শুক্রবার ৪ অক্টোবর, ২০২৪


গিরিশচন্দ্র যখন ধারাবাহিকভাবে ঐতিহাসিক নাটক লিখতে শুরু করেছেন মঞ্চস্হ করাবার জন্য তখন একটি নাটক লিখতে শুরু করলেন ‘ছত্রপতি শিবাজি’। নাটক রচনা শেষ হলে ১৩১৪ সালের জৈষ্ঠ মাসে (ইংরেজি ১৯০৭) ‘মিনার্ভা থিয়েটারে’ তার শিক্ষাদান কার্য তিনি আরম্ভ করলেন। ওই বছরেরই শুরুতে অর্থাৎ ১৩১৪ এর বৈশাখ মাসে শরৎকুমার রায় এক লক্ষ ৮ হাজার টাকার প্রকাশ্যে নিলামে গোপাল লাল শীলের ‘এমারেল্ড থিয়েটার’ ক্রয় করেন।

ইতিপূর্বে এই থিয়েটার বাড়িটি ভাড়া নিয়ে ‘ক্লাসিক থিয়েটার’ সম্প্রদায় বেশ কিছু নাটকের অভিনয় করেছিলেন। একজন উপযুক্ত অধ্যক্ষের বিশেষভাবে অভাব অনুভব করতে লাগলেন শরৎকুমার। তাঁর বাবা প্রসন্নকুমার রায় বহুদর্শী ও বিচক্ষণ ছিলেন। তিনি ছেলের কাছে গিরিশচন্দ্রের নাম উল্লেখ করে বলেন, “যদি আদর্শ নাট্যশালা স্থাপন করিতে চাও তাহা হইলে তাঁহার ন্যায় উপযুক্ত ব্যক্তির হস্তে কার্যভার অর্পণ করো।”
উদ্যোগশীল শরৎবাবু দশ হাজার টাকা বোনাস ও চার শতটাকা মাসে বেতন দিয়ে গিরিশচন্দ্রকে অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করলেন। তাঁর এই নতুন নাট্যশালার তিনি নাম রাখলেন ‘কোহিনুর থিয়েটার’। আষাঢ় মাসের শেষে গিরিশচন্দ্র কার্যভার গ্রহণ করলেন। প্রথমে ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘চাঁদবিবি’ নাটকের অভিনয় হয়েছিল কোহিনূর থিয়েটারে। পরে দ্বিতীয় নাটক হিসেবে বেছে নেওয়া হল ছত্রপতি শিবাজীকে। ‘ছত্রপতি শিবাজি’ মিনার্ভা থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হল ১৩১৪ সালের ৩২ শ্রাবণ। মিনার্ভায় গিরিশচন্দ্র তৃতীয় অংক পর্যন্ত এই নাটকের শিক্ষাদান করে কোহিনুর থিয়েটারে যোগদান করেছিলেন। তখন প্রখ্যাত অভিনেতা অমরেন্দ্রনাথ দত্ত মিনার্ভার অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করে শেষ দুটি অংকের অভিনয় শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৫৬: গিরিশচন্দ্রের ‘মীর কাসিম’ নাটক বাজেয়াপ্ত করেছিল ইংরেজ সরকার

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

প্রথম দিনে যাঁরা মিনার্ভা থিয়েটারে ছত্রপতি শিবাজি নাটকেঅভিনয় করেছিলেন তাঁরা হলেন অমরেন্দ্রনাথ দত্ত (শিবাজি), নীলমাধব চক্রবর্তী (দাদোজি কোন্ডদেব), নৃপেন্দ্রনাথ বসু (গঙ্গাজি), তারকনাথ পালিত (ঔরঙ্গজেব), প্রকাশমণি (জিজাবাই), সুধীরবালা (লক্ষীবাঈ) প্রমুখ। এর নৃত্য শিক্ষক ছিলেন নৃপেন্দ্রচন্দ্র বসু। সংগীত শিক্ষক ছিলেন দেবকণ্ঠ বাগচী ও তারাপদ রায়। মেকাপের দায়িত্বে ছিলেন কালীচরণ দাস।

‘মীরকাসিম’ এর মতো ‘ছত্রপতি শিবাজি’ স্বদেশী যুগে রচিত হওয়ার জন্য বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের উপর অসামান্য প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিন সপ্তাহ পরে ২৮ ভাদ্র (১৩১৪ সাল), ইংরেজিতে ১৯০৭ সালের ১৬ আগস্ট ‘কোহিনুর থিয়েটার’-এ ‘ছত্রপতি শিবাজি’র অভিনয় শুরু হয়। পাশাপাশি দুটি রঙ্গমঞ্চে একই নাটকের অভিনয় নিয়ে তখন নাট্যজগতে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এখানে ঔরঙ্গজেব এর চরিত্রে অভিনয় করলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। শিবাজীর ভূমিকায় দাণীবাবু। গঙ্গাজি চরিত্রে হাঁদুবাবু। জিজাবাঈ এর চরিত্রে তিনকড়ি দাসী এবং লক্ষ্মীবাঈয়ের চরিত্রে তারাসুন্দরী। রঙ্গমঞ্চে এঁরা অবতীর্ণ হওয়ার অভিনয় যে অতি উৎকৃষ্ট হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। সেই সময়ের এমন একটাও পত্রিকা ছিল না যারা এই দুটি ছত্রপতি শিবাজির সুখ্যাতি না করেছেন। উভয় থিয়েটারের অভিনয় তুলনা করা হয়েছে প্রতিটি পত্রিকায়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ও ম্যানগ্রোভ-সহযোগীরা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

১৯১১ সালের জানুয়ারি মাসে ইংরেজ গভর্নমেন্ট কর্তৃক ‘ছত্রপতি শিবাজি’র অভিনয় এবং প্রচার নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। গিরিশচন্দ্র অভিনীত পরিচালিত কোহিনূর থিয়েটারে মঞ্চস্থ ‘ছত্রপতি শিবাজি’র প্রশংসা বিভিন্ন পত্রিকা মুখর হয়েছিল। তার কিছু উল্লেখ করতেই হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকাতে লিখলেন, “Chhatrapati is one of the best and most powerful Dramas ever produced on the Indian stage”.

মহারাষ্ট্রে সুসন্তান তেজস্বী পণ্ডিত সখারাম গণেশ দেউস্কার তার ‘হিতবাদী’ পত্রিকাতে লিখলেন, “মহারাষ্ট্রীয়রা ছত্রপতি শিবাজিকে যেরূপ শ্রদ্ধার চোখে দর্শন করিয়া থাকেন, গিরিশবাবুর নাটকে তাহা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় নাই দেখিয়া আমরা আনন্দিত হইয়াছি। শিবাজি চরিত্রের বিভিন্ন সদগুণ এবং তাঁহার সহচর ও কর্মচারীদিগের চরিত্রের বিশেষত্ব এই নাটকে অতীব দক্ষতার সহিত পরিস্ফুট করা হইয়াছে। জাতীয় অভ্যুদয়ের পক্ষে ওই সকল গুণের প্রয়োজনীয়তার বিষয় চিন্তা করিলে বলিতে হয়, গিরিশবাবু অতি সুসময়েই এই নাটকের প্রচার করিয়াছেন।”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৩: শ্রীমার বড় ভাইজিরা—নালু ও মাকু

বিখ্যাত লেখক সম্পাদক জলধর সেন ‘বসুমতী’ পত্রিকায় লিখলেন, “ক্ষুদ্র লেখক অতিরঞ্জনের প্রলোভনে শিবাজির প্রকৃত মূর্তি বিকৃত করিয়া ফেলিত, গিরিশবাবু তাহা উজ্জ্বল করিয়া দেখাইয়াছেন। গিরিশবাবু তাঁহার পরিণত বয়সের সংযত কল্পনার সকল শক্তি, সকল জ্যোতি ঢালিয়া এই প্রাতস্মরণীয় মহারাষ্ট্র দেশনায়কের উজ্জ্বল চির পূজা বরণীয় মহনীয় দেবমূর্তি অঙ্কিত করিয়া তুলিয়াছেন।”

গিরিশচন্দ্র যেভাবে খেটে এই ‘ছত্রপতি শিবাজি’ নাটক লিখেছিলেন এবং অভিনয় করিয়েছিলেন তা সত্যিকারের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। গিরিশ অঙ্কিত শিবাজী দেশবিশেষে, যুগ বিশেষে জন্মগ্রহণ করেননি। ধরাতলে যখন অত্যাচার প্রবল হয়, দরিদ্র উৎপীড়িত হয়, দেবমূর্তি চূর্ণ হয়, সতীলক্ষীদের পাষণ্ডের হাতে নিগৃহীত হতে হয়, তখনই সেই দেশকে রক্ষা করবার জন্য বিধাতা একজন শিবাজিকে ছত্রপতি রূপে প্রেরণ করে থাকেন। এই জন্য শিবাজি শিব শক্তি সম্ভূত— শংকর অংশ। সেটাই স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে গিরিশচন্দ্রের নাটকটিতে।—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content