শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


মহাপ্রভু চৈতন্যদেব

নটগুরু গিরিশচন্দ্রের ভক্তিরসাত্মক চরিত নাটক হল ‘রূপ সনাতন’। এটি প্রথম অভিনীত হয়েছিল ৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিটের ‘স্টার থিয়েটারে’ ১৮৮৭ সালের একুশে মে শনিবার।

মহাপ্রভুর জীবনকথা নিয়ে অনেকগুলি চরিত সাহিত্য রচিত হয়েছে মধ্যযুগে। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল বৃন্দাবন দাস রচিত ‘শ্রীশ্রীচৈতন্য ভাগবত’, কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ প্রভৃতি। এছাড়া বৈষ্ণবাচার্য নরহরি চক্রবর্তীর ‘ভক্তিরত্নাকর’, মহাত্মা নাভাজী দাসের ‘ভক্তমাল’ প্রভৃতি বৈষ্ণব জীবনীগ্রন্থ রয়েছে। সেইসব গ্রন্থগুলি থেকেই গিরিশচন্দ্র তাঁর এই ‘রূপ সনাতন’ নাটকের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। এর সঙ্গে কিছু কিছু স্হানে নিজের মতো করে নাটকটি সাজিয়েছেন।

‘রূপ সনাতন’ নাটকে প্রথম অভিনয় রজনীতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁরা হলেন: অমৃতলাল মুখোপাধ্যায় (মহাপ্রভু চৈতন্যদেব), উপেন্দ্রনাথ মিত্র (রূপ গোস্বামী), অমৃত লাল মিত্র (সনাতন গোস্বামী), কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায় (বল্লভ), অমৃতলাল বসু (সুবুদ্ধি), অঘোরনাথ পাঠক (হোসেন শাহ), মহেন্দ্রনাথ চৌধুরি (ঈশান), প্রবোধ চন্দ্র ঘোষ (রামদিন), কুসুমকুমারী (বালক), বনবিহারিনী (অলকা) ,গঙ্গামণি (করুনা) কিরণবালা (বিশাখা) প্রমুখ।
এই নাটককে নটগুরু গিরিশচন্দ্র ‘প্রেম ও বৈরাগ্য মূলক নাটক’ আখ্যায় ভূষিত করেছেন। প্রেম এখানে ভগবদ্ প্রেম বা ঈশ্বরানুরাগ আর ভগবানের প্রতি ভালোবাসার আধিক্যের ফলশ্রুতি অন্তরের ভক্তি রসসিক্ত বৈরাগ্যের উদয়। ভগবান চৈতন্যদেবের প্রতি সনাতন গোস্বামীর ঐকান্তিক প্রেম বা আসক্তি তাঁর চিত্তে বৈরাগ্য সঞ্চারিত করেছে বলে এই নাটকটিকে ‘ভক্তি রসাত্মক নাটক’ বলেই মনে করা হচ্ছে।

স্টার থিয়েটারে ‘নিমাই সন্ন্যাস’ নাটক থেকে শুরু করে ‘বেল্লিক বাজার’ পর্যন্ত সবকটি নাটকের সুরকার ও সংগীত শিক্ষক ছিলেন সঙ্গীতাচার্য রাম তারণ সান্যাল। তিনিও এই রূপ সনাতন নাটকেরও সুরকার। তিনি এর সুর সংযোজনা করে অভিনীত চরিত্রগুলিকে অর্থাৎ শিল্পীদের গানগুলি শিক্ষাও দিয়েছিলেন। এখানে বিখ্যাত গানগুলির মধ্যে রয়েছে ‘যখন আসবে তুফান ভাসিয়ে নিয়ে যাবে’, ‘আদর করে ডাকরে গৌর হরি’, ‘প্রেমে ঢলঢল চলচল রাধা রাধা নাম বলো না’, ‘বাসি হলো বনমালা দেখ ওলো প্রাণ সই’, ‘বল ভাই হরি হরি প্রেম করে ভাই হরিবল’, ‘দাঁড়ালো কিশোর বামে কিশোরী’ প্রভৃতি।

নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ

‘রূপ সনাতন’ গিরিশচন্দ্রের একটি আকর্ষণীয় রচনা এবং একটি স্মরণীয় নাটক তো বটেই। এই নাটক একদিকে যেমন দর্শক সমাজকে আকৃষ্ট করেছিল, তেমনি নাটক হিসেবে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল। এই নাটকের নাম ‘রূপ সনাতন’ হলেও সনাতন গোস্বামী এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে এবং নায়ক। তাঁকে অবলম্বন করেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাট্য কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। রূপ তাঁর সঙ্গে রয়েছেন এই পর্যন্তই। নাট্যকার নাট্য কাহনিতে নাটকীয়তা সৃষ্টি করতে এমন অনেক ঘটনার অবতারণা করেছেন, যেখানে ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে না। সনাতন, রূপ এবং বল্লভ এই তিন ভাই ছিলেন গৃহী এবং নবাবী আমলে উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত। বিভিন্ন চৈতন্যচরিত কাব্যগ্রন্থের নানা কাহিনি বিবৃত হলেও তাঁদের পত্নীদের সম্বন্ধে কোন তথ্য এবং এমন কি নাম পর্যন্ত জানা যায় না। গিরিশচন্দ্র নাটকের প্রয়োজনে পৃথক পৃথক করে তাঁদের নাটকে এনেছেন। চরিত্রগুলিকে বাস্তবসম্মত করে তুলতে নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করতে চেষ্টা করেছিলেন। হোসেন শাহের রাজদরবারের দবিরখাস এবং সাকর মল্লিক ছিলেন বিরাট উচ্চ রাজকর্মচারী কিন্তু তাঁরা মহাপ্রভুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন রূপ গোস্বামী এবং সনাতন গোস্বামী।

অমৃতলাল বসু

‘রূপ সনাতন’ নাটকে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রভাব পড়েছে বৈকি। ভক্ত গিরিশচন্দ্রের স্বচক্ষে দেখা গুরু রামকৃষ্ণের কার্য মহাপ্রভুর উপর আরোপ করে, কাশীধামে চন্দ্রশেখরের বাড়িতে, বৈষ্ণবগণ সমাগমে পরিপূর্ণ গৃহাঙ্গনে মহাপ্রভুর দ্বারা ভক্তদের পদধূলি গ্রহণের দৃশ্য দেখিয়েছেন। বিষয়টি বৈষ্ণব ভক্তদের মনঃপূত হয়নি। কিন্তু এই ব্যাপারে গিরিশচন্দ্র এতটুকু দ্বিধা করেননি। সেই সম্পর্কে তিনি সরাসরি বলেছেন: ‘আমি স্বয়ং বিশেষ রূপ উপলব্ধি না করিয়া কোন কথা লিখি না। একদিন কোনও এক ভক্তের বাটিতে ভগবৎ প্রসঙ্গ এবং সংকীর্তনাদির পর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সেই স্থানের ধূলি লইয়া অঙ্গে প্রদান করিলেন। ভক্তগণ ব্যস্ত হইয়া নিবারণ করিতে যাইলে ঠাকুর বলিলেন’ ‘কি জানো, বহু ভক্তের সমাগমে এবং ঈশ্বরীয় কথা ও নাম
সংকীর্তনে এই স্থান পবিত্র হইয়াছে। হরিনাম হইলে হরি স্বয়ং শুনিতে আসেন। ভক্ত পাদস্পর্শে এই স্হানের ধূলি পর্যন্ত পরম পবিত্র হইয়াছে।’

এই কথাগুলো মনে রেখেই গিরিশচন্দ্র এমন দৃশ্যের অবতারণা করেছিলেন ‘রূপ সনাতন’ নাটকে।

Skip to content