন্ন রকম উদ্দীপনা এই ইঁদুরগুলির মধ্যে দিয়েও দেখা গিয়েছে তাদের ‘ভিজুয়াল রেসপন্স’ স্বাভাবিক ইঁদুরের মতোই।
আরও পড়ুন:

পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩০: দিনের পরে দিন গড়ে যায় ‘বিধিলিপি’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৪: গরম পড়েছে, যত পারুন ঠান্ডা খান! কী হচ্ছে এর ফলে?

 

মানব সমাজের উপকারে লাগবে কি?

বিজ্ঞানীরা বলছেন, PESpRY সিস্টেম নিয়ে কাজ করার এখনও অনেক বাকি। সেই কাজ সম্পন্ন হলে আরও বেশি নিরাপদ এবং কার্যকরী ভাবে মানুষের ওপর এর ব্যবহার করা সম্ভব হবে। তবে এই গবেষণার ফলে জিন এডিটিং পদ্ধতিকে বিভিন্ন বংশগত জেনেটিক রোগের নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা দিকে একটি নতুন দিশা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন জিনঘটিত চোখের রোগ যেমন রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা বা লিবার কনজেনিটাল অ্যামিউরেসিস এর মতো বিরল চোখের রোগের কারণে মানুষ অন্ধত্বের শিকার হতেন, তা এর ফলে নিরাময়ের সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

* প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান (health-science): ড. দোলন দাস, (Dolan Das) শারীরবিদ্যার অধ্যাপিকা, কল্যাণী মহাবিদ্যালয়।

Skip to content