গিরিশচন্দ্র ও গোপাল সুন্দরী।
রূপসনাতন নাটক অভিনয় চলাকালীন স্টার থিয়েটারে এক বিপ্লব উপস্থিত হয়। স্টারের অসামান্য প্রতিপত্তি দেখে কোলুটোলার সুবিখ্যাত মতিলাল শীলের পৌত্র গোপাল শীল মহাশয়ের থিয়েটার করবার শখ জেগে ছিল। তখন তিনি অগাধ সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন। গোপালবাবু স্টার থিয়েটারের জমি কিনে নিয়ে ওই থিয়েটারের স্বত্বাধিকারদের থিয়েটার বাড়ি ছাড়ার নোটিস দিলেন। গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র, হরিপ্রসাদ বসু, দাসুচরণ নিয়োগী-সহ স্বত্বাধিকারগণের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করলেন থিয়েটার বাড়িটা গোপালবাবুকে বিক্রি করবেন। তবে স্টার নামের গুডউইল হাতছাড়া করা যাবে না। বিক্রয় করে যে টাকা পাওয়া যাবে সেই দিয়ে তাঁরা অন্যত্র জমি কিনে হল তৈরি করবেন। তাঁদের প্রস্তাবে গোপাললালবাবু সম্মত হয়ে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে বাড়িখানা ক্রয় করে নিলেন।
যদিও গিরিশচন্দ্র গোপালবাবুর প্রেরিত লোককে এমারেল্ড থিয়েটারে যোগদানে তাঁর অসম্মতি কথা জানালেন। গোপালবাবু কুড়ি হাজার টাকা বোনাস এবং মাসিক ৩৫০ টাকা করে বেতন দেওয়ার প্রস্তাব করে পুনরায় লোক পাঠালেন গিরিশচন্দ্র ঘোষের কাছে। এই প্রস্তাবে গিরিশচন্দ্র ভাবলেন গোপালবাবু বোনাস স্বরূপ তাঁকে যে কুড়ি হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন সেই অর্থে তাঁর প্রিয় শিষ্যদের অর্থাভাব ঘুচে যাবে। তাঁরা থিয়েটার হল প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন আর তিনি যা শিক্ষা দিয়েছেন তাতে তাঁরা কাজও চালিয়ে নিতে পারবেন এ বিশ্বাস তাঁর ছিল। কিন্তু না গেলে গোপালবাবুর কোপে পড়তে হবে। গোপালবাবু জানিয়ে রেখেছিলেন গিরিশবাবু কুড়ি হাজার টাকা নিয়ে এমারেল্ড থিয়েটারে ম্যানেজার হোন তো ভালো আর না হলে কিন্তু ওই টাকা ব্যয় করে স্টারের সমস্ত অভিনেতা অভিনেত্রীদেরকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন।
আরও পড়ুন:
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৩৪: ‘মুকুল মুঞ্জরা’ গিরিশচন্দ্রকে নাট্যজগতে স্বতন্ত্র করে তুলেছে
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩২: কি ‘উপহার’ সাজিয়ে দেব
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৮: সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত গান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন পঞ্চম
উভয় সংকটে পড়ে গিরিশচন্দ্র গোপালবাবুর থেকে কুড়ি হাজার টাকা বোনাস এবং ৩৫০ টাকা মাসিক মায়নায় পাঁচ বছরের এগ্রিমেন্টে আবদ্ধ হয়ে এমারেল্ড থিয়েটারে প্রবেশ করলেন। গিরিশচন্দ্র ওই কুড়ি হাজার টাকা থেকে ১৬ হাজার টাকা শিষ্যদের নিঃস্বার্থভাবে দান করে রঙ্গালয় নির্মাণের জন্য বললেন। তিনি একথাও বললেন, “তোমরা ভদ্র সন্তান। নানা প্রোপ্রাইটর কর্তৃক লাঞ্ছিত হয়ে এখন ঈশ্বরের ইচ্ছায় স্বাধীন হলে। আমার অনুআমারে সব ভদ্র সন্তান তোমাদের আশ্রয় গ্রহণ করবে তারা যেন লাঞ্ছিত না হন।”
আরও পড়ুন:
বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: প্রচণ্ড গরমে নাজেহাল? ঘরে বসেই আয়ুর্বেদ অনুসারে ভালো থাকুন
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬০: রাতদুপুরে বিপন্নকে বাঁচাতে হাটখোলার পাট আড়তের টাকা এসেছিল জোড়াসাঁকোয়
গৃহসজ্জা: মনের মতো পরিপাটি করে ঘর সাজাতে চান? তাহলে এগুলি মাথায় চলুন
এমারেল্ড থিয়েটারের যাত্রা শুরু হল গিরিশচন্দ্রের ‘পূর্ণচন্দ্র’ এবং ‘বিষাদ’ নামের দুটি নাটক দিয়ে। দুটি নাটকই আজ পর্যন্ত নাট্যমোদীদের কাছে পরম আদরের হয়ে উঠেছে। পূর্ণচন্দ্র প্রথম অভিনীত হয়েছিল এমারেল্ড থিয়েটারে ১৮৮৮ সালের ১৭ মার্চ। প্রথম দিনে এখানে অভিনয় করেছিলেন শালিবাহনের চরিত্রে মহেন্দ্রলাল বসু। পূর্ণচন্দ্রের ভূমিকায় গোলাপ সুন্দরী। দামোদরের চরিত্রে মতিলাল সুর। ইচ্ছার চরিত্রে ক্ষেত্রমণি। লুনার চরিত্রে শ্রীমতি বনবিহারিণী। সারি’র চরিত্রে কুসুমকুমারী।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮: রামচন্দ্রের কৈশোর, ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র— এক অনন্য উত্তরণ
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১: নাথানিয়্যাল গোবিন্দ সোরেনের গল্প
উৎসবের উষ্ণতায় শারুল-শিমুল
গিরিশচন্দ্রের জীবন আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ। যৌবনের উচ্ছৃঙ্খল অবস্থায় আমরা তাঁকে মুমূর্ষুর সেবা করতে দেখেছি। ভগবানের কৃপালাভের নিমিত্তে তাঁর আন্তরিক ব্যাকুলতার পরিচয় পেয়েছি। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের আশ্রয় লাভ করার পূর্বেও তিনি যেসব নাটক লিখেছেন এবং সে সব নাটকের স্থানে স্থানে তাঁর স্বভাবজাত আধ্যাত্মিকভাবের স্ফুরণ লক্ষ্য করা গিয়েছে। প্রথম প্রথম সাক্ষাতে ঠাকুর গিরিশচন্দ্রকে বলেছেন, “তোমার হৃদয়ে আকাশে অরুোণদয় হয়েছে, নইলে কি চৈতন্যলীলা লিখতে পারো, শিগগির জ্ঞানসূর্য প্রকাশ পাবে।”—চলবে
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।