গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি।
১৯০৬ সালের শেষে হেমন্ত আগমনে অর্থাৎ কার্তিক মাসের শুরুতেই গিরিশচন্দ্র ঘোষ আবার হাঁপানিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। শীতকালে খুব যন্ত্রণায় যখন তিনি ঘরের মধ্যে আটকে রয়েছেন, সেই সময় (বড়দিন আসবার কয়েকটা দিন আগে) মিনার্ভা থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে দুঃখ প্রকাশ করছিলেন। বলছিলেন, “মহাশয় সব থিয়েটারে নতুন বই হইতেছে, আপনি পীড়িত আমরা কিছুই করিতে পারিলাম না।”
অসুস্থ রুগ্ন অবস্থাতেও গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁদের আশ্বস্ত করে বললেন, “ভাবিবেন না, যাহা কিছু হোক একটা করিয়া দিব”। যেমন বলা তেমন কাজ তিনি করলেন। সেই দিনই তিনি রুগ্ন অবস্থাতেই সুপ্রসিদ্ধ ফরাসি নাট্যকার মলিয়ারের গ্রন্থাবলী পড়তে আরম্ভ করলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই মলিয়ারের “এল আমিয়ার মেডিসিন” অবলম্বনে প্রহসন রচনা করলেন “য্যায়সা কা ত্যায়সা”। বড়দিনের নতুন প্রহসনের অভাব তিনি পূর্ণ করেছিলেন।
আরও পড়ুন:
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৬৫: মিনার্ভা ছেড়ে আবার ক্লাসিক থিয়েটারে ফিলেন গিরিশচন্দ্র
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গিরিশচন্দ্রের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে এরপরে সুপ্রসিদ্ধ গীতিনাট্যকার অতুল কৃষ্ণ মিত্র মশাইও মলিয়ারের গ্রন্থ অবলম্বনে তুফান, ঠিকে ভুল, রঙ্গরাজ প্রভৃতি অনেকগুলো গীতিনাট্য প্রহসন রচনা করেন এবং যা সুখ্যাতির সঙ্গে মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনীত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫২: পুলক রাখিতে নারি (কেল)
মিনার্ভা থিয়েটারে “য্যায়সা কা ত্যায়সা” প্রথম অভিনীত হয় ১৯০৭ সালের পয়লা জানুয়ারি। প্রথম দিনের অভিনয়ে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:
● অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি (হারাধন)
● সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ দানি বাবু (রসিক)
● অটলবিহারী দাস (সনাতন)
● নৃপেন্দ্রচন্দ্র বসু (মানিক)
● ক্ষেত্রমোহন মিত্র (মিস্টার নন্দী)
● দেবকণ্ঠ বাগচি (হোমিওপ্যাথি ডাক্তার)
● হেমন্ত কুমারী (রতনমালা)
● সুশীলা বালা (গরব)।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৪৬: দুবেজিকে নিয়ে ধৃতিমানের অনুমান সত্যি
নাটকের অভিনয় শিক্ষক হিসেবে ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং অর্জুন শেখর মুস্তাফি। সংগীত পরিচালক হলেন দেবকণ্ঠ বাগচি। নৃত্য শিক্ষক হলেন নৃপেন্দ্রচন্দ্র বসু। মেকআপের দায়িত্বে ছিলেন কালীচরণ ঘোষ। বংশীবাদক ও ঐক্যতানবাঁদন সৃষ্টিতে দক্ষ হলেন অমৃত লাল ঘোষ।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১০: মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে
প্রহসনখানি দর্শক মন্ডলীর বিলক্ষণ হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল। এই নিমিত্তে এই প্রহসনটি বহুদিন পর্যন্ত মিনার্ভা থিয়েটার অধিকার করে রেখেছিল। প্রায় সকল থিয়েটারেই এর অভিনয় হয়েছিল। উৎসর্গ পত্রে গিরিশচন্দ্র লিখেছেন, “স্নেহাস্পদ শ্রীমান দেবেন্দ্রনাথ বসু ভায়া তোমার উদ্যোগ ও সাহায্য ব্যতীত শয্যাশায়ী অবস্থায় এই প্রহসন খানি লিখিতে পারিতাম না। তুমি চিরদিনই আমার সহায়। এই ক্ষুদ্র গ্রন্থকানি তোমার নামে উৎসর্গীকৃত করিয়া আমি যে তৃপ্ত তাহা নহে। তবে তোমারই সাহায্যে এই গ্রন্থখানি রচিত হইয়াছে, এই নিমিত্ত ইহার সহিত তোমার নাম জড়িত থাকে, ইহাই আমার অভিপ্রায়। ইতি আশীর্বাদক শ্রীগিরিশচন্দ্র ঘোষ”।—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।