ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
আয়ুর্বেদের বিভিন্ন সংহিতায় পঞ্চকশায় কল্পনা (স্বরস, কল্ক, ক্বাথ, হিম, ফান্ট) এর উল্লেখ আছে। এগুলির মধ্যে ক্বাথ এক অন্যতম ঔষধ নির্মাণপদ্ধতি যা সহজেই ঘরে বানানো যায়।
আয়ুর্বেদের ভৈষজ্য বিজ্ঞান শাখায় ক্বাথ নির্মাণ, ক্বাথ সেবন ও বিভিন্ন ক্বাথের গুণাগুণ নিয়ে সুবিস্তারিতভাবে বর্ণনা পাওয়া যায়। আরও সূক্ষ্মভাবে বললে রস প্রধান (মধুর, অম্ল, লবণ, তিক্ত, কটু, কশায়) চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ক্বাথ চিকিৎসা যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ও ফলপ্রসূ। শারঙ্গধর ক্বাথের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ক্বাথ দ্রব্য যদি প্রায় ৮০ গ্রাম হয় তাহলে তার ষোলোগুণ জল হতে হবে এবং মৃদু আঁচে মৃৎপাত্রে সেদ্ধ করে অষ্টমাংশ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে নিলেই ক্বাথ তৈরি হয়। এটি ঈষদুষ্ণ অবস্থায় সেবন করতে হয়।
এছাড়াও শারঙ্গধর তার ‘শারঙ্গধর সংহিতা’য় বিভিন্ন রোগে এককভাবে শুধুমাত্র ক্বাথ চিকিৎসায় বর্ণনা করেছেন।
যেমন—
দ্রক্ষাদি ক্বাথ: তৃষ্ণা, পিপাসা, দাহ প্রশমক।
আরোগ্যধাদি ক্বাথ: জ্বর, উদরশুল নাশক ও অগ্নিদীপক।
পুনর্নবাদি ক্বাথ: হাত পা ও পেটের শোথ নাশক ইত্যাদি।
ক্বাথ চিকিৎসায় বহুমুখী সুবিধা
● দ্রব্যগুণ বিজ্ঞান যুক্তিতে ক্বাথ, চূর্ণ ও ট্যাবলেট অপেক্ষা শরীরে দ্রুত শোষিত হয় ফলে রোগনিরাময়ে সময় কম লাগে।
● অধিকাংশ ক্বাথ দ্রব্য সহজেই লোকালয়ে পাওয়া যায় ফলে তা সাশ্রয়কর।
● ক্বাথে যেহেতু দ্রব্যকে তরলে ফুটিয়ে বানানো হয় তাই সেক্ষেত্রে ঔষধের গুণমান বৃদ্ধি পায় এবং এটি সরাসরি সেবনযোগ্য।
● ঘরোয়া পদ্ধতিতে নিজেই ঘরে বানানো সম্ভব ইত্যাদি।
আজও গ্রামবাংলায় বিভিন্নরকম প্রাথমিক রোগ নিরাময়ে ক্বাথের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
সেগুলোর মধ্যে নিম, বাসক, গুলঞ্চ, ত্রিফলা, নিশিন্দা, পটোল, অর্জুন, শুষনি, এরন্ড, বাবলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিভিন্ন ত্বকজ বিকারে নিম ক্বাথ
● বসন্ত এসে গেছে তাই শরীরের অনাক্রমতা বৃদ্ধিতে ও ঋতুপরিবর্তন জনিত উটকো রোগ ব্যামোর হাত থেকে রক্ষা পেতে নিম ব্রহ্মাস্ত্র।
আয়ুর্বেদে প্রায় সমস্ত রকমের ত্বকজ বিকার প্রশমনে বাহ্য ও অভ্যন্তরীণভাবে নিমের প্রয়োগ হয়ে থাকে।
