রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিটের ‘স্টার থিয়েটার’-এর ‘রূপ সনাতন’ নাটক যখন চলছিল, তখন এক বিপ্লব উপস্থিত হয়। স্টার এর অসামান্য প্রতিপত্তি দেখে কলুটোলার সুবিখ্যাত মতিনাল শীলের পৌত্র গোপাললাল শীলের থিয়েটার হল তৈরি করার শখ জাগলো। পিতা মারা যাওয়ার পর তখন তিনি অগাধ সম্পত্তি অধিকারী হয়েছিলেন। গোপালবাবু স্টার থিয়েটারের জমি কিনে নিয়ে সেখানকার থিয়েটারের স্বত্বাধিকারগণকে থিয়েটার বাটি স্থানাঙ্কিত করবার নোটিস দিলেন। সবাই বিপদে পড়লেন। বড়লোকের সঙ্গে বিবাদ পরিণাম চিন্তা করে তাঁরা সকলে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। অবশেষে গিরিশচন্দ্র উদ্যোগী হয়ে অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র, হরিপ্রসাদ বসু, দাশুচরণ নিয়োগী প্রমুখ স্বত্বাধিকারদের সঙ্গে পরামর্শ করে, স্থির করলেন থিয়েটার বাড়িটা তাঁরা গোপালবাবুকে বিক্রি করে দেবেন। কিন্তু স্টার থিয়েটার নামের ‘গুড উইল’ সেটা কিন্তু হাতছাড়া করা যাবে না।
বিক্রয় করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা দিয়ে অন্যত্র জমি কিনে নূতন স্টার থিয়েটার পত্তন করতে হবে। তাঁদের প্রস্তাবে গোপাললাল শীল সম্মত হয়ে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে বাড়িটি ক্রয় করে নিলেন। বিদায় সম্ভাষণের বিশেষ বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছিল স্টার থিয়েটারে ‘বুদ্ধদেব চরিত’ এবং ‘বেল্লিক বাজার’-এর শেষ অভিনয়ের কথা। শেষ দিনের অভিনয় দেখতে স্টার থিয়েটারে যেন দর্শক ভেঙে পড়ল, এরকম অবস্থা হয়েছিল। গোপাললাল শীলের কাছ থেকে পাওয়া ৩০ হাজার টাকায় স্টার থিয়েটার সম্প্রদায় কর্নওয়াল স্ট্রিটে (বর্তমান নাম বিধান সরণি হাতিবাগান) জায়গা কিনে পুনরায় স্টার থিয়েটারের ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করলেন। যোগেন্দ্র নাথ মিত্র ও ধর্মদাস সুরের উপরে রঙ্গমঞ্চ নির্মাণের ভার অর্পণ করে দিলেন তাঁরা। এদিকে গোপাললাল শীল স্টার থিয়েটার নাম পরিবর্তন করে এমারেল্ড থিয়েটার নাম দিলেন।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৩০: গিরিশ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার মনের বাঁক যাবে তো?” ঠাকুর বললেন, “যাবে, ঠিক যাবে”

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৭: উত্তমের প্রশ্নে মজাদার জবাব ভানুর, হাসির বন্যা বয়ে গেল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো ফ্লোরে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৫: আঁধার ভূবনে আবার কে তুমি জ্বেলেছ ‘সাঁঝের প্রদীপ’ খানি

নাট্যশালা সুসংস্কৃত করে ভাঙা ন্যাশনাল থিয়েটার থেকে মহেন্দ্রলাল বসু, কেদারনাথ চৌধুরী, মতিলাল সুর, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি প্রমুখকে নিয়ে এসে একটি দল গঠন করলেন। কেদারনাথ চৌধুরী ম্যানেজার হলেন। তাঁরই রচিত ‘পাণ্ডব নির্বাসন’ নাটকের রিহার্সাল শুরু হল। গোপাললাল শীল বিস্তার অর্থ ব্যয় করে, ডায়নামো বসিয়ে, থিয়েটারের ভেতরে ও বাইরে প্রচুর আলোর ব্যবস্থা করলেন। বলাই বাহুল্য যে, সেই সময় কলকাতায় বৈদ্যুতিন আলোর এমন প্রচলন ছিল না। ১৮৮৭ সালের ৮ অক্টোবর খুব ধূমধাম করে এমারেল্ড থিয়েটারের ‘পাণ্ডব নির্বাসনে’র প্রথম অভিনয়টি হয়।
আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৭: ফুটবলের শিল্পী: বিশ্বের দশজনের একজন

