শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও অমৃতলাল বসু।

গিরিশচন্দ্রের সাহিত্য সাধনা দীর্ঘকাল স্থায়ী এবং বৈচিত্রে ও প্রাচুর্যে তা উল্লেখযোগ্য। যেহেতু তিনি বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাই রঙ্গমঞ্চের দাবি মেটাতে গিয়ে তাঁকে অনেক নাটক লিখতে হয়েছিল। কোন কোন নাটকে তিনি প্রধান ভূমিকাতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি যেমন লিখেছেন পৌরাণিক কথা ভক্তিমূলক নাটক, তেমনি তিনি লিখেছেন স্বদেশপ্রেম তথা ঐতিহাসিক নাটক এবং তেমনি তিনি লিখেছেন সামাজিক তথা পারিবারিক নাটক। সামাজিক নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাটক হল ‘প্রফুল্ল’।

‘প্রফুল্ল’ নাটকের কাহিনি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র যোগেশ কলকাতার একজন ধনী ব্যবসায়ী। একান্নবর্তী পরিবারে তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদা ও পুত্র যাদব ছাড়া আছেন বিধবা মা উমা সুন্দরী, দুই ভাই রমেশ ও সুরেশ এবং রমেশের স্ত্রী প্রফুল্ল। যোগেশ তাঁর একক চেষ্টা ও সাধনায় খুব সামান্য অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে অর্থবান হয়ে উঠেছেন। মেজ ভাই রমেশকে মানুষ করে এটর্নি করেছেন। মা উমাসুন্দরীর অনেকদিনের বাসনা ছিল তিনি বৃন্দাবনে যাবেন, সন্তান হয়ে সে ব্যবস্থা যখন যোগেশ করেছেন সেই সময় থেকেই নাটকের কাহিনির সূত্রপাত। অকস্মাৎ যোগেশ খবর পেলেন যে তাঁর ব্যাংক ফেল হয়েছে। তাঁর যথাসর্বস্ব ইউনিয়ন ব্যাংকে জমা ছিল।সেই ব্যাঙ্ক ফেল পড়ায় তাঁর সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে।

মিনার্ভা থিয়েটার।

বরাবরই যোগেশ এর সামান্য মদ্যপানের অভ্যাস ছিল। এ বিপর্যয়ের সংবাদ শুনে যোগেশের মদ্যপানের মাত্রা বেড়ে গেল। রমেশ শুধু অ্যাটর্নিই নয়, স্বার্থপর কুটবুদ্ধি সম্পন্ন হীনচেতা একটা চরিত্র। রমেশ কৌশলে ভাইয়ের সম্পত্তি বেনামিতে লিখিয়ে নিজের নামে করে নিতে চাইলেন। রমেশ কৌশল করে চুরির অভিযোগে তার ছোটভাই সুরেশকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেন।যোগেশের কানে সে সংবাদ যখন পৌছল, তিনি কেবল অধীর হয়ে মদ খেয়ে সমস্ত কথা ভুলে থাকতে চাইলেন। মাতৃভক্ত যোগেশ, আদর্শ স্বামী যোগেশ সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে মদের মধ্যে ডুবে রইলেন। সর্বস্ব খুইয়ে জ্ঞানদা তার নিজের পুত্র যাদবকে নিয়ে একটি ভাঙ্গা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার বাড়ি বিক্রির টাকা ও গয়নার বাক্স কেড়ে নিয়ে যোগেশ সবই মদ খেয়ে উড়িয়ে দিলেন।
পুত্র যাদবকে নিয়ে জ্ঞানদা কোনওরকম কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করতে লাগলেন। বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ায় বাড়িওয়ালি তাদের বাড়ি থেকে বার করে দিলেন পথে। সেই পথেই জ্ঞানদার মৃত্যু হয়। যাদবকে হত্যা করে যোগেশকে নির্বংশ করার ষড়যন্ত্রে মেতে রইলেন রমেশ। কাঙালি ও জগমণির সহযোগিতায় যাদবকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চালালেন রমেশ। অবশেষে প্রফুল্ল নিজে মৃত্যুবরণ করে যাদবকে বাঁচালেন। এই সময় সুরেশ জেল থেকে খালাস পায় এবং তার বন্ধু শিবনাথের সহযোগিতায় পুলিশকে ডেকে ধরিয়ে দেয় রমেশ, কাঙালি ও জগমণিকে। মা উমাসুন্দরী উন্মাদ অবস্থায় বেঁচে রইলেন এবং যোগশ ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেলো’ বলে পাগল অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এই হল সামাজিক নাটক ‘প্রফুল্ল’।
আরও পড়ুন:

ইংলিশ টিংলিশ: ‘হাসি’ মানে শুধুই ‘Laugh’ বা ‘কান্না’ মানে শুধুই ‘Cry’ নয় — শিখে নাও আরও নতুন শব্দ!

পাকিস্তানের বিবাহিত অভিনেত্রী সজলের সঙ্গে প্রেম করছেন শাহরুখপুত্র আরিয়ান? নেট মাধ্যমে পোস্ট ঘিরে গুঞ্জন

স্টার থিয়েটার।

নাটকটি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয় ২২ আগস্ট, ১৮৮৯সালে। এই নাটকের প্রথম মঞ্চাভিনয় হয় স্টার থিয়েটারে। প্রথম রজনীর অভিনেতা অভিনেত্রীদের তালিকা যা পাওয়া গিয়েছে, তা হল যোগেশের ভূমিকায় অমৃতলাল মিত্র, রমেশের ভূমিকায় অমৃতলাল বসু, সুরেশ এর ভূমিকায় কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়, উমাসুন্দরীর ভূমিকায় গঙ্গা মনি, জ্ঞানদার চরিত্রে কিরণমালা, প্রফুল্লের চরিত্রে ভূষণকুমারী অভিনয় করেছিলেন। স্টার থিয়েটারে যখন রমরম করে চলছে ‘প্রফুল্ল’ তখন মিনার্ভা থিয়েটারেও ‘প্রফুল্ল’ খুলবার আয়োজন করা হয়। মিনার্ভার বিপুল উদ্যমে যোগেশের ভূমিকা তখন দেওয়া হয়েছিল মহেন্দ্রলাল বসুকে।

তিনি অভিনয়ের রিহার্সাল করার পর গিরিশচন্দ্রের মুখে যোগেশের ভূমিকা আবৃত্তি শুনে গিরিশচন্দ্রকে মহেন্দ্রলাল বললেন, ‘দেখুন এই যোগেশের প্রায় সব দৃশ্যই বোধহয় আপনি যেমন দেখাইতেছেন তেমনি অভিনয় করতে পারি কিন্তু আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’ আপনার মুখে যেমন শুনেছি তেমনটি বা তার কাছাকাছিও অনেক চেষ্টা করেও পেরে উঠব না। প্রতিযোগিতায় শেষকালে বুড়ো বয়সে কি অমৃতের কাছে হেরে যাব। এই পার্টে তখন খুব সুনাম অমৃতলাল মিত্র। তবু গিরিশচন্দ্র ঘোষ ওই ভূমিকা নিলেন।
এই দুই সম্প্রদায়ের অভিনয় নিয়ে শহরে তখন নিয়মিত চর্চা। বিশেষত নাট্যমোদীদের মধ্যে বিশেষ আন্দোলন হয়েছিল গুরু-শিষ্যের যুদ্ধে কে হারে কে জেতে? দুটি থিয়েটারহলেই পূর্ব থেকে টিকিট বিক্রি শুরু হয়। পুনরাভিনয়ে প্রথম রাত্রিতে দুটি থিয়েটারেই জনসমুদ্র। আবার দ্বিতীয় রজনীতে যাঁরা স্টারের দর্শক ছিলেন তাঁরা এলেন মিনার্ভাতে। মিনার্ভার দর্শকরা গেলেন স্টার থিয়েটারে। তবে কথার প্রত্যেক ভঙ্গিতে, চালচলনে, ভাবের অভিব্যক্তিতে, বয়সে, আকারে, গাম্ভীর্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের পাশে অমৃতলালের যোগেশ হীনপ্রভ হয়ে পরেছিল। মনে হল, একজন যেন যথার্থই যোগেশ আর আরেকজন যেন যোগেশ সেজেছেন।

Skip to content