প্রধানত যারা রক্তদুষ্টি জনিত ত্বকজ বিকারে ভুগছেন তারা কাঁচা নিমপাতা ১২ গ্রাম মতো ২-৩ কাপ জলে সেদ্ধ করে ১/৪ ভাগ থাকতে ছেঁকে খালিপেটে সেবন করুন। নিয়মিত কিছুদিন সেবন করলে উক্ত সমস্যাসমূহ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
বিষমজ্বর প্রতিরোধে গুলঞ্চ
● প্রাচীন বৈদ্যক গ্রন্থে বেশ কিছু ভেষজকে কাঁচা ব্যবহার করার কথা বলে হয়েছে তার মধ্যে গুলঞ্চ বা অমৃতা অন্যতম। বিভিন্ন সংহিতা ও নিঘন্টু-তে যার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে কারণ এটি তিক্ত কশায় রস প্রধান, রসায়ন, ত্রিদোষ সামক ও জ্বরহর। মূলত বিষমজ্বর নাশে গুলঞ্চ শ্রেষ্ঠ।
অর্থাৎ যেখানে বহুদিনের পুরোনো জ্বর আছে বা ঘুষঘুষে জ্বর আছে সেক্ষেত্রে গুলঞ্চ ক্বাথ নিয়মিত খালিপেটে অনুপান সহযোগে সেব্য।
প্রমেহ (সুগার) রোগীর পথ্য হিসেবেও গুলঞ্চ রস ও ক্বাথ বহুল প্রশংসনীয়।
শ্বাস-কাস নিবারণে বাসক ক্বাথ
● বাসক অতি পরিচিত এক বনৌষধি। গ্রামবাংলায় সর্দি, কাশি ও জ্বরের চিকিৎসায় বাসক ক্বাথ খুব জনপ্রিয়। আয়ুর্বেদ মতে বাসক প্রধানত রক্তপিত্ত চিকিৎসায় শ্রেষ্ঠ হিসাবে ধরা হয়, পাশাপাশি ক্ষয়রোগ, দীর্ঘদিনের কাস ও হুপিং কাশির বেগ প্রশমনে বাসক ক্বাথ অব্যর্থ।
বাতব্যাধির সমস্যায় নিশিন্দা ক্বাথ
● গ্রামবাংলায় আজও প্রচলিত আছে যে ভিটেতে নিম-নিশিন্দা গাছ থাকলে নাকি রোগ দূরে থাকে এর থেকেই নিসিন্দার গুণাগুণ সম্বন্ধে একটা সাম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
অন্যদিকে দ্রব্যগুণে নিশিন্দা প্রধানত বাতসামক ও বাতব্যাধি নিরাময়ে সুদীর্ঘকাল যাবৎ আয়ুর্বেদের বিভিন্ন ওষুধে ব্যবহার হয়ে আসছে। এই নিশিন্দা ক্বাথ ৩০ এম এল পরিমাণ সমপরিমাণ জল মিশিয়ে খালিপেটে সেবন করলে বাতজনিত ব্যথা বেদনায় দারুণ উপকার হয়।
ত্রিফলা ক্বাথ ও তার গুণাগুণ
● ত্রিফলার গুণাগুণ সকলের জানা আছে। এটি অনুপান সহযোগে প্রায় সর্বরোগেই কমবেশি ব্যবহার হয়ে থাকে এবং একে সর্বরোগনাশিনী নামেও অনেকে অভিহিত করেছেন এবং ভারতবর্ষ ছাড়াও বিশ্বের অন্যতম দেশগুলোতেও ত্রিফলা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে।
এই ত্রিফলা ক্বাথ কৃমি, কুষ্ঠ, ব্রণ থেকে শুরু করে যাবতীয় রক্তদুষ্টিজনিত ব্যাধিতে ফলপ্রদ।
অম্লপিত্ত সমস্যায় পটোল ক্বাথ
● পটোলপত্র পিত্তনাশক। যেখানে পিত্তের অম্লগুণ বিকৃত হওয়ার দরুন অম্লপিত্ত রোগের লক্ষণ দেখা যায় যেমন: হৃদ কণ্ঠ দাহ বা অম্লউদ্গার হচ্ছে সেক্ষেত্রে পটোল পত্র ক্বাথ খালিপেটে নিয়মিত কিছুদিন সেবন করলে এই জাতীয় সমস্যার সমাধান হয়।
