গিরিশচন্দ্র ঘোষ।
গিরিশচন্দ্রের পৌরাণিক এবং সামাজিক নাটকগুলো যেমন অসাধারণ জনপ্রিয় হয়েছিল, ঐতিহাসিক নাটকগুলির সম্পর্কে ঠিক তেমন ভাবে বলা যায় না। আসলে গিরিশচন্দ্রের যুগ ধর্মোত্থানের যুগ। গিরিশচন্দ্রের ঠিক আগেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহাসিক নাটক দেশের মধ্যে স্বদেশীভাব উদ্দীপিত করে তুলেছিল। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক নাটক ‘প্রতাপাদিত্য’ রচনা করার পর আবার ঐতিহাসিক নাটকের যুগ আরম্ভ হয়েছিল। এটাই ঐতিহাসিক নাট্য সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে।
গিরিশচন্দ্র এই সময়ই তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘সিরাজদ্দৌলা’-র লেখেন। তখন বঙ্গ ব্যবচ্ছেদের সময়। বাংলাদেশে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়েছে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন। সর্বত্র উত্তেজনা এবং বিক্ষোভের আর শেষ নেই। এই সময় গিরিশচন্দ্র ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটকে বাঙালির অতীত স্বাধীনতা সূর্যের অস্তরাগের করুন ছবিটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। উৎসাহিত জনগণ সাদরে তা গ্রহণ করেছিলেন।
গিরিশচন্দ্র এই সময়ই তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘সিরাজদ্দৌলা’-র লেখেন। তখন বঙ্গ ব্যবচ্ছেদের সময়। বাংলাদেশে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়েছে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন। সর্বত্র উত্তেজনা এবং বিক্ষোভের আর শেষ নেই। এই সময় গিরিশচন্দ্র ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটকে বাঙালির অতীত স্বাধীনতা সূর্যের অস্তরাগের করুন ছবিটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। উৎসাহিত জনগণ সাদরে তা গ্রহণ করেছিলেন।
গিরিশচন্দ্রের ঐতিহাসিক নাটকের একটি প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য হল এটাই যে, তিনি যথাসম্ভব ইতিহাসের প্রতি আনুগত্য রক্ষা করেই নাটক লিখেছেন। কোনও ঐতিহাসিক কাহিনী সম্বন্ধে নাটক লেখার পূর্বে তিনি সেই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে বিশেষ মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করেছিলেন। এতে তাঁর নাটকগুলি ঐতিহাসিক নিষ্ঠা ও মর্যাদা লাভ করেছে। বীররস পরিস্ফুটনে গিরিশচন্দ্রের স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল। ঘটনার তীব্র ঘাত-প্রতিঘাতে এবং শক্তিশালী ভাষা প্রয়োগে তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলো বীররসাত্মক হয়ে উঠেছে গিরিশচন্দ্রের ঐতিহাসিক নাটকে গদ্য ও পদ্য উভয় প্রকার ভাষা রীতিই গৃহীত হয়েছিল। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ঐতিহাসিক নাটক সিরাজদ্দৌলা প্রশংসিত হয়েছিল।
স্বয়ং গিরিশচন্দ্রের কথায় “আমার সিরাজদ্দৌলা যে জনপ্রিয় হইয়াছে শুনিতে পাই, তাহা আমার সৌভাগ্য।” সিরাজদ্দৌলার রচনা করার আগেই গিরিশচন্দ্র বিশেষ যত্ন পরিশ্রম সহকারে বাংলার এই হতভাগ্য নবাব সম্বন্ধে দেশি-বিদেশি যাবতীয় ঐতিহাসিক তথ্য অনুসন্ধান করেছিলেন। কিন্তু বিদেশি লেখকদের ইতিহাস থেকে কোন কোন ঘটনা গ্রহণ করলেও দেশের লেখকদের বিশেষ করে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং নিখিলনাথ রায়ের ঐতিহাসিক তথ্যই তাঁর নাটকের মূল প্রেরণা যুগিয়েছে।
