শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


গিরিশচন্দ্র ঘোষ।

গিরিশচন্দ্র ঘোষকে ‘মিনার্ভা’ থিয়েটারে এনে আর্থিক সচ্ছলতা লাভ করলেও এই নাট্যশালার গুরুত্বপূর্ণ মানুষ নরেন্দ্রনাথ সরকার আন্তরিক তৃপ্তি লাভ করতে পারছিলেন না। তাঁর ইচ্ছে ছিল তিনি নাটক লিখবেন এবং নাটকের প্রধান প্রধান ভূমিকাতে তিনি নিজেই অভিনয় করবেন। গিরিশচন্দ্র তাঁকে ভরসা দিয়েছিলেন, “তুমি কিছুদিন অপেক্ষা করো, ক্লাসিকের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগে থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা হউক, তাহার পর তোমাকে আমি তৈয়ারি করিয়া দিব।” কিন্তু নরেন্দ্র বাবু ধৈর্য ধরতে পারছিলেন না।
এই সময়ে সুযোগ সন্ধানী কিছু মানুষ স্বার্থপর উপদেষ্টা হিসেবে নানান রকম ভাবে কান ভাঙাতে শুরু করলেন নরেন্দ্রনাথ সরকারের। এঁদের প্ররোচনায় নরেন্দ্র বাবু গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে অকৌশল করে ফেললেন এবং যাঁরা স্বার্থ-সাধনের জন্য খুব সচেষ্ট হয়েছিলেন, তাঁরাও ঠিক কৃতকার্য হলেন। অপরিণত বুদ্ধি নরেন্দ্রনাথ নিজের ইষ্ট ভুলে গিয়ে তাঁর স্টেটের তৎকালীন ম্যানেজার অতুলচন্দ্র রায়ের সহযোগে গিরিশচন্দ্রের এগ্রিমেন্ট বাতিল করলেন।

পাশাপাশি সেই সময় বিখ্যাত অভিনেতা এবং পরিচালক অমরেন্দ্রনাথ দত্ত নিজের ভুল বুঝতে পেরে, গিরিশচন্দ্রকে আবার ক্লাসিক থিয়েটারে নিয়ে আসার জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি এই সুযোগ ছাড়লেন না। গিরিশচন্দ্রের কাছে এসে নিজের ত্রুটি স্বীকার করলেন। মার্জনা ভিক্ষা করে গিরিশচন্দ্রকে আবার তাঁর ক্লাসিক থিয়েটারে নিয়ে আসতে চাইলেন।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৬৪: জন্মাষ্টমী উপলক্ষে ‘নন্দদুলাল’ গীতিনৃত্যনাট্য লিখেছিলেন গিরিশচন্দ্র

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৭: যাজ্ঞসেনী স্বয়ংবরা দ্রৌপদী কি শুধুই প্রতিহিংসার বাতাবরণ বিনির্মাণ করেন?

এই থিয়েটারের হ্যান্ডবিলের বিশেষ দ্রষ্টব্য বলে তিনি একটি বিজ্ঞাপনও বার করলেন। সেটি হচ্ছে এইরকম— “নাট্যমোদী সুধীবৃন্দকে আনন্দের সহিত জানাইতেছি যে নটকুলচূড়ামনি পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত বাবু গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের সহিত আমাদের সকল বিবাদ বিসংবাদ মিটিয়া গিয়াছে। বাঙ্গালায় যে কয়েকটি স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হইয়াছে সকলগুলির সৃষ্টিকর্তা শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র। প্রায় সকল অভিনেতা ও অভিনেত্রী গিরিশচন্দ্রের শিক্ষায় গৌরবান্বিত। তাহার মধ্যে আমি একজন। গিরিশবাবুর সহিত বিবাদ করিয়া নিতান্তই ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়াছিলাম। বড়ই সুখের বিষয় সমস্ত মনোমালিন্য অন্তর হইতে মুছিয়া ফেলিয়া তাঁহার স্নেহময় কোলে আবার তিনি টানিয়া লইয়াছেন। গিরিশবাবুর কোনও থিয়েটারের সহিত এখন কোনও প্রকার সম্বন্ধ নাই। তাঁহার সমস্ত নূতন নূতন নাটক গীতিনাট্য ও পঞ্চরং এখন ক্লাসিকে অভিনীত হইবে। ক্লাসিক থিয়েটার ব্যতীত অপর কোন রঙ্গমঞ্চের সহিত গিরিশবাবুর কিছু মাত্র সম্পর্ক নাই। শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র এখন ‘ক্লাসিকে’র। নিবেদনমেতি।”
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— কেরালি ও নোনা হাতিশুঁড়

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক

ক্লাসিক থিয়েটারে এসে গিরিশচন্দ্র ‘অভিশাপ’ নামের একটি গীতিনাট্য লিখলেন এবং তাঁরই পরিচালনায় এ গীতিনাট্যটি মঞ্চস্থ হল ১৯০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। এই নাটকে বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করলেন—প্রমদা সুন্দরী (বিষ্ণু), হরিভূষণ ভট্টাচার্য (নারদ), অঘোরনাথ পাঠক (পর্বত), প্রবোধচন্দ্র ঘোষ (অম্বরিশ), সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ দানী বাবু (কন্ঠীদাস), তারা সুন্দরী (দুষ্ট সরস্বতী), কুসুমকুমারী (শ্রীমতি), ভুবনেশ্বরী (সুষমা)। নাটকের সংগীত পরিচালক হলেন দেবকণ্ঠ বাগচি এবং নাটকের নৃত্য শিক্ষয়িত্রী হলেন কুসুমকুমারী।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো

এটি একটি পৌরাণিক গীতিনাট্য। “অদ্ভুত রামায়ণ” থেকে এর গল্পংশ গ্রহণ করে গিরিশচন্দ্র নাটকটি রচনা করেছিলেন। গিরিশচন্দ্র তাঁর সব পৌরাণিক নাটকগুলিতে তাঁর সৃষ্টিশক্তির বিশেষ পরিচয় দিয়েছেন। এই গীতিনাট্যেও দুষ্টু সরস্বতীর অবতারণা তারই দৃষ্টান্ত। এর একদিকে যেমন কৌতুক অন্যদিকে তেমনি উচ্চভাবপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ দুষ্টু সরস্বতীর সঙ্গিনীদের গানটির কথা উল্লেখ করতেই হয়— “অভিমানে সৃজন ভুবন অভিমানের এ মেলা অভিমানের মধুর গানে সংসারে চলে খেলা।”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়। স্ত্রীলোকদের দ্বারা নৃত্যশিক্ষা বঙ্গ নাট্যশালায় এই ক্লাসিক থিয়েটারের প্রথম হল। কুসুমকুমারীর নৃত্যশিক্ষা কৌশল দর্শনে প্রীত হয়ে গিরিশচন্দ্র গীতিনাট্যের রজনীতে কুসুমকুমারীকে একখানি সুবর্ণপদক প্রদান করেন। এই সময় সুপ্রসিদ্ধ নৃত্য শিক্ষক শ্রীযুক্ত নৃপেন্দ্রচন্দ্র বসু ক্লাসিক থিয়েটার পরিত্যাগ করে কিছুদিনের জন্য অন্য থিয়েটারে যোগদান করেছিলেন।—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content