তবে সঙ্গে বেশি ভাজাভুজি খাওয়ার ও আমিষ খাদ্যদ্রব্য এড়িয়ে চলতে হবে।
হৃদরোগ প্রতিরোধে অর্জুন ক্বাথ
● অর্জুন কশায় রসযুক্ত হৃদ্য ভেষজ। প্রধানত যাদের প্রায়ই বুক ধড়ফড় করে অথচ উচ্চ রক্তচাপের ব্যামো নেই সেক্ষেত্রে অর্জুন ছাল ১৫ গ্রাম মতো চারভাগ জলে সেদ্ধ করে একভাগ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে নিয়ে বিকেলের দিকে সেবন করুন। এতে উক্ত সমস্যার লাঘব হয় সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বাতজনক আহার-বিহার সেবন থেকে বিরত রাখুন।
মানসিক বিকারে শুশনি ক্বাথ
● বর্তমানে ব্যস্ততাময় জীবনযাত্রায় একশ্রেণির মানুষের মধ্যে মানসিক উদ্বেগ, একাকিত্ব, অনিদ্রা, চিত্তচাঞ্চল্য ও খিটখিটে মেজাজ এই জাতীয় সমস্যা ক্রমবর্ধমান। এক্ষেত্রে মেধ্য রসায়নের পাশাপাশি নিয়মিত ১৫ গ্রাম শুষনি শাক চারগুণ জলে মৃদু আঁচে সেদ্ধ করে খেলে সমস্যাসমূহ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
এরন্ড ক্বাথের গুণাগুণ
● আয়ুর্বেদ মতে এরন্ড ‘বৃষ্য বাত হরনাম’ অর্থাৎ এটি একদিকে বাজীকারক ও অন্যদিকে বাতনাশক। রোগ অনুযায়ী যারা বিশেষত দুর্বল ও যাদের বার্ধক্যজনিত কারণে যৌন ক্ষমতা ক্ষীণ হয়ে আসছে তাদের পক্ষে এরন্ড ক্বাথ সহায়ক।
দাস্তের সমস্যায় বাবলা
● দ্রব্যগুণ মতে রুক্ষ প্রদেশে যেখানে প্রচণ্ড তাপের দরুন অন্যান্য কোনও গাছ জীবনধারণ করতে পারে না সেখানে বাবলা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে এই শক্তি তার প্রকৃতি প্রদত্ত। অন্যদিকে রসবিজ্ঞান অনুযায়ী এটি তিক্ত কশায় রসে পূর্ণ এবং বায়বীয় শক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়ায় গুণে লঘু ও সূক্ষ্মস্রোতগামী তাই এটি আগন্তুক ব্যাধিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
বিশেষত আম সংযুক্ত পাতলা দাস্তের সমস্যায় বাবলার কচিপাতা ৪ গ্রাম পরিমাণ আধ পোয়া জলে সেদ্ধ করে ক্বাথ পরিমাণ সেবনীয়। এছাড়াও এই বাবলা ক্বাথ দিয়ে ক্ষতস্থান নিয়মিত ধুলে দূষিত ক্ষত পর্যন্ত সেরে যায়।
লেখক: আয়ুর্বেদ মেডিকেল অফিসার (উত্তর চণ্ডীপুর সদর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, মানিকচক, মালদা)