স্বয়ং গিরিশচন্দ্রের কথায় “আমার সিরাজদ্দৌলা যে জনপ্রিয় হইয়াছে শুনিতে পাই, তাহা আমার সৌভাগ্য।” সিরাজদ্দৌলার রচনা করার আগেই গিরিশচন্দ্র বিশেষ যত্ন পরিশ্রম সহকারে বাংলার এই হতভাগ্য নবাব সম্বন্ধে দেশি-বিদেশি যাবতীয় ঐতিহাসিক তথ্য অনুসন্ধান করেছিলেন। কিন্তু বিদেশি লেখকদের ইতিহাস থেকে কোন কোন ঘটনা গ্রহণ করলেও দেশের লেখকদের বিশেষ করে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং নিখিলনাথ রায়ের ঐতিহাসিক তথ্যই তাঁর নাটকের মূল প্রেরণা যুগিয়েছে।
আরও পড়ুন:
পর্ব -২০: গিরিশচন্দ্রের অন্যতম সেরা সামাজিক নাটক ‘হারানিধি’
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫: সে এক হতভাগ্যের ‘নষ্ট নীড়’ [২৪/০৮/১৯৫১]
সিরাজদ্দৌলার সিংহাসন প্রাপ্তির সময় থেকে নাটকের শুরু এবং তাঁর শোচনীয় পরিণতির পর মীরজাফরের মসনদ লাভে এই কাহিনীর সমাপ্তি ঘটেছে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবা যে অশুভ মুহূর্তে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন তখন থেকে চতুর্দিকে যে ভয়ঙ্কর মেঘরাশি সিংহাসনকে আচ্ছাদিত করে ফেলেছিল, বাংলার ইতিহাসের চিরন্তন লজ্জা কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছিল, সেই কাহিনীই উঠে এসেছে নাটকে। সিরাজের বিরুদ্ধে ঘসেটি বেগম, রাজবল্লভ, মীরজাফরের ষড়যন্ত্র, ইংরেজের সঙ্গে বিরোধ, পলাশী ক্ষেত্রে তাঁর পরিণতি, সিরাজের মর্মান্তিক মৃত্যু; মূল ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি যথাযথ ভাবে এই নাটকে বর্ণিত হয়েছে। এক একটা জায়গায় শুধু কিংবদন্তির উপর নির্ভর করা হয়েছে। নাটকের সাধারণ চরিত্রগুলি মোটামুটি ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে। জায়গায় জায়গায় নাটকের ইতিহাসের পূর্ণরূপ দেখিয়েছেন। যেমন দানশা চরিত্রটি। দানশার পূর্ববঙ্গীয় কথা ও তার প্রতিহিংসা বৃত্তির যেসব কারণ নাটকে দেখানো হয়েছে তাতে চরিত্রটির নাটকীয় উপযোগিতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সিরাজ পত্নী লুৎফার দুঃখ মমতা ও সহিষ্ণুতায় গড়া মূর্তিটি যা আমরা নাটকে দেখতে পাই সেটা ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে।
আরও পড়ুন:
মেয়েরা যৌবন ধরে রাখতে ডায়েটে রাখুন এই পাঁচটি খাবার
বাইরে দূরে: দ্রোণস্থলীর দেবতা টপকেশ্বর মহাদেব
দেশীয় ঐতিহাসিকগণ বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রাজনৈতিক ও প্রজাবৎসল সিরাজের যে রূপ উদঘাটন করেছিলেন নাট্যকার সেটাকেই তুলে ধরেছেন এই নাটকে। নাট্যকার সিরাজের মুখে শুনিয়েছেন, “নবাব রাজার ভৃত্য,প্রভু প্রজাগণে/প্রজার মঙ্গলকার্য্য সতত সাধন /নবাবের উদ্দেশ্য জীবনে।” নাটকের প্রধান দুটি চরিত্রে সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক তা নাট্যকার নিজেও স্বীকার করেছেন। তার একটি হল করিম চাচা এবং অপরটি হল জহরা। জহরা চরিত্রটির প্রতি নাট্যকারের অনুচিত পক্ষপাতিত্বের ফলে অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তবে করিম চাচা চরিত্রটিতে স্বয়ং গিরিশচন্দ্র অবতীর্ণ হতেন বলে ভূমিকাটি গুরুত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
গিরিশচন্দ্র ঘোষ।
জহরার মতো একটা সবজান্তা শক্তি আছে করিমের। করিম যেহেতু নাট্যকারের মুখপাত্র সেজন্য তার বক্তৃতা বক্তব্যকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। নাটকে তার সংলাপ বহুস্থানে ইতিহাসের ভাষ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। ইতিহাসে যাই থাকুক, নাটকের মধ্যে সিরাজদ্দৌলাকে এক স্নেহপূর্ণ ক্ষমাশীল নবাব রূপে দেখতে পাই। মাঝে মাঝে একটু খেয়ালী অশোভন আচরণ দেখা গেলেও, কোনও গুরুতর অপরাধের স্পর্শ তাঁর চরিত্র নিয়ে উচ্ছ্বসিত স্বদেশ। সিরাজদৌলার চরিত্রে নেই। গভীর জাতীয়তায় মহিমান্বিত করে তুলতে পেরেছেন নাট্যকার এই নাটকটিকে। সেখানেই গিরিশচন্দ্র ঘোষের চরম সার্থকতা।