বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

এই প্রথম তিনজনের ডিএনএ ব্যবহার করে ইংল্যান্ডে শিশুর জন্ম হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সে দেশের প্রজনন নিয়ন্ত্রক সংস্থা। শিশুটির বেশিরভাগ ডিএনএ এসেছে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে। আর প্রায় ০.১% ডিএনএ নেওয়া হয়েছে তৃতীয় একজন মহিলা দাতার থেকে। ওই শিশুর এখন জৈবিক মা–বাবা তিনজন। এই কৌশলের সাফল্য শিশুদের মাইটোকনড্রিয়াল রোগ নিয়ে জন্ম নেওয়াকে প্রতিরোধ করার একটি যুগান্তকারী প্রচেষ্টা। দীর্ঘদিনের গবেষণার ফলে আপাতত এই ধরনের পাঁচটি শিশুর জন্ম হয়েছে। তবে বিস্তারিত তথ্য এখনও পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসেনি ।
 

মাইটোকনড্রিয়াল রোগটি কী?

মাইটোকনড্রিয়াল রোগ নিরাময়যোগ্য নয়। জন্মের কয়েক দিন বা এমনকি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেও মারাত্মক হয়ে হতে পারে। এমনকি এর ফলে মৃত্যুও হতে পারে। বেশ কিছু পরিবার এই মাইটোকনড্রিয়াল সমস্যার জন্য একাধিক সন্তান হারিয়েছেন। এখন এ ভাবে বাবা-মা এবং দাতার ডিএনএ নিয়ে কৃত্রিম প্রজনন কৌশলের সাফল্য সে সব পরিবারের একটি সুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়ার একমাত্র বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে।

 

মাইটোকনড্রিয়া কেন হয়?

মাইটোকনড্রিয়া হল আমাদের শরীরের প্রায় প্রতিটি কোষের অভ্যন্তরে থাকা ক্ষুদ্র একটি অংশ, যা খাদ্যকে ব্যবহারযোগ্য শক্তিতে রূপান্তরিত করে। ত্রুটিপূর্ণ মাইটোকনড্রিয়া শরীরকে জ্বালানি দিতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশ হয় না। পেশীর গঠনও ঠিক মতো হয় না। এর ফলে জন্মের সময় হার্ট ফেলিওরের সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় অন্ধত্বের সমস্যা নিয়েও শিশু জন্ম নেয়।
 

মাইটোকনড্রিয়া ডোনেশন ট্রিটমেন্ট

এই ধরনের মাইটোকনড্রিয়াল রোগ শুধু মায়ের জিন থেকেই সন্তানের মধ্যে আসে। তাই মাইটোকনড্রিয়া ডোনেশন ট্রিটমেন্ট হল আইভিএফ বা কৃত্রিম প্রজননের একটি পরিবর্তিত রূপ, যা একটি সুস্থ দাতার ডিম্বাণু থেকে মাইটোকনড্রিয়া ব্যবহার করে এটি করা হয়। মাইটোকনড্রিয়া দান করার জন্য দুটি পদ্ধতি রয়েছে, একটি বাবার শুক্রাণু দ্বারা মায়ের ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার পরে। অন্যটি নিষিক্ত হওয়ার আগে করা হয়।

আরও পড়ুন:

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান, জিনই মানুষকে অনন্য করেছে, শতাধিক স্তন্যপায়ীর জিন বিশ্লেষণে মিলল চমকপ্রদ তথ্য

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৫: চেয়ারে বসতে গিয়ে নজর গেল বিছানায়, দেখি সেই পুতুলের সবুজ চোখ দুটো আমাকে দেখছে

মাইটোকনড্রিয়াতে তার নিজস্ব জেনেটিক তথ্য বা মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ রয়েছে। ফলে শিশুরা যেমন তার বাবা-মায়ের থেকে ডিএনএ পায়, তেমনি দাতার কাছ থেকেও একটি অংশ উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। এটি একটি স্থায়ী পরিবর্তন, যা প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে বাহিত হতে থাকে। দাতার কাছ থেকে প্রাপ্ত ওই ডিএনএ শুধু কার্যকর মাইটোকনড্রিয়া তৈরির ক্ষেত্রেই কার্যকর। অন্যান্য বৈশিষ্ট্য যেমন চেহারা, গায়ের রং, চুলের রং ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে না। এর ফলে এক্ষেত্রে তৃতীয় অভিভাবকের প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা নেই। ইংল্যান্ডের নিউ ক্যাসেল শহরে এই পদ্ধতি প্রথম চালু হয়েছিল।

নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা প্রথম এই চিকিৎসা-পদ্ধতিতে সাফল্যের দাবি করে ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি চায়। বহুল আলোচিত-সমালোচিত সেই বিলের নাম ছিল ‘থ্রি-পারসনস বেবি’। বিল শেষ পর্যন্ত হাউস অব কমন্স পর্যন্ত গড়ায়। এমপিদের বলা হয় তাঁরা যেন দলীয় নীতি চিন্তা না করে এই প্রস্তাবের ‘নৈতিক দিক’ বিবেচনা করে ‘বিবেকের’ সাড়ায় এ ভোটে অংশ নেন। পরে ২০১৫ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের আইনপ্রণেতারা এই পদ্ধতি প্রয়োগের অনুমোদন দেন। তবে আইন পাস হলেও শুরুতে যুক্তরাজ্য এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেনি। এ পদ্ধতিতে প্রথম শিশুর জন্ম হয় ২০১৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিত্সা নেওয়া জর্ডানের একটি পরিবারে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রথম শিশুর জন্ম হয়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২২: স্টেরয়েড বড় ভয়ঙ্কর ওষুধ?

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২২: সামাজিক প্রতিবন্ধকতার দ্বিচারিতা

ইংল্যান্ডের হিউম্যান ফার্টিলাইজেশন অ্যান্ড এমব্রায়োলজি অথরিটি (এইচএফইএ) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ এর ২০ এপ্রিল পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে পাঁচটি শিশুর জন্ম হয়েছে। তবে পরিবারগুলির গোপনীয়তা রক্ষার জন্য সংস্থার তরফ থেকে সঠিক তথ্য দেওয়া হচ্ছে না। গার্ডিয়ান পত্রিকার তথ্যের স্বাধীনতার অনুরোধের পরেই এই সীমিত তথ্যগুলি আমাদের সামনে আজ উঠে এসেছে। যুক্তরাজ্যের প্রোগ্রেস এডুকেশনাল ট্রাস্টের পরিচালক সারাহ নরক্রস জানান, পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে দান করা মাইটোকন্ড্রিয়া নিয়ে এখন যুক্তরাজ্যে অল্পসংখ্যক শিশু জন্ম নেবে। মাইটোকন্ড্রিয়া দানের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও মূল্যায়ন ও পরিমার্জন করে ধীর ও সতর্ক থাকতে হবে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২: এই প্রথম বার মনে হল জীবন কঠিন হতে চলেছে, তাই মনে মনে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম

অজানার সন্ধানে, অঙ্কই ধ্যানজ্ঞান, মোটা বেতনের চাকরি নির্দ্বিধায় ছেড়ে দেন আইআইটি-র শ্রবণ

নিউ ক্যাসেলের চিকিৎসক ও গবেষক দলের তরফ থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই কৌশলটি সফল হয়েছিল কিনা তা এখনও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। তবে লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্রিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক রবিন লাভেল–ব্যাজের মতে, মাইটোকনড্রিয়াল রিফ্রেশমেন্ট থেরাপি পদ্ধতিটি ব্যবহারিক পর্যায় কতটা ভালোভাবে কাজ করছে, শিশুরা মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হচ্ছে কিনা বা কোনও ঝুঁকি থাকছে কিনা তা জানতে পারলে বিষয়টির বাস্তবিকতা অনেক বেশি হবে। এটিও নজরে রাখতে হবে যে, তাদের পরবর্তী জীবনে মাইটোকনড্রিয়াজনিত কোনও সমস্যা থাকছে কি না।

প্রযুক্তিগতভাবে প্রত্যাবর্তনের একটি ঝুঁকি তো রয়েছে, সেই সঙ্গে কোনও ত্রুটিপূর্ণ মাইটোকনড্রিয়া ব্যবহার করলে পরবর্তীকালে এই ধরনের সমস্যার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে পারে। এছাড়াও সেখান থেকে নানা মাইটোকনড্রিয়াল রোগ ও হতে পারে। তবে যাই হোক না কেন, মাইটোকনড্রিয়া ডোনেশন ট্রিটমেন্ট আগামী দিনে কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে সুস্থ সন্তান জন্মানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি নতুন দিশা দেখাতে পারে।
* প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান (health-science): ড. দোলন দাস, (Dolan Das) শারীরবিদ্যার অধ্যাপিকা, কল্যাণী মহাবিদ্যালয়।

Skip to content