আয়ুর্বেদের ভৈষজ্য বিজ্ঞান শাখায় ক্বাথ নির্মাণ, ক্বাথ সেবন ও বিভিন্ন ক্বাথের গুণাগুণ নিয়ে সুবিস্তারিতভাবে বর্ণনা পাওয়া যায়। আরও সূক্ষ্মভাবে বললে রস প্রধান (মধুর, অম্ল, লবণ, তিক্ত, কটু, কশায়) চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ক্বাথ চিকিৎসা যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ও ফলপ্রসূ। শারঙ্গধর ক্বাথের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ক্বাথ দ্রব্য যদি প্রায় ৮০ গ্রাম হয় তাহলে তার ষোলোগুণ জল হতে হবে এবং মৃদু আঁচে মৃৎপাত্রে সেদ্ধ করে অষ্টমাংশ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে নিলেই ক্বাথ তৈরি হয়। এটি ঈষদুষ্ণ অবস্থায় সেবন করতে হয়।
এছাড়াও শারঙ্গধর তার ‘শারঙ্গধর সংহিতা’য় বিভিন্ন রোগে এককভাবে শুধুমাত্র ক্বাথ চিকিৎসায় বর্ণনা করেছেন।
যেমন—
আজও গ্রামবাংলায় বিভিন্নরকম প্রাথমিক রোগ নিরাময়ে ক্বাথের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
সেগুলোর মধ্যে নিম, বাসক, গুলঞ্চ, ত্রিফলা, নিশিন্দা, পটোল, অর্জুন, শুষনি, এরন্ড, বাবলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আয়ুর্বেদে প্রায় সমস্ত রকমের ত্বকজ বিকার প্রশমনে বাহ্য ও অভ্যন্তরীণভাবে নিমের প্রয়োগ হয়ে থাকে।
প্রধানত যারা রক্তদুষ্টি জনিত ত্বকজ বিকারে ভুগছেন তারা কাঁচা নিমপাতা ১২ গ্রাম মতো ২-৩ কাপ জলে সেদ্ধ করে ১/৪ ভাগ থাকতে ছেঁকে খালিপেটে সেবন করুন। নিয়মিত কিছুদিন সেবন করলে উক্ত সমস্যাসমূহ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
অর্থাৎ যেখানে বহুদিনের পুরোনো জ্বর আছে বা ঘুষঘুষে জ্বর আছে সেক্ষেত্রে গুলঞ্চ ক্বাথ নিয়মিত খালিপেটে অনুপান সহযোগে সেব্য।
প্রমেহ (সুগার) রোগীর পথ্য হিসেবেও গুলঞ্চ রস ও ক্বাথ বহুল প্রশংসনীয়।
অন্যদিকে দ্রব্যগুণে নিশিন্দা প্রধানত বাতসামক ও বাতব্যাধি নিরাময়ে সুদীর্ঘকাল যাবৎ আয়ুর্বেদের বিভিন্ন ওষুধে ব্যবহার হয়ে আসছে। এই নিশিন্দা ক্বাথ ৩০ এম এল পরিমাণ সমপরিমাণ জল মিশিয়ে খালিপেটে সেবন করলে বাতজনিত ব্যথা বেদনায় দারুণ উপকার হয়।
এই ত্রিফলা ক্বাথ কৃমি, কুষ্ঠ, ব্রণ থেকে শুরু করে যাবতীয় রক্তদুষ্টিজনিত ব্যাধিতে ফলপ্রদ।
তবে সঙ্গে বেশি ভাজাভুজি খাওয়ার ও আমিষ খাদ্যদ্রব্য এড়িয়ে চলতে হবে।
বিশেষত আম সংযুক্ত পাতলা দাস্তের সমস্যায় বাবলার কচিপাতা ৪ গ্রাম পরিমাণ আধ পোয়া জলে সেদ্ধ করে ক্বাথ পরিমাণ সেবনীয়। এছাড়াও এই বাবলা ক্বাথ দিয়ে ক্ষতস্থান নিয়মিত ধুলে দূষিত ক্ষত পর্যন্ত সেরে যায়।
লেখক: আয়ুর্বেদ মেডিকেল অফিসার (উত্তর চণ্ডীপুর সদর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, মানিকচক, মালদা)