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: বাড়তি রক্তচাপ চিন্তা বাড়াচ্ছে? উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কী করবেন, কী করবেন না

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৫: বালক অষ্টাবক্রের বুদ্ধিবলে পিতা কহোড় পেলেন নবজীবন

কিন্তু দু’মাস যেতে না যেতেই গোপাললাল শীল বুঝতে পারলেন গিরিশচন্দ্রের অভাবটা। এত টাকা ঢাললেন, কিন্তু থিয়েটার তেমন চলছে না। গোপালবাবুকে অনেকেই বলতে লাগলেন “মহাশয় থিয়েটারে যদি ফুল ফুটাইতে চান গিরিশবাবুকে লইয়া আসুন। এ যেন আপনার শিবহীন যজ্ঞ হইতেছে। “গোপাললাল শীল গিরিশচন্দ্রকে তাঁর থিয়েটারের ম্যানেজার করবার জন্য অত্যন্ত তৎপর হলেন। গিরিশচন্দ্র প্রথমে সম্মত হচ্ছিলেন না এমারেলড থিয়েটারে যোগদানের ব্যাপারে। কিন্তু গোপাললাল ছাড়বার পাত্র নন। তিনি নগদ কুড়ি হাজার টাকা বোনাস এবং মাসিক ৩৫০ টাকা করে বেতন দেওয়ার প্রস্তাব করে পুনরায় লোক পাঠালেন। এই প্রস্তাবে গিরিশচন্দ্র পরে সম্মত হলেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৩: রবীন্দ্রনাথের পোশাকআশাক

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৯: অষ্টবক্র শরীর— পুরুষের সমাজে পুরুষ শরীর

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৯: জলে হরি, স্থলে হরি, হরিময় এ জগৎ

গোপালবাবু বোনাস স্বরূপ গিরিশচন্দ্রকে হাজার টাকা দিতে চাইতেছেন। সেই অর্থে তাঁর প্রিয় শিষ্যদের কাজটি সুসম্পন্ন হবে। গোপালবাবু জানিয়ে রেখেছিলেন, “গিরিশবাবু কুড়ি হাজার টাকা লইয়া এমারেল্ড থিয়েটারের ম্যানেজার হন ভালো, নচেৎ তিনি ওই কুড়ি হাজার টাকা ব্যয় করিয়া তাঁর প্রিয় থিয়েটারের সমস্ত অভিনেতা ও অভিনেত্রী ভাঙ্গাইয়া লইবেন।” সংকটে পড়লেন গিরিশচন্দ্র। তিনি গোপালবাবুর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা বোনাস এবং ৩৫০ টাকা মাসিক বেতনে পাঁচ বছরের জন্য এগ্রিমেন্টে আবদ্ধ হয়ে এমারেল্ড থিয়েটার প্রবেশ করলেন।
গিরিশচন্দ্র ওই কুড়ি হাজার টাকা থেকে ১৬ হাজার টাকা শিষ্যদের নিঃস্বার্থভাবে দান করে রঙ্গালয় নির্মাণের জন্য তৈরি হলেন। সেই সঙ্গে স্বত্বাধিকারগনকে বিশেষ অনুরোধ করে বললেন, “তোমরা ভদ্র সন্তান। নানা প্রোপাইটার কর্তৃক লাঞ্ছিত হইয়া এক্ষণে ঈশ্বরের ইচ্ছায় তোমরা স্বাধীন হইলে। আমার অনুরোধ যে সকল ভদ্র সন্তান তোমাদের আশ্রয় গ্রহণ করিবে তাঁহারা যেন কখনও কোন রূপ লাঞ্ছিত না হয়।”

পরবর্তী পর্বে জানানো হবে এই এমারেল্ড থিয়েটারে গিরিশচন্দ্র যে দুটি নাটক অভিনয় করিয়েছিলেন (পূর্ণচন্দ্র এবং বিষাদ) সেই দুটি নাটকের পূর্ণাঙ্গ লেখা প্রকাশিত হবে।
>* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content