রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


গিরিশচন্দ্র ঘোষ।

সেই সময় মহাসমারোহে প্রত্যেক শনিবার ‘সীতারাম’ নাটকটি অভিনীত হচ্ছে গিরিশচন্দ্রের পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে। গিরিশচন্দ্র স্বয়ং সীতারামের ভূমিকায় রঙ্গমঞ্চ অবতীর্ণ হতেন। পরের দিন রবিবার তিনি অভিনয় করতেন ‘প্রফুল্ল’ নাটকে। সেখানে তাঁর চরিত্রের নাম যোগেশ।
রবিবার নাটক তখনও অভিনয় শুরু হয়নি, এমন সময় এই দুটি নাটকের সঙ্গে যুক্ত অভিনেতা চুনিলাল দেবের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মিনার্ভার থিয়েটারের সুপ্রসিদ্ধ ব্যান্ডমাস্টার নন্তি বাবু গিরিশচন্দ্রকে বললেন, “রবিবার আপনার একখানি পুরাতন নাটকের সঙ্গে আপনার নতুন একখানি ছোট গীতিনাট্য যোগ করিয়া দিলে আপনাকে আর উপরি উপরই দুই দিন খাঁটিতে হয় না”।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৬২: গিরিশচন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়লে ‘গৃহলক্ষ্মী’ নাটকটি সম্পূর্ণ করেন দেবেন্দ্রনাথ বসু

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৪: যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না?

গিরিশচন্দ্র তার উত্তরে বলেছিলেন “দুই রাত্রি অভিনয়ের পর কল্য দিবাভাগে একটু বিশ্রাম না করিলে লিখিতে বসি কিরূপে? অথচ নতুন বহিখানি লেখা শেষ করিয়া কল্য সোমবার হইতেই রিহার্সাল ফেলিতে না পারিলে, নিত্য গীত শিক্ষা হইবে কি করিয়া? নাচ গানই তো গীতিনাট্যের প্রধান অঙ্গ। কথা যেন মুখস্ত হইল, সুচারুরূপে নৃত্য গীত শিক্ষা না হইলে বইতো জমিবে না। আচ্ছা দেবগুরু প্রসাদেন জিহ্বাগ্রে সরস্বতী। কাগজ-কলম নিয়ে এসো ঠাকুরের কৃপায় আমি আজই বই লিখে দিচ্ছি।”। লেখক কাগজ-কলম আনলে সঙ্গে সঙ্গে বিষয় নির্বাচন করে রচনা শুরু করে দিলেন গিরিশচন্দ্র।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো

জাম্বুবতীর বিবাহ বা স্যমন্তক মনি উদ্ধারে শ্রীকৃষ্ণের কলঙ্কমোচন এই পৌরাণিক বিষয় নিয়েই ‘মনিহরণ’ এই গীতিনাট্যটি রচিত হয়েছিল। মিনার্ভা থিয়েটারে এই গীতিনাট্যের প্রথম অভিনয়টি হয়েছিল ১৯০০ সালের ২২ জুলাই। প্রথম অভিনয় রজনীতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁরা হলেন—চুনিলাল দেব (সত্রাজিত)
অঘরনাথ পাঠক (জাম্বুবান)
প্রিয়নাথ ঘোষ (সত্রাজি দূর)
নরেন্দ্রনাথ সরকার (সূর্য)
কুন্তলাল চক্রবর্তী( ঊষা)
শ্রীমতি পান্না (রুক্মিণী)
শ্রীমতি সরোজিনী (রাণী)
শ্রীমতী হিঙ্গল বালা (জাম্দবতী)
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৯: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—কালি লতা ও পান লতা

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৫: বার্নার্ড শ ও শার্লটি—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/১

এই গীতিনাট্যের সুরকার সংগীত পরিচালক হলেন দেবকণ্ঠ বাগচি এবং নৃত্য শিক্ষক শরৎচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (যিনি রানু বাবু নামে পরিচিত ছিলেন)। মঞ্চসজ্জার দায়িত্বে ছিলেন ধর্মদাস সুর।

এই গীতিনৃত্যনাট্যটির রচনার ব্যাপারে একটু বিশেষত্ব আছে। গিরিশচন্দ্র ওই প্রফুল্ল নাটকের অভিনয় করতে করতে রঙ্গমঞ্চের গমন করছেন আবার এসে বই লিখতে বসছেন। একজন হুশিয়ার লোককে নিয়োগ করা হয়েছিল। সে যেন তাঁকে অভিনয়কাল উপস্থিত হলেই যথাসময়ে এসে খবর দেয়। এই ভাবে অভিনয়ের অবসরে অবসরে গীতি নৃত্যনাট্যখানি রচিত হয়েছিল। অভিনয়ের শেষে স্টেজে বসেই গীতিনাট্যের ২৮ খানা গান বেঁধে দিয়ে তিনি চুনীলাল বাবুকে বললেন, “ইচ্ছে করো আরো একখানা নকশা লিখিয়া দিতে পারি”।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৩: মিলাডা—বিদেশিনীর হরফ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক বিহারীলাল সরকার এই ‘মণিহরণ’ নাটকের অভিনয় দেখে এতো মুগ্ধ হয়েছিলেন একটি সুদীর্ঘ সমালোচনা বার করেছিলেন তাঁর পত্রিকায়। তারই কয়েকটি ছত্র উদ্ধার করা গেল “বিভিন্ন পূর্ণপ্রস্ফুট কুসুম রাজি বিরাজিত পৌরাণিক কাব্যোদানের কোন প্রান্ত-নিপতিত উপেক্ষিত একটি ঈষদ মুকুলিত কুসুম লইয়া গিরিশবাবু তাহাতে সক্রিয় নাটকীয় কল্পনা প্রসূত নূতন চরিত্র, গীত, নৃত্য, ভাব, রসের ললিত লতাপুষ্প আর শ্যামল কিশলয়গুচ্ছ জড়াইয়া নয়ন মনপ্রীতিপদ তোড়া তৈয়ারী করিয়াছেন।